জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলাম
সৈয়দ নজরুল ইসলাম (১৯২৫-১৯৭৫) বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, ভাষা-সংগ্রামী, আওয়ামী লীগ হাই কমান্ডের সদস্য, জাতীয় চার নেতার অন্যতম, মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত বাংলাদেশ সরকার-এর উপ-রাষ্ট্রপতি ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকারী, ৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তী সময়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় খুনিচক্র কর্তৃক নির্মমভাবে নিহত। ১৯২৫ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার যসোদল বীরদামপাড়ায় তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ আবদুর রইস এবং মাতা নুরন্নেসা খাতুন রূপা। তিনি ১৯৪১ সালে ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪৩ সালে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বপূর্ণ ফল লাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে ১৯৪৬ সালে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৪৭ সালে একই বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে এলএলবি পাস করেন। ১৯৪৭-১৯৪৮ ও ১৯৪৮-১৯৪৯ সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি ছিলেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে ১৯৪৮-এর ভাষা-আন্দোলন-এ তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম পাকিস্তান সরকারের সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং চাকরি লাভ করেন। তবে এক বছরের মধ্যে তা ছেড়ে দিয়ে তিনি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দেন। পরে ময়মনসিংহ বারে আইন পেশায় যুক্ত হন। ১৯৫৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগএর সভাপতি ও ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ৬-দফা আন্দোলন ও পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকাকালে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত মুজিবনগর সরকার- নামে খ্যাত বাংলাদেশ সরকারের তিনি উপ-রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এটি ছিল এক কঠিন সময়ে গুরু দায়িত্ব। মুক্তিযুদ্ধকালে একটি মহল কর্তৃক পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান বা আপোস-মীমাংসার কথা বলার চেষ্টা এবং সে লক্ষ্যে গোপনে খানিকটা তৎপর হয়ে উঠলে, জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে (৬ই জুন) সৈয়দ নজরুল ইসলাম অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করে ঘোষণা করেন, “বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ কোন গোঁজামিলের সমাধান গ্রহণ করবে না। তিনি আরো বলেন, “বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদারবাহিনী ফিরিয়ে নেয়া, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান দ্বারাই কেবল রাজনৈতিক সমাধান আসতে পারে, অন্যথায় রাজনৈতিক সমাধানের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।’ জুনের শেষে অপর এক ভাষণে তিনি বলেন, “আমরা মুক্তিসংগ্রামের মধ্যবর্তী পর্যায়ে উপনীত। প্রতিটি হানাদার সৈন্যকে বাংলার মাটি থেকে উৎখাত না করা পর্যন্ত আমাদের বিশ্রাম নেই৷’ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করে মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দান করেন। স্বাধীনতার পর তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের শিল্পমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় পুনরায় শিল্পমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি জাতীয় সংসদের উপনেতা ছিলেন। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থাধীনে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হলে তিনি উপ- রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে নিয়োজিত হন।
মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশী মহলবিশেষের ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারী খন্দকার মোশতাক-এর মন্ত্রিসভায় সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় চার নেতা যোগদানে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। এর ফলে ২২শে আগস্ট তাঁদের গ্রেপ্তার করে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। অতঃপর ৩রা নভেম্বর গভীর রাতে মোশতাক সরকারের নির্দেশে বন্দি অপর তিন জাতীয় নেতাকে একই সেলে নিয়ে এসে একদল ঘাতক সেনাচক্র ব্রাশ ফায়ার ও বেয়নেট চার্জ করে অত্যন্ত পৈশাচিকভাবে তাঁদের হত্যা করে। স্বজনদের কর্তৃক বনানী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম-কে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম, সর্বোপরি তাঁর অনুপস্থিতিতে মহান মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র : এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, বাংলা একাডেমী ২০১২; হারুন-অর-রশিদ, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড ২০১৮ (৪র্থ মুদ্রণ); জাতীয় চার নেতা স্মারকগ্রন্থ, চাতীয় চার নেতা পরিষদ ১৯৯৯
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড