বীর প্রতীক সৈয়দ রেজওয়ান আলী
সৈয়দ রেজওয়ান আলী, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪৬) বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিমান বাহিনীর সৈনিক। তিনি ১৯৪৬ সালের ২রা ডিসেম্বর বর্তমান নড়াইল জেলার লোহাগড়া থানার নওগামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ হাশেম আলী এবং মাতার নাম সৈয়দা সাজেদা বেগম। তিনি তাঁর গ্রামের পার্শ্ববর্তী এল এ জে এন ইনস্টিটিউ (সাবেক শত্রা হাজারি হাইস্কুল) থেকে ১৯৬৫ সালে এসএসসি পাস করেন। ছাত্রজীবন থেকে তিনি সাহসী ও স্বাধীনচেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
সৈয়দ রেজওয়ান আলী ১৯৬৫ সালে করপোরাল হিসেবে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। বিমান বাহিনীতে যোগদানের পর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে একাধিক প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। ১৯৭১ সালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের পেশোয়ার বিমান ঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। মার্চে পাকবাহিনী বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করলে এবং ক্রমে দেশের অধিকাংশ স্থানে তাদের দখল প্রতিষ্ঠা করলে তিনি দেশকে শত্রুমুক্ত করার যুদ্ধে অংশ নিতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে তিনি যুদ্ধে যোগ দেয়ার নানা উপায় অন্বেষণ করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত ১৩ই মে তিনি ভারতে আসতে সক্ষম হন এবং ৮ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। তাঁকে এ সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরে ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদার অধীনে নিয়োগ দেয়া হয়। পরে তাঁকে ব্র্যাভো কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। বৃহত্তর ফরিদপুর এ কোম্পানির আওতাধীন ছিল। তাঁর আওতাধীন এলাকায় পাকসেনা ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে তিনি বিভিন্ন যুদ্ধ ও আক্রমণ পরিচালনা করেন। সেপ্টেম্বর মাসে তাঁকে যশোরের চৌগাছা থানার চুড়ামনকাঠির পার্শ্ববর্তী সালুয়া ব্রিজ ধ্বংস করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি তাঁর দল নিয়ে এ ব্রিজ ধ্বংস করার অপারেশন সফল করেন। কিন্তু ফেরার পথে তাঁরা পাকসেনাদের দ্বারা আক্রান্ত হন। তখন পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে বিমান বাহিনীর রইস উদ্দিন ও অন্য ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সৈয়দ রেজওয়ান আলী তাঁর সাহস ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে অন্য সহযোদ্ধাদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে ফিরে আসতে সক্ষম হন। ১৮ই ডিসেম্বর কাশিয়ানী থানার ভাটিয়াপাড়ায় অবস্থান নেয়া পাকসেনা ও রাজাকারদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে সৈয়দ রেজওয়ান আলী সাহসী ভূমিকা পালন করেন। পাকসেনারা সিভিলিয়ানদের কাছে আত্মসমর্পণের আহ্বান অমান্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। এ-সময় তাদের গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা কমল সিদ্দিকী মারাত্মকভাবে আহত হন। তাঁকে দ্রুত হেলিকপ্টারের মাধ্যমে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। এদিকে পাকসেনারা কোনো সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে নতি স্বীকার করবে বলে অঙ্গীকার ও সাদা পতাকা প্রদর্শন করে। এ অবস্থায় ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার অনুমতি নিয়ে সৈয়দ রেজওয়ান আলী পাকসেনাদের ক্যাম্পে গিয়ে তাদের আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন। তাঁর কাছে তারা আত্মসমর্পণ করে। তাদের এ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে কাশিয়ানী থানা হানাদারমুক্ত হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার সৈয়দ রেজওয়ান আলীকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৮৭ সালে তিনি মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার হিসেবে বিমান বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ১ কন্যা ও ৩ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম সৈয়দা রোকেয়া আক্তার। [জালাল আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড