মুক্তিযুদ্ধে সোনারগাঁ উপজেলা (নারায়ণগঞ্জ)
সোনারগাঁ উপজেলা (নারায়ণগঞ্জ) ১৯৬৬ সালের বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ৬-দফার আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে সোনারগাঁয়ের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সোনারগাঁয়ের মানুষ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. শফর আলী মিয়াকে এমএনএ নির্বাচিত করে। নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের শৃঙ্খল ভেঙ্গে সোনারগাঁয়ের মানুষ মুক্তির পথ খুঁজে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্র শুরু করলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীসহ সাধারণ জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণ শোনার জন্য সোনারগাঁয়ের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ জনতাও সেদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় যোগদান করে। জনসভা থেকে ফিরে তারা এলাকায় সভা-সমাবেশের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করে তোলে।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার প্রতিবাদে ২৬শে মার্চ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা সোনারগাঁয়ের লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের সামনে এক সভার আয়োজন করে। নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মো. সিরাজুল ইসলাম মাস্টার (সনমান্দী), সুলতান আহমেদ বাদশা (দুলালপুর) আজিজুল্লাহ (কাঁচপুর), হাবিবুল্লাহ (পঞ্চবটি), আনন্দবাজারের কাওসার হোসেন, আব্দুল মান্নান, আসলাম উদ্দিন, আব্দুল বাতেন মোল্লা, শফিকুর রহমান প্রমুখ। সভায় সোনারগাঁয়ে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরদিন একই স্থানে সুলতান উদ্দিন মোল্লা বাদশা (সোনারগাঁ থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও আমিনপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি)-র নেতৃত্বে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে আরো একটি জনসভা হয়। একই সঙ্গে ছাত্র- যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য সোনারগাঁয়ের সনমান্দী গ্রামে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। সুলতান আহমেদ বাদশা ও মো. সিরাজুল ইসলাম মাস্টারের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন মো. হাবিবুল্লাহ, মোশারফ হোসেন ও আব্দুল মালেক। পরবর্তীতে ভারত থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে সোনারগাঁয়ের ছাত্র-যুবকরা বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন। মো. শফর আলী মিয়া এমএনএ পূর্বাঞ্চলীয় জোন বৈদ্যের বাজারে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা হিসেবে এবং লুৎফর রহমান ভূঁইয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও শরণার্থীদের পরিচয়পত্র প্রদানের দায়িত্ব পালন করেন।
২৭শে মার্চের পরপরই সুলতান উদ্দিন মোল্লা বাদশার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সাধারণ জনগণ আমিনপুর থেকে লংমার্চ করে লাঙ্গলবন্দ ব্রিজ ভাঙ্গার জন্য অগ্রসর হয়। ব্রিজ ভাঙ্গা সম্ভব না হলেও তারা লাঙ্গলবন্দ-সোনারগাঁ সড়কের বিভিন্ন অংশ কেটে পাকসেনারদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
১৯৭১ সালের ২৩শে মে সোনারগাঁয়ে পাকবাহিনী অনুপ্রবেশ করে এবং উদ্ববগঞ্জ ও বৈদ্যের বাজারে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই সোনারগাঁয়ে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। সোনারগাঁ থানা শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল এ এস এম সোলায়মান (বৈদ্যেরবাজার)। সে সোনারগাঁয়ের ১১টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের স্ব-স্ব ইউনিয়নের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করে। তারা ছিলেন- রাজা মৌলভী (আমিনপুর), মহিউদ্দিন মোল্লা (বৈদ্যেরবাজার), শামসুল হক খান (পিরোজপুর), আলাউদ্দিন (বৈদ্যেরবাজার), গফুর সরদার (সনমান্দী), আব্দুল মন্নাফ ভূঁইয়া (জামপুর), হোসেন খাঁ (কাঁচপুর), বাখর আলী (সাথীপুর), নাসিরউদ্দিন (নোয়াগাঁ), আব্দুল রব মিলকী (বারদী), রফিকুল ইসলাম (মোগড়াপাড়া), বাহর আলী (বরগা), হেলালউদ্দিন (ভরগাও), বোরহান মাস্টার (চরলাল), আবুল কাশেম (গোয়ালী) ও এম এ জাহের (সোনারগাঁ থানা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি ও শম্ভুপুরা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান)। রাজাকারদের মধ্যে হাতুরাপাড়া গ্রামের সিরাজুল ইসলাম, আব্দুল কদ্দুস ও অদুদ মিয়া, জমির আলী কেরানি (ভবনাথপুর), টেক্কা শামসু (হাতকোপা), আব্দুল মান্নান তালুকদার (মুশারচর), ময়েজ উদ্দিন দফাদার (হামছাদি), সাহাবুদ্দিন ভূঁইয়া (আলমদি), আনোয়ার (কাঁচপুর), গদাধর ঘোষ-র নাম উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই এ এস এম সোলায়মান (সোনারগাঁ থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান)-এর নেতৃত্বে তার সহযোগীরা সোনারগাঁ এলাকায় পণ্যবাহী নৌযান থেকে চাল, চিনি, ময়দা, চা, সার প্রভৃতি লুটপাট করত। সোনারগাঁয়ে অনুপ্রবেশের দিন পাকবাহিনী মৈষটেক রেলওয়ে ব্রিজের পাশে অবস্থান নিয়ে গোলাগুলি শুরু করে। পাকবাহিনীর ভয়ে নৌকাযোগে বিল পার হওয়ার সময় তাদের গুলিতে জ্ঞান দাস ও রেখা রাণী নামে দুজন গুলিবিদ্ধ হন। এরপর পাকবাহিনী হাতুরাপাড়া গ্রামের রাজাকার সিরাজুল ইসলাম ও আব্দুল কদ্দুসকে সঙ্গে নিয়ে সিরাব গ্রামে প্রবেশ করে সুশান্ত সরকার খোকন নামে একজনকে গুলি করে হত্যা করে এবং হিন্দুদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
মে মাসের শেষদিকে রাজাকার জমির আলী কেরানি (ভবনাথপুর) শাহপুরের বিভারাণীকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। বৈদ্যের বাজার ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে পাকবাহিনী রাতভর তার ওপর পাশবিক নির্যাতন শেষে অর্ধমৃত অবস্থায় ছেড়ে দেয়। রাজাকার জমির আলী কেরানির সহযোগিতায় তারা বৈদ্যের বাজারের নরেন্দ্র প্যাটেলের বাড়িতে হামলা করে। পাকবাহিনী সন্মান্দী ও পিরোজপুর গ্রামদুটি সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে দেয়। তাছাড়া কোম্পানিগঞ্জ ও সাথীপুর গ্রামেও তারা অগ্নিসংযোগ করে। ১৪ই ডিসেম্বর হারিয়া গোপিন্দী গ্রামের মোহাম্মদ সিদ্দিক মিয়াকে রাজাকাররা বাড়ি থেকে আদমজী এলাকায় ধরে নিয়ে হত্যা করে।
সোরনারগাঁ উপজেলার উদ্ববগঞ্জে বর্তমান টিএনও অফিস ও বৈদ্যের বাজারে স্থাপিত ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। ১৯৭১ সালের ১৮ই জুলাই গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সোনারগাঁয়ের কাইক্কারটেক হাটে বাজার করার সময় চারজন পাকসেনাকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। এখানকার একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন হলো সোনারগাঁ পার্ক অপারেশন। এটি ১৩ই আগস্ট আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। সিদ্ধান্ত মতো মুক্তিযোদ্ধারা সোনারগাঁ পার্ক থেকে সোনারগাঁ থানা ও পানামনগর রাস্তার মাথায় মাইন পুঁতে রাখেন। পাকসেনারা জিপ নিয়ে যাওয়ার সময় সেদিন মাইন বিস্ফোরণে চার-পাঁচ জন পাকসেনা নিহত হয়। পেছন থেকে আসা আরেকটি জিপ থেকে ছোড়া পাকসেনাদের গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা শামসুজ্জামান মজনু (গোয়ালদি) শহীদ হন। এরপর আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ২৩শে অক্টোবর বৈদ্যের বাজার পাকিস্তানি ক্যাম্প অপারেশন পরিচালনা করেন। এতে দুজন পাকসেনা নিহত হয়। আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা লাঙ্গলবন্দ ব্রিজ অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। সোনারগাঁ থানা কমান্ডার আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে সোনারগাঁয়ের বিদ্যুৎ ভৌমিকের গ্রুপ, বিএলএফ-এর গ্রুপ কমান্ডার আব্দুর রশীদের গ্রুপ (বন্দর), সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমান্ডার মো. ইসমাইলের গ্রুপ এবং নারায়ণগঞ্জের মো. গিয়াসউদ্দিনের গ্রুপ যৌথভাবে এ অপারেশন পরিচালনা করে। রতন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা লাঙ্গলবন্দ ব্রিজ অপারেশন পরিচালনা করেন। এ-সময় মাইন বিস্ফোরণে ব্রিজটি সামান্য হেলে পড়ে এবং ঘটনাস্থলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। সোনারগাঁয়ের মুক্তিযোদ্ধারা একজন পাকসেনাকে আহত অবস্থায় ধরে নৌকায় তুলে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেন। এছাড়াও হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের ১৮ই জুলাই কাইক্কারটেক হাট অপারেশন- এবং নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্রহ্মপুত্র নদে বার্জ অপারেশন পরিচালিত হয়। তাঁরা নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের বিরুদ্ধে বড়সাদিপুর যুদ্ধএ লিপ্ত হন।
৫ই নভেম্বর গ্রুপ কমান্ডার বিদ্যুৎ ভৌমিকের নেতৃত্বে মোগড়াপাড়া ব্রিজে অপারেশন চালানো হয়। এ মাসেই সেলিম, মাসুদ ও মালেকের গ্রুপ সম্মিলিতভাবে সোনারগাঁয়ের আনন্দবাজার ঘাটের কাছে মেঘনা নদীতে নারায়ণগঞ্জ থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে পাকবাহিনীর একটি পণ্যবাহী বার্জ আক্রমণ করে। অতর্কিত এ আক্রমণে কয়েকজন পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমণ করে। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে দেওয়ানবাগে পাকসেনাদের একটি টহল জিপে অপারেশন চালালে দুজন পাকসেনা নিহত হয়। নভেম্বরের শেষদিকে সোনারগাঁ উপজেলার বারদী বাজারের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে মেঘনা নদীতে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন চালালে ৪ জন পাকসেনা মারা যায়। পক্ষান্তরে পাকসেনাদের গুলিতে ফজলুল হক নামে একজন যুবক শহীদ হয়। ১৬ ই ডিসেম্বর সোনারগাঁ উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়।
সোনারগাঁ উপজেলায় যেসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়, তাঁরা হলেন- মো. আব্দুল খালেক (পিতা আলহাজ কুদরত আলী, মুশারচর), আক্তার হোসেন চৌধুরী (পিতা আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী, হাতকোপা), আলী আকবর (পিতা মমতাজ উদ্দিন, খিদিরপুর), বদরুজ্জামান (পিতা ছামেদ আলী, আলাপদী), তোফাজ্জল হোসেন (পিতা মো. মুজাফফর আলী, মনাইরিকান্দি), আফতাব উদ্দিন (পিতা আবদু মিয়া, কাফদী), সিদ্দিক মিয়া (পিতা আছির উদ্দিন, ভট্টপুর), আলামীন (পিতা আফদউদ্দিন, সন্মান্দী), আফাজ উদ্দিন (পিতা আল আমিন, সন্মান্দী), আব্দুল মজিদ (পিতা কেরামত আলী, লাহাপাড়া), মো. রমজান আলী (পিতা রূপচান মিয়া, আমিনপুর), মো. আলতাফ হোসেন (পিতা মো. তোফাজ্জল হোসেন, কুতুবপুর), মোস্তফা (পিতা চান মিয়া, আলাপদী), মো. মমিন ভূঁইয়া (পিতা মো. মান্নান ভূঁইয়া, পানামনগর), শামসুজ্জামান মজনু (গোয়ালদি; ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র), মো. সুলতান উদ্দিন আহমদ ভূঁইয়া (পিতা মো. মফিজ উদ্দিন ভূঁইয়া, পেরাব), নূর হোসেন (পিতা কাজেম উদ্দিন, বারীমজলিশ), নূরুল ইসলাম (পিতা নোয়াব আলী, দৈলরবাদ), আব্দুল মালেক (পিতা কালা গাজী, খংসারদি) ও ফুলু (বারদী ইউনিয়ন)। সোনারগাঁয়ে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামসহ একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। শহীদ শামসুজ্জামান মজনুর নামে চিলারবাগ পার্ক থেকে পানামনগর পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ মজনু সড়ক। [রীতা ভৌমিক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড