শরণার্থীদের দুর্বিষহ জীবন নিয়ে রচিত বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’
সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের দুর্বিষহ জীবন নিয়ে রচিত একটি বিখ্যাত কবিতা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি ব্যতিক্রমধর্মী ও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর রচয়িতা মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ (১৯২৬- ১৯৯৭) ছিলেন নিপীড়িত মানবতার পক্ষে এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, সামরিকতন্ত্র ও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি কবিতা লিখেছেন, আমেরিকার রাস্তায়-রাস্তায় মানবমুক্তির গান গেয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত তাঁর এ কবিতাটিও তেমনি এক প্রতিবাদী রচনা, নিপীড়িত মানবতার পক্ষে এক শাণিত অস্ত্র। তরুণ বাঙালি কবি খান মোহাম্মদ ফারাবী (১৯৫২-১৯৭৪) অনূদিত সুদীর্ঘ কবিতাটি এরূপ-
শত শত চোখ আকাশটা দেখে
শত শত শত মানুষের দল
যশোর রোডের দু-ধারে বসত
বাঁশের ছাউনি, কাদামাটি জল
কাদামাটি মাখা মানুষের দল
গাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখে
আকাশে বসত মরা ঈশ্বর
নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে
যুদ্ধে ছিন্ন ঘরবাড়ি দেশ
মাথার ভিতরে বোমারু বিমান
এই কালো রাত কবে হবে শেষ
শত শত মুখ হায় একাত্তর
যশোর রোড যে কত কথা বলে
এত মরা মুখ আধ মরা পায়ে
পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে
সময় চলেছে রাজপথ ধরে
যশোর রোডেতে মানুষ মিছিল
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর
গরুগাড়ি কাদা রাস্তা পিছিল
লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে
লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়
ঘরহীন ভাসে শত শত লোক
লক্ষ জননী পাগলের প্রায়
রিফিউজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু
পেটগুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠে
এইটুকু শিশু এতবড় চোখ
দিশেহারা মা কার কাছে ছোটে
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর
এতো এতো শুধু মানুষের মুখ
যুদ্ধ মৃত্যু তবুও স্বপ্ন
ফসলের মাঠে ফেলে আসা সুখ
কার কাছে বলি ভাত রুটি কথা
কাকে বলি কর কর কর ত্রাণ
কাকে বলি ওগো মৃত্যু থামাও
মরে যাওয়া বুকে এনে দাও
প্রাণ কাঁদো কাঁদো তুমি মানুষের দল
তোমার শরীর ক্ষত দিয়ে ঢাকা
জননীর কোলে আধপেটা শিশু
এ কেমন বাঁচা, বেঁচে মরে থাকা
ছোট ছোট তুমি মানুষের দল
তোমার ঘরেও মৃত্যুর ছায়া
গুলিতে ছিন্ন দেহ-মন-মাটি
ঘর ছেড়েছো তো মাটি মিছে মায়া
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর
ঘর ভেঙ্গে গেছে যুদ্ধের ঝড়ে
যশোর রোডের দু’ধারে মানুষ
এত এত লোক শুধু কেন মরে
শত শত চোখ আকাশটা দেখে
শত শত শত শিশু মরে গেল
যশোর রোডের যুদ্ধক্ষেত্রে
ছেঁড়া সংসার সব এলোমেলো
কাদামাটি মাখা মানুষের দল
গাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখে
আকাশে বসত মরা ঈশ্বর
নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে
যুদ্ধে ছিন্ন ঘর-বাড়ী-দেশ
মাথার ভিতরে বোমারু বিমান
এই কালো রাত কবে হবে শেষ
শত শত মুখ হায় একাত্তর
যশোর রোড যে কত কথা বলে
এত মরা মুখ আধ মরা পায়ে
পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে
এত মরা মুখ আধ মরা পায়ে
পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে
কবিতাটিতে বিপন্ন মানবতার যে করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে, তা তখন বিশ্বময় প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, পাক-মার্কিন অবস্থানের বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিল। তাই কবিতাটি তখন মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিশ্ব- জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কবিতাটির এ গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা মনে রেখে উত্তরকালে অ্যালেন গিন্সবার্গ তাঁর দ্য ফল অব আমেরিকা (১৯৮৭) কাব্যগ্রন্থে এটি অন্তর্ভুক্ত করেন। কবিতাটি সম্পর্কে বিখ্যাত ডিলান পত্রিকায় তিনি লেখেন, “আমার ইচ্ছা ছিল, বব ডিলানকে চমকে দিয়ে একটা গান লিখব। অনেকটা উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের ‘স্যান্ড অ্যাইড লেডি অব দ্য লো ল্যান্ডস’-এর মতো লম্বা কোনো গান, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর মানবিক আকুতি জাগাবে, যা ডিলানকে ভাবাবে, কাঁদাবে। আমি তা-ই লিখতে চেষ্টা করলাম। সম্প্রতি কলকাতা ঘুরে লাখ-লাখ মানুষের সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট দেখে আমার যে অনুভূতি তৈরি হয়েছে, তা-ই লিখলাম। কলকাতার ভাষা আর সংগীতের মিশ্রণে সেটাকে গানে রূপ দিলাম ভারতীয় হারমোনিয়াম সহযোগে। সে-সময়ে দেখা মানুষগুলোর অন্তহীন যাতনা আমাকে নির্বাক করেছিল। সব বয়সের মানুষের বেঁচে থাকার কষ্ট আমার বুকে চেপে বসেছিল। সেই যাতনা হৃদয়ে নিয়েই আমি লিখেছিলাম ‘যশোর রোড’ কবিতা। আমি মূলত ভারতীয় বজ্রগুরু বৌদ্ধ সুরের সঙ্গে ‘ব্ল্যাক’-এর পাওয়া ‘ওয়ান অ্যানাদারস সরো’র অন্ত্যমিলের সমন্বয়ে ‘যশোর রোড’ গাওয়ার চেষ্টা করলাম।”
অ্যালেন গিন্সবার্গ তখন ভারতে এসেছিলেন কলকাতায় আশ্রয় নেয়া পূর্ববাংলার শরণার্থীদের দুঃখ-কষ্ট-দুর্ভোগ সরেজমিনে দেখে একটি প্রতিবেদন রচনা করার জন্য। তিনি কলকাতা আসেন সেপ্টেম্বর মাসে, আর নিউইয়র্ক ফিরে যান মধ্য-নভেম্বরে। কলকাতায় তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন বিবিসি-র রিপোর্টার গীতা মেহতা। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে গিন্সবার্গ কলকাতার পার্শ্ববর্তী শরণার্থী শিবিরগুলোয় ঘুরেছেন। শিবিরগুলাতে লাখ-লাখ মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করছিল। পানি নেই, খাদ্য নেই, ওষুধ নেই এসব দেখে গিন্সবার্গ ভীষণভাবে মর্মাহত হন। দুঃসহ এ স্মৃতি এবং মানুষের এ অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট বিশ্ব-মানুষের গোচরে আনার জন্যই আমেরিকা গিয়ে তিনি রচনা করেন তাঁর ঐতিহাসিক কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’।
অ্যালেন গিন্সবার্গ ছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঘোর বিরোধী। আমেরিকায় বসেই তিনি আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী মুখোশ খুলে দিতে চেয়েছিলেন তাঁর কবিতা ও গানের মাধ্যমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, অস্ত্র সরবরাহ করেছে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে, জাতিসংঘকে প্রভাবিত করতে চেয়েছে বাংলাদেশের অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য। মার্কিনি এসব অপকর্ম ও ষড়যন্ত্র গিন্সবার্গকে গভীরভাবে মর্মাহত করে। তিনি এর প্রতিবাদে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি লিখে নিউইয়র্কে কবিতা পাঠের এক আসরে আবৃত্তি করেন। কবিতাটিতে সুর সংযোজন করে তিনি আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় গেয়ে-গেয়ে শোনান যশোর রোডে দেখা তাঁর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা। তিনি আর নেই, কিন্তু আছে তাঁর কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। এ কবিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তিনি একাত্ম হয়ে আছেন। [বিশ্বজিৎ ঘোষ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড