You dont have javascript enabled! Please enable it! সুলতানপুর নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

সুলতানপুর নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর)

সুলতানপুর নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর) ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের নয় মসে এখানে বহু মানুষকে নির্যাতন, হত্যা ও অনেক নারীকে ধর্ষণ করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে কুমিল্লা- সিলেট মহাসড়কের পাশে সুলতানপুর গ্রামটি অবস্থিত। সুলতানপুর হাইস্কুল এবং ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় নয় মাস ধরেই এখানে নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনা ঘটে।
১৪ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে সড়কপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে এগিয়ে এসে সুলতানপুর পর্যন্ত পৌঁছায় এবং মহাসড়কের দুপাশে অবস্থান নেয়। পরদিন ১৫ই এপ্রিল তারা সুলতানপুরের পূর্ব ও উত্তর পাড়ায় আক্রমণ চালায় এবং বাড়িঘরে আগুন দেয়। মুসলিম লীগ-এর স্থানীয় দালালরা গ্রামের হিন্দু বাড়িগুলো চিনিয়ে দেয়। তখনো পর্যন্ত এলাকায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়নি। গ্রামের অধিকাংশ হিন্দু পরিবার পাকিস্তানি বাহিনীর আগমনের খবর পেয়েই সবকিছু ফেলে ভারতে পালিয়ে যায়। অনেকের সঙ্গে গ্রামের জয়কুমার মাস্টারও ছেলেমেয়ে নিয়ে ভারতে চলে যান। কিন্তু তাঁর মাকে শত চেষ্টা করেও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি। বৃদ্ধা বিধবা মোহনবাঁশী কাপালী চৌদ্দপুরুষের জন্মভিটা ছেড়ে যেতে রাজি হননি। তিনি বাড়িতেই থেকে যান।
১৫ই এপ্রিল সকাল থেকে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে আগুন লাগাতে শুরু করে। মোহনবাঁশী তার ঘরে আগুন লাগাতে বাধা দেন। পাকিস্তানি বাহিনী তাকে ধাক্কা দিয়ে একটি গর্তে ফেলে দেয়। বিমান হামলা থেকে আত্মরক্ষার জন্য জয়কুমার মাস্টার এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বাংকার হিসেবে এ গর্তটি খনন করেছিলেন। গর্ত থেকে উঠে আসার জন্য মোহনবাঁশী প্রাণপণ চেষ্টা করেন। কিন্তু উঠতে পারেননি। হানাদাররা আগুন লাগানো একটি খড়ের ঘর গর্তের ওপর ফেলে দেয়। বৃদ্ধার সারা শরীরে আগুন ধরে যায়। তিনি বাঁচার জন্য আর্ত চিৎকার করতে থাকেন। কিন্তু তাকে কেউ বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। বরং বাঁশ দিয়ে তাকে গর্তের মধ্যে চেপে ধরা হয়। এভাবে পুড়িয়ে মারা হয় বৃদ্ধা মোহনবাঁশী কাপালীকে সুলতানপুরে পাকিস্তানি বাহিনী স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। মে মাসের মধ্যে রাজাকার বাহিনীও গঠন করা হয়। তারপর স্থানীয় রাজাকার ও দালালদের সহায়তায় এখানে চরম নির্যাতন ও গণহত্যা চালানো হয়। এখানকার পাকিস্তানি আর্মিদের ৩ জন ছিল মোয়াজ্জম খান, শাহজাদা খান ও মিলন খান।
সুলতানপুর ও তার আশপাশ এলাকায় ভয়াবহ নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনা ঘটে। এলাকার রাজাকাররা হিন্দু বাড়িগুলো লুট করে। বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবতী মেয়েদের ধরে এনে ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করে। দিনের পর দিন নির্যাতন শেষে তাদের হত্যা করা হয়। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে বর্ষাকালে একদিন সিঙ্গারবিল এলাকা থেকে ৩৭ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে ধরে এনে রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। এ দলে সেদিন ১৬ জন যুবতী, ১৪ জন শিশু-কিশোর এবং ৭ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছিলেন। এরা সকলেই হিন্দু সাহা সম্প্রদায়ের লোক। পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়ে ঢাকা জেলা থেকে পালিয়ে এসে নৌকাযোগে আগরতলায় চলে যাবার পথে তারা রাজাকার বাহিনীর হাতে ধরে পড়ে। সুলতানপুর ক্যাম্পে তাদের করুণ পরিণতি এলাকাবাসী প্রত্যক্ষ করে। এ দলের যুবতীদের একটি ঘরে আটকে রেখে পর্যায়ক্রমে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতিতা মহিলারা জানালা দিয়ে এলাকাবাসীর সহযোগিতা চায়। তাদের রক্তাক্ত করুণ চেহারা দেখেও হানাদার বাহিনীর ভয়ে কেউ এগিয়ে যেতে সাহস পায়নি। কয়েক দিন ক্রমাগত নির্যাতনের পর এ দলের সকলকেই হত্যা করে বন্যার পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
সুলতানপুরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম উড়শিউড়ার সরদার বাদশা মিয়া মুক্তিবাহিনী এবং শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্য দিয়ে সহযোগিতা কররতন। স্থানীয় রাজাকাররা এ খবর পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়। বাদশা মিয়াকে ধরে নিয়ে তারা সুলতানপুর ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। কয়েক দিন পর দুটি শর্তে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। শর্তদুটি হলো— গ্রামে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানের পক্ষে তৎপরতা চালাতে হবে এবং তার দুই ছেলের মধ্যে একজনকে পাকিস্তানি বাহিনীর জিম্মায় ক্যাম্পে বন্দি রাখতে হবে। বাদশা মিয়া শর্তদুটি মেনে বাড়ি যান। পরে অবশ্য সরদারের ভাতিজা হুমায়ূন স্বেচ্ছায় পাকিস্থানি বাহিনীর জিম্মায় যায় এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। ওখানে শাহপুর, আড়াইবাড়ি এবং সুলতানপুর এলাকার ২৩ জন রাজাকার ছিল। উড়শিউরা গ্রামের হাদিস ও আমির হোসেনকেও হুমায়ূনের মতো বাধ্য হয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল।
২৪শে অক্টোবর সকালে একজন জেলেকে মাঠ থেকে ধরে এনে ক্যাম্পের পাশে হত্যা করা হয়। ২৬শে অক্টোবর ভোরে অসংখ্য নর-নারী ও শিশুর আর্তচিৎকারে সবার ঘুম ভেঙে যায়। হাদিস ও হুমায়ূন ক্যাম্পের পাশে মাঠে গিয়ে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে। তারা দেখে, হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোক মাঠে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে আর বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। প্রায় অর্ধনগ্ন দুজন নারীর রক্তাক্ত লাশ মাঠে পড়ে আছে। ধর্ষণকারীরা তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এদিন রাতেই তারা ভারতে যাবার সময় উজানিসার তিতাস ব্রিজের কাছে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। জনৈক শামসু মিয়া নবীনগরের নাটঘরে তাদের প্রায় এক মাস লুকিয়ে রেখেছিল। ২৫শে অক্টোর যাত্রাপথ অনেকটা নিরাপদ মনে করে তারা নৌকাযোগে রওনা দেয়। কিন্তু ঐদিন রাতেই তারা উজানিসার ব্রিজ পার হবার সময় ধরা পড়ে। এ দলে ২২ জন মহিলা, ২৭ জন পুরুষ ও শিশুসহ মোট ৪৯ জন যাত্রী ছিল। তাদের বাড়ি নরসিংদী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জে। উজানিসার ব্রিজ থেকে গাড়িতে করে তাদের সুলতানপুর ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। গাড়িতে এবং গাড়ি থেকে নামিয়ে সুলতানপুর ক্যাম্পের সামনের মাঠে নরপশুরা মহিলাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করে। তাদের নির্যাতনে দুজন মহিলা ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বাকি ২০ জন মহিলাকে সুলতানপুর স্কুলের অফিস কক্ষে এবং ২৭ জন পুরুষ ও শিশুকে পাশের একটি কক্ষে বন্দি করে রাখা হয়। ঘটনার খবর পেয়ে পাঞ্জাবি মেজর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে গিয়ে সুলতানপুর ক্যাম্প পরিদর্শন করে।
মহিলা কক্ষে খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব ছিল হুমায়ূনের। ২৭শে অক্টোবর বেলা ১টার দিকে খাবার নিয়ে সে মহিলা কক্ষে যায়। তখন প্রমিলা নমে এক যুবতী তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমরা খাবার চাই না, আমাদেরকে বাঁচাও!’ এ ক্যাম্পে বন্দি ছিল প্রমিলার মা-বাবা, ছোট ভাই-বোনসহ একই পরিবারের ৫ জন। তাদের বাড়ি ঢাকার ধানমন্ডিতে। ছোট ভাইয়ের বয়স ১৪ বছর। ১০ বছরের ছোট বোনটিও তাদের সঙ্গে ছিল। প্রমিলা এখান থেকে পালিয়ে যেতে হুমায়ূনের সাহায্য চায়।
২৮শে অক্টোবর দুপুরে হুমায়ূন খাবার নিয়ে গেলে প্রমিলা তাকে ঘরের এক কোণে নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, ‘আমাকে বাঁচাও, তোমাদের বাড়িতে নিয়ে চল৷ আমি মুসলমান হয়ে যাব। আমাকে রক্ষা করো।’ হুমায়ূনের কিশোর হৃদয়ে দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। সেও মুক্তির প্রতীক্ষায় প্রহর গুণতে থাকে।
২৯শে অক্টোবর রাতে পুনরায় নারীনির্যাতন শুরু হয়। হানাদাররা অসহায় নারীদের ওপর প্রচণ্ড হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুটি কক্ষ থেকে ভেসে আসে অবিরাম চিৎকার। প্রায় ঘণ্টাকাল ধরে চলে অমানবিক নির্যাতন। তারপর ধর্ষিতাদের অসহায় কান্না, গোঙানি আর দীর্ঘশ্বাসে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে৷
৩০শে অক্টোবর রাতে পাঁচজন যুবতীকে ঘর থেকে বের করে ক্যাম্পের পাশে বাঁশঝাড়ঘেরা একটি নির্জন বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা মহিলাদের ওপর উন্মত্তের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। নির্যাতনের এক পর্যায়ে নরপশুরা পাগলা কুকুরের ন্যায় যুবতীদের সারা শরীর কামড়িয়ে ক্ষত- বিক্ষত করে দেয়। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সবাই অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সকাল নাগাদ তিনজন মারা যায়। বাকি দুজনকে ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনা হয়। হুমায়ূন ক্যাম্প থেকে এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে। সারারাত সে ঘুমাতে পারেনি। পরদিন সে তার পরিকল্পনার কথা গ্রামের সঙ্গী আমির হোসেনকে জানায়। তারা দুজনে মিলে পরিকল্পনা করে, একটু সুযোগ পেলেই বন্দিদের বাঁচাবার চেষ্টা করবে। সবাইকে না পারলেও অন্তত প্রমিলাকে বাঁচাবেই। কিন্তু তাদের কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
৩১শে অক্টোবর মধ্যরাতে বন্দিশিবিরের পুরুষ কক্ষ থেকে ২৭ জনকে বের করে নিয়ে স্কুলঘরের পূর্বদিকে একটি নির্জন স্থানে লাইন করে দাঁড় করানো হয়। সেখানে পূর্ব থেকেই দুটি গর্ত খনন করা ছিল। গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর কথা ভেবেও কেউ হানাদারদের কাছে অনুনয়-বিনয় করেনি। কারণ তারা জানত পাষণ্ডদের কাছে অনুনয়-বিনয় করে কোনো লাভ হবে না। তাই সকলে সৃষ্টিকর্তার নাম জপতে থাকে। শিশুরা কান্নায় ভেঙে পড়ে। এরপর পাকিস্তানি অফিসারের নির্দেশে স্থানীয় রাজাকার দুলা মিয়া একের পর এক গুলি করে সবাইকে হত্যা করে। গুলির আওয়াজ আর মানুষের আর্তচিৎকারে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। আশপাশের বাড়ির লোকজন ভয়ে নিজ-নিজ ঘরে জড়সড় হয়ে থাকে। হত্যাকাণ্ডের এক পর্যায়ে দুলা মিয়া যখন ১৪ বছরের কিশোর প্রমিলার ভাইকে গুলি করতে উদ্যত হয়, তখন সে তার গায়ের জামাটি খুলে রেখে কম্পিত কণ্ঠে বলে, ‘এটি আমার বোনের কাছে পাঠিয়ে দিও, সে যেন তার লজ্জা ঢাকতে পারে।’ সঙ্গে-সঙ্গে রাজাকারের গুলিতে কিশোরের লাশ গর্তে লুটিয়ে পড়ে। গর্তদুটির অদূরে কয়েকটি কলাগাছের ফাঁকে দাঁড়িয়ে হাদিস ও হুমায়ূন এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। গর্তের পাশে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈনিক উপস্থিত ছিল। একে-একে ২৭ জনকে হত্যা করে এখানে মাটিচাপা দেয়া হয়। রক্তের বন্যায় এলাকাটি ভেসে যায়।
৩১শে অক্টোবর মধ্যরাতে ক্যাম্পের ২৭ জনকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়ার পর শেষরাতে পাকিস্তানিরা রোজা রাখার জন্য সেহরি খায়। এর কিছুক্ষণ পর দল বেঁধে তারা মহিলাদের কক্ষে গিয়ে গণধর্ষণ শুরু করে। অসহায় মহিলাদের আর্তচিৎকার আর মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি একাকার হয়ে যায়।
এদিকে কক্ষে আটক আরো দুজন মহিলা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মারা যায়। এরই মধ্যে আরো কয়েকজন মহিলাকে পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে ধরে এনে এখানে বন্দি করে রাখা হয়। এ অবস্থা দেখে হুমায়ূন মনে-মনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও এখান থেকে যদি একজন মহিলাকেও বাঁচানো যায় তবে সে তার জীবন সার্থক বলে মনে করবে। এরূপ সিদ্ধান্ত নিয়ে ২রা নভেম্বর হুমায়ূন খাবার নিয়ে মহিলাদের কক্ষে যায়। প্রমিলাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে তার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। রাত ১২টা থেকে তাকে প্রস্তুত থাকতে বলে। খাবার দেবার জন্যে কক্ষের একটি চাবি তার কাছেই থাকত। সুযোগ পেলেই দরজা খুলে সে তাদের নিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাবে। প্রমিলার মা কাতর কণ্ঠে হুমায়ূনকে বলে, ‘বাবা, আমার তো সবই গেল। ছেলে সন্তানসহ স্বামীকে হারালাম। এ মেয়েটিকে বাঁচাও। আমরা না হয় মরেই যাব। তবু বংশের একটা চিহ্ন থাকুক।’
সন্ধ্যার পর থেকে হুমায়ূনের অস্থিরতা বেড়ে যায়। শিবিরের চারপাশেই শত্রুরা ওঁৎ পেতে আছে। তবুও সুযোগের সন্ধানে অস্থির এবং সজাগ দৃষ্টিতে পায়চারি করতে থাকে হুমায়ূন। চোখে প্রমিলার রক্তাক্ত অসহায় চেহারা ভেসে উঠছে। হঠাৎ দেখতে পায় কয়েকটা গাড়ির হেডলাইট ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসছে। বিকট শব্দে গাড়িগুলোর হর্ন একসঙ্গে বেজে ওঠে। ক্যাম্পে অবস্থানরত কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকার গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। গাড়ি থেকে আরো পাকিস্তানি সৈন্য নেমে আসে। তাদের সঙ্গে একজন মেজর ছিল। অনেকগুলো বুটের আওয়াজ় ঠকঠক করে মহিলা কক্ষের সামনে গিয়ে থামে। মেজরের নির্দেশে মহিলাদের ঘর থেকে বের করে নিয়ে গাড়িতে তোলা হয়। হুমায়ূন বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে। প্রমিলাকে কখন গাড়িতে ওঠানো হয় তা সে বুঝতে পারেনি। একে-একে সকলকে গাড়িতে উঠিয়ে গাড়িগুলো চলে যায়। ঘণ্টাখানেক পরে দক্ষিণ দিক থেকে প্রচণ্ড গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। ধরে নিয়ে যাওয়া মহিলাদের ওখানে হত্যা করা হয়।
নভেম্বরের শেষদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সুলতানপুর ক্যাম্প ত্যাগ করে। এ-সময় ক্যাম্পে আটক আরো ১১ জনকে হত্যা করে পার্শ্ববর্তী গর্তে ফেলে রাখা হয়। তাদের মধ্যে ছিল হিন্দুদের কুমার সম্প্রদায়ের ৫ জন, শীল সম্প্রদায়ের ৪ জন এবং কায়স্থ সম্প্রদায়ের ২ জন পুরুষ। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকার। ভারতে পালিয়ে যাবার সময় এখানে আটক হয়েছিল।
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সুলতানপুরে ভয়াবহ নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এখানে নিহত প্রায় সকলেই দেশের বিভিন্ন এলাকার। তাই তাদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। [জয়দুল হোসেন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড