You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.18 | সুরিকোনা গণহত্যা (বালাগঞ্জ, সিলেট) - সংগ্রামের নোটবুক

সুরিকোনা গণহত্যা (বালাগঞ্জ, সিলেট)

সুরিকোনা গণহত্যা (বালাগঞ্জ, সিলেট) সংঘটিত হয় ১৮ই জুলাই। এ গণহত্যায় ২২ জন সাধারণ মানুষ শহীদ ও অনেকে আহত হন।
কুশিয়ারা নদীর উত্তর পাশে সুরিকোনা গ্রাম। বর্তমান ওসমানীনগর উপজেলার সাদিপুর ইউনিয়নের প্রসিদ্ধ স্থান শেরপুর থেকে প্রায় ৩ মাইল পশ্চিমে। সুরিকোনার ঠিক বিপরীত দিক থেকে নদী অতিক্রম করলেই নবীগঞ্জ থানার দুর্গাপুর গ্রাম। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য আলফু মিয়া। পাকবাহিনীকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে অস্বীকার করায় পাকসেনারা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয় এবং দুর্গাপুর আক্রমণ করে। কিন্তু আলফু মিয়া কুশিয়ারায় লাফিয়ে পড়েন। নদী সাঁতরে অপর তীরে সুরিকোনা গ্রামে আশ্রয় নেন। নিভৃত পল্লির ছোট্ট এ গ্রামটিকে নিরাপদ ভেবে ইব্রাহিমপুর, তাজপুর, গজিয়া, সাদিপুর প্রভৃতি গ্রামের বহু লোক এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। এ খবর জানতে পেরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৮ই জুলাই গভীর রাতে স্পিডবোটে করে এ গ্রামে আসে। তারা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে সুবিধাজনক স্থানে ওঁৎ পেতে থাকে। এ খবর সুরিকোনার কেউ জানত না। ভোরে গ্রামের লোকজন নামাজ আদায় করতে মসজিদে যায়। নামাজ শেষ হওয়ার আগেই মসজিদটি আক্রান্ত হয়। নামাজরত অবস্থায় পাকিস্তানি সৈন্যরা মুসল্লিদের বেঁধে ফেলে এবং বাইরে নিয়ে আসে। বিভিন্ন স্থানে ওঁৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর অন্য সদস্যরা মুহূর্তের মধ্যে গ্রামবাসীদের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত লোকজনকে নির্যাতন করতে- করতে ধরে নিয়ে আসে। আর একের পর এক আগুন দিয়ে বাড়িগুলো জ্বালিয়ে দেয়। নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাই প্রাণের ভয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। তারা এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকে।
মসজিদের মুসল্লিদের পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে আসে গ্রামের দক্ষিণ দিকের কুশিয়ারা নদীর তীরে। সুরিকোনার দক্ষিণ অংশ থেকে ধরে আনা লোকজনকেও এখানে জড়ো করা হয়। তাদের ১৮ জনকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে হানাদার বাহিনী গুলি ছোড়ে। গুলি ছোড়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তাদের ৩ জন নদীতে ঝাঁপ দেয় এবং সাঁতার কেটে অপর তীরে গিয়ে ওঠে। এ-সময় ৪ জন গুরুতর আহত অবস্থায় বেঁচে যান। তারা হলেন- শামসুল হক, আবদুল হক, সমত্তা আলী ও কনাই মিয়া। শামসুল হককে সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩ মাস চিকিৎসা দিয়ে বাঁচানো সম্ভব হয়। বাকি ১১ জন শহীদ হন। তারা হলেন— লন্ডন প্রবাসী সাজিদ আলী ও ইনুছ আলী, তাজপুরের ছাদ মিয়া, ইব্রাহিমপুরের বাহাউদ্দিন, সিরাজ উদ্দিন, আকবর আলী ও ইরফান উল্লা, সৈয়দপুর গ্রামের ইছন আলী ও তোরাব আলী এবং আবদুল হেকিম ও আফিজ আলী।
হানাদার বাহিনীর দ্বিতীয় গ্রুপ গ্রামের ঘুমন্ত মানুষদের ধরে গ্রামের উত্তর পাশে ডাঙ্গার পাড়ায় নিয়ে আসে। এখানে তাদের একই সারিতে দাঁড় করানো হয়। সংখ্যায় তারা ১৭ জন। হানাদারদের আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে ওঠার ঠিক আগ মুহূর্তে কয়েকজন পালিয়ে রক্ষা পায়। এখানে হানাদারদের গুলিতে ৫ জন শহীদ হন। তারা হলেন- সুরিকোনার সাইদুর রহমান, সুরুজ আলী, আবদুল জব্বার ও আবদুল বাহার এবং তাজপুর গ্রামের রমজান মিয়া। গুরুতর আহত হন আতাউর রহমান, মানিক মিয়া প্রমুখ। গুলিতে আতাউর রহমানের দু- পাটি দাঁত উড়ে যায়। পাকবাহিনীর ভয়ে কোনো ডাক্তারই তার চিকিৎসা করতে রাজি হননি। পরে নূরপুর গ্রামে তার চিকিৎসা হয়। আজো তিনি বেঁচে আছেন বিকৃত মুখ নিয়ে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তৃতীয় দলটি যাদের ধরেছিল, তাদের তারা গ্রামের পশ্চিম পাশে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। এতে ৬ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন। শহীদরা হলেন- সুরিকোনার মকরম উদ্দিন, সাদ উদ্দিন ও জহির উদ্দিন এবং তাজপুরের আগন মিয়াসহ আরো দুজন। এ হত্যাকাণ্ডের পর গ্রামের মানুষ পালিয়ে যায়। তিনদিন পর ভীত-সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীদের কেউ-কেউ গ্রামে ফিরে আসে এবং নিহত আত্মীয়-স্বজনদের লাশ বধ্যভূমিতে কবরস্থ করে। [জগন্নাথ বড়ুয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড