সৈদালী গণহত্যা (মিরসরাই, চট্টগ্রাম)
সৈদালী গণহত্যা (মিরসরাই, চট্টগ্রাম) সংঘটিত হয় ২০শে এপ্রিল। এতে ২৩ জন গ্রামবাসী নির্মম হত্যার শিকার হয়।
১৯৭১ সালের ২০শে এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় রাজাকার-আলবদররা চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের মায়ানী ইউনিয়নের সৈদালী গ্রামে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চালায়। হানাদাররা বিকেল ৩টা থেকে ৮টা পর্যন্ত গ্রামে ঢুকে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে। এ সময় গ্রামের অনেককেই গুলি করে এবং আগুনে পুড়িয়ে মারে। পাকিস্তানি সেনারা অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে পুরো গ্রামকে বিরান ভূমিতে পরিণত করে। গ্রামের দুই গৃহবধূ ধর্ষিত ও অসংখ্য নারী-শিশু নির্যাতনের শিকার হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, ১৯৭১ সালের ২০শে এপ্রিল চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিশাল সাঁজোয়া গাড়ি বহরের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (তৎকালীন ট্রাংকরোড) সংলগ্ন বড়তাকিয়া বাজার অতিক্রম করার খবর পেয়ে কর্নেল অলি আহমদ নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় ফেনাফুনি পুলের নিচে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এদিন সকাল ১১টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়িবহর বড়তাকিয়া বাজার অতিক্রম করার সময় গোপন অবস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায়। থেমে-থেমে বিকেল আড়াইটা পর্যন্ত প্রতিরোধযুদ্ধ চলে। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হন। যুদ্ধে শহীদ হন হাবিলদার সিদ্দিক ও ল্যান্স নায়েক আবুল কালাম। এ ভয়াবহ প্রতিরোধযুদ্ধে দুশ থেকে আড়াইশ পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের বহনকারী সম্মুখভাগে থাকা ১০-১২টি গাড়ি। পরে বিকেল ৩টার দিকে ক্ষুদ্ধ হানাদার বাহিনী প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে বড়তাকিয়া বাজারের পশ্চিম পাশের চারটি সড়ক দিয়ে পুনরায় সৈদালী গ্রামে প্রবেশ করে। সেখানে তারা ঘরে ঘরে গণহত্যা ও নারকীয় তাণ্ডব চালায়। চলে লুটপাট আর অগ্নিসংযোগ। পুড়িয়ে দেয়া হয় শতাধিক ঘর-বাড়ি। সেদিনের ভয়াবহ গণহত্যায় ২৩ জন গ্রামবাসী নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়, যার মধ্যে ২২ জনকে গ্রামের ভূঁইয়া পুকুরপাড়, লাতু পুকুরপাড়সহ বিভিন্ন স্থানে গণকবরে সমাহিত করা হয়। একজনের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
২০শে এপ্রিল সৈদালী গ্রামে গণহত্যায় যাঁরা শহীদ হন, তারা হলেন— মোখলেছুর রহমান (পিতা হামিদ উল্লা), আবুল কালাম হোরা মিয়া (পিতা মতিউর রহমান), আমীর হোসেন (পিতা আব্দুর রশিদ), খোরশেদ আলম (পিতা আব্দুর রাজ্জাক), মকছুদ আহম্মদ (পিতা নুরুল হক নুনু), নজির আহম্মদ (পিতা জিন্নাত আলী মিস্ত্রি), সুলতান আহম্মদ (পিতা জিন্নাত আলী মিস্ত্রি), কবীর উদ্দিন (পিতা আব্দুল হক মাস্টার), শেখ আহম্মদ (পিতা মোকাররম আলী), আব্দুল খালেক (পিতা আব্দুল গণি), জোবায়দা খাতুন (পিতা আব্দুল জব্বার), তমিজ উদ্দিন (পিতা আব্দুল লতিফ), হাকীম বক্স (পিতা কেরামত আলী), বেনন আলী (পিতা মোহাম্মদ ইসমাইল মিয়া), জায়দ আলী (পিতা আব্দুল জব্বার), সামসুল আলম (পিতা আহম্মদুর রহমান ভূঁইয়া), নুরুল আলম (পিতা আহম্মদুর রহমান ভূঁইয়া), ফকির আহম্মদ (পিতা আনোয়ার হোসেন), রহীম বক্স (পিতা আব্দুল লতিফ), আব্দুর রশিদ (পিতা বদিউর রহমান), মফিজুর রহমান (পিতা মোকলেছুর রহমান মিস্ত্রী), হোসেনের জামান (পিতা খলিলের রহমান মৌলভী), মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমান (পিতা দলিলের রহমান)। [জগন্নাথ বড়ুয়া ও চৌধুরী শহীদ কাদের]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড