You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর প্রতীক সেতারা বেগম

সেতারা বেগম, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪৫) বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ২নং সেক্টরের অধীনে পরিচালিত মেলাঘরে অবস্থিত বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল-এর কমান্ডিং অফিসার। তিনি ১৯৪৫ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর তাঁর পিতার কর্মস্থল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের কান্দাইল গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ ইসরাইল এবং মাতার নাম হাকিমুন্নেছা বেগম। তাঁর পিতা ছিলেন ব্রিটিশ ও পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা (ডিএসপি)। অবসর গ্রহণের পর তিনি আইন ব্যবসায় নিয়োজিত হন। ৩ বোন ও ২ ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তাঁর ডাক নাম সিতু৷
সেতারা বেগম প্রথম শ্রেণি থেকে মেট্রিক (এসএসসি) পর্যন্ত পড়ালেখা করেন কিশোরগঞ্জ শহরে। ১৯৬০ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ শহরের সরজু বিদ্যানিকেতন থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিক এবং ১৯৬২ সালে ঢাকার হলিক্রস কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ইন্টারমিডিয়েট (এইচএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে। এরপর তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৬৯ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।
স্কুল-কলেজে পড়াশুনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধুলায়ও সেতারা বেগম কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ছাত্রজীবনে গার্লস গাইডের টিম লিডার ছিলেন। ব্যাডমিন্টন ও টেবিল টেনিস খেলায় তিনি খুবই পারদর্শী ছিলেন। তিনি নাটকের অভিনয়েও পারদর্শী ছিলেন। মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নশিপ শেষ করে সুশৃঙ্খল জীবনের প্রতি আকর্ষণ এবং বড়ভাই ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার, বীর উত্তমএর অনুপ্রেরণায় ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে তিনি পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর আর্মি মেডিকেল কোরে যোগ দেন। ট্রেনিং শেষে কমিশনপ্রাপ্ত হলে লেফটেন্যান্ট পদে তাঁর পোস্টিং হয় কুমিল্লা সেনানিবাসের কম্বাইন্ড মিলিটারি হসপিটালে (CMH)। উল্লেখ্য যে, একই সময়ে তাঁর বড়ভাই ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দারও কুমিল্লা সেনানিবাসে ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়নে কর্মরত ছিলেন।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেতারা বেগম ও তাঁর ভাই এ টি এম হায়দার ঈদের ছুটিতে কিশোরগঞ্জ আসেন। বড়ভাই ছুটি শেষে কুমিল্লা সেনানিবাসে যোগদান করলেও তিনি ছুটির শেষের দিকে ঢাকা এসে তাঁর বড় বোনের বাসায় অবস্থান করেন। এরই মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলে এর বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দেশে চলে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন; পূর্ব বাংলার বেসামরিক সরকার সম্পূর্ণভাবে বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর আহ্বান ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’ সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য ও সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে তীব্র জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলে। পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে পড়বে ভেবে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন সেনানিবাসে বাঙালি সৈনিক ও অফিসারদের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। এমনি পরিস্থিতিতে একদিন লেফটেন্যান্ট সেতারা বেগম কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে একটি টেলিফোন কল পান। তাতে অজ্ঞাতপরিচিত একজন বলেন, ‘ম্যাডাম আপনি জয়েন করবেন না, জয়েন করলে বিপদ হতে পারে।’ এ কথা বড়ভাই হায়দারকে জানালে তিনিও ডা. সেতারাকে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে বারণ করেন। ছুটি শেষে কাজে যোগদান না করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ জেনেও ডা. সেতারা কুমিল্লায় না গিয়ে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জে চলে যান।
অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে বাঙালি সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার প্রথম কয়েক মাস ডা. সেতারা বেগম পরিবারের লোকজনের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেড়ান এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ খুঁজতে থাকেন। আগস্ট মাসে দুজন মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে তাঁর বড়ভাই ক্যাপ্টেন হায়দার তাঁকে একটি চিঠি ও একটি পিস্তল ও একটি গ্রেনেড পাঠান। ঐ চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘১টি পিস্তল ও ১টি গ্রেনেড সঙ্গে পাঠালাম, এ দুটো সঙ্গে রাখবি, যদি কোথাও ধরা পরিস সঙ্গে সঙ্গে সুইসাইড করিস। বড় ভাইয়ের নির্দেশমতো তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ২নং সেক্টরের সদর দপ্তর ভারতের মেলাঘরে পৌছে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। উল্লেখ্য, তখন তাঁর বড়ভাই ক্যাপ্টেন হায়দার ছিলেন ২নং সেক্টরের সহ-অধিনায়ক।
মেলাঘর পৌঁছে লেফটেন্যান্ট সেতারা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধকালে ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তমএর উদ্যোগে এবং ডা. ক্যাপ্টেন আক্তার আহমেদ, বীর প্রতীকএর সার্বিক তত্ত্বাবধানে মেলাঘরের নিকটবর্তী মতিনগরে ক্ষুদ্র পরিসরে এ হাসপাতালটি স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে নিরাপত্তার কারণে বড় পরিসরে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একটু দূরে আগরতলার নিকটবর্তী পাহাড়ি এলাকা বিশ্রামগঞ্জে এটি স্থানান্তর করা হয়। বাঁশ, কাঠ ও শন দিয়ে তৈরি করা হয় ২০০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতাল। ছোট বাঁশের খুঁটির ওপর মাচা বেঁধে তৈরি করা হয় রোগীর বিছানা। এখানে ছোট একটি অপারেশন থিয়েটারও ছিল, তবে সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎ না থাকার জন্য কাজ চালাতে হতো হেরিকেন ও টর্চলাইট জ্বালিয়ে। লেফটেন্যান্ট ডা. সেতারার পরিশ্রম, পরিকল্পনা ও পরিচালনায় হাসপাতালটি একটি অনন্য সামরিক হাসপাতালে পরিণত হয়। শুধু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারাই নন, সাধারণ জনগণও এ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে আসত।
লেফটেন্যান্ট ডা. সেতারা বেগম বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের দায়িত্ব নেবার পর এটি সামরিক কায়দায় পরিচালিত হতে থাকে। সেতারা বেগম ছাড়াও আরো কয়েকজন বাংলাদেশী ডাক্তার, বেগম সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে সুলতানা কামাল ও সাঈদা কামাল এবং বাংলাদেশ থেকে আগত বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী এ হাসপাতালে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। চিকিৎসা সেবা দেয়া ছাড়াও প্রায়ই সেতারা বেগমকে ঔষধ ও প্রয়োজনীয় ডাক্তারি সরঞ্জামাদি আনতে আগরতলা যেতে হতো। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও দক্ষ পরিচালনায় বিপুল সংখ্যক আহত মুক্তিযোদ্ধা ও ভারাতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যকে সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব হয়। তাঁর আন্তরিক চিকিৎসা সেবা ও কঠোর পরিশ্রমের ফলে মুক্তিযোদ্ধারা সুস্থ হয়ে মনোবল ফিরে পান এবং পুনরায় যুদ্ধের ময়দানে যোগ দেন।
মুক্তযুদ্ধ শেষ হবার কিছুদিন পূর্বে ডা. সেতারা বেগম ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি পান। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি তাঁর ইউনিট কুমিল্লা সিএমএইচ-এ যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসা সেবায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। উল্লেখ্য, তাঁর পুরো পরিবারই মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদান রাখে। তাঁর বড়ভাই ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার ২নং সেক্টরের সাব-কমান্ডার (পরবর্তীতে কমান্ডার) ছিলেন, তাঁর আর এক ভাই এ টি এম সফদারও একজন কৃতী মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর স্বামী ক্যাপ্টেন ডা. আবিদুর রহমানও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অসামান্য অবদান রাখেন। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে তাঁর স্বামী সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ক্যাপ্টেন সেতারাও ১৯৭৩ সালের ১৬ই ডিসেম্ভaved|বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এ বীর মুক্তিযোদ্ধা দম্পতির ১ কন্যা ও ২ পুত্র সন্তান রয়েছে। [সাজাহান মিয়া]

তথ্যসূত্র: সামরিক চিকিৎসা সার্ভিসেস মহাপরিচালক (সম্পা.), স্বাধীনতাযুদ্ধে আর্মি মেডিক্যাল কোর, এএমসি সেন্টার এন্ড স্কুল, ২০১০

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!