সূর্যদী গণহত্যা (শেরপুর সদর)
সূর্যদী গণহত্যা (শেরপুর সদর) সংঘটিত হয় ২৪শে নভেম্বর। এতে দুজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৬২ জন গ্রামবাসী প্রাণ হারান। স্থানীয় রাজাকার-দের সহায়তায় পাকবাহিনী এ নৃশংস গণহত্যা ঘটায়। এখানে হানাদাররা অনেক বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
সূর্যদী গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গোপন ঘাঁটি ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন অপারেশন শেষে মাঝে- মধ্যে এখানে আশ্রয় নিতেন। ২৪শে নভেম্বর স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী এ গ্রামে হানা দেয়। সকাল ৭টার দিকে কয়েকটি জিপ ও ট্রাকে পাকহানাদররা শেরপুর শহর থেকে তেঁতুলতলা বাজারে আসে। এখান থেকে ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে তারা মধ্য সূর্যদী, দক্ষিণ সূর্যদী ও গ্রামের বিশিষ্ট বাড়িগুলোতে আক্রমণ চালায়। গ্রামবাসীরা কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই তারা অতর্কিতে গুলি ছুড়তে থাকে। বিকট শব্দ আর ভাংচুরের ঘটনায় দিশেহারা গ্রামের সাধারণ মানুষ বাঁচার জন্য ঝোপ-জঙ্গল, ধানক্ষেত ও পানের বরজে আশ্রয় নেয়। পাকহানাদারদের গুলিতে যে যে-অবস্থায় ছিল সেভাবেই নিহত হয়। গ্রামের দেওয়ানবাড়ি, কিরসাবাড়ি ও বড়বাড়ির প্রতিটি ঘরে তারা অগ্নিসংযোগ করে। গ্রামের যুবক- কিশোরদের ধরে এনে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করার জন্য স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়া করায়। ঠিক এ-সময় নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সামনে এগিয়ে আসেন ৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা হলেন- এ গ্রামেরই বাসিন্দা গিয়াস কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব আলী সরু, আব্দুল খালেক, ফজলুর রহমান, হাবিবর, মমতাজ উদ্দিন ও আবুল। মাত্র ৪৫ রাউন্ড গুলি, ১টি এসএমজি আর কয়েকটি গ্রেনেড নিয়ে তাঁরা বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিছুক্ষণ পরে অন্য গ্রামে আত্মগোপন করে থাকা তাঁদের কোম্পানি কমান্ডার গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আরো দুটি দল এ প্রতিরোধে অংশ নেয়। ফলে হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
পাকবাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলিতে সূর্যদী গ্রামে সেদিন ২ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৬২ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। তাদের মধ্যে ৩৯ জনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- মুক্তিযোদ্ধা আক্তারুজ্জামান (পিতা আল মামুদ, সূর্যদী), মুক্তিযোদ্ধা আফছার উদ্দিন (পিতা সুমলি শেখ, খুনুয়া), আইজউদ্দিন মোল্লা (আন্ধারিয়া বানিয়া পাড়া), সূর্যদী মধ্য পাড়ার ফরমাইল হোসেন, আ. জব্বার-১, মোহাম্মদ আলী, ইয়াদ আলী, আলমাছ উদ্দিন, মুন্তাজ আলী, হাছেন আলী, মুনছুর আলী, মোজাম্মেল হক, জোনাব আলী, হুরমুজ আলী, মোহসীন আলী, আ. জব্বার-২, সেগা সেক ও মকবুল হোসেন; নিজ আন্ধারিয়ার আমেনা খাতুন, জুলহাস উদ্দিন, আ. সামাদ ও আ. রশিদ; সূর্যদী তিরছা বাড়ির ফজর আলী, শহীদ নবীর উদ্দিন, সাহাবউদ্দিন, সাহাবাজ আলী, পচা সেক, মফিজউদ্দিন, আবেদ আলী ও ফজি সেক; সূর্যদী দক্ষিণ পাড়ার কদর আলী, সমেশ আলী, সামছুল হক, রিয়াজউদ্দিন, ফকির মামুদ ও জবেদ আলী; চক আন্ধারিয়ার রিয়াজ উদ্দিন ও জয়নাল আবেদীন এবং আ. ছাত্তার কাইদ্যা (নকলা)। সূর্যদী গ্রামের বানিয়াপাড়ায় নির্মিত স্মৃতিফলকে ৩৯ জন শহীদের নামের তালিকা রয়েছে। [রবিন পারভেজ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড