You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর উত্তম সুলতান মাহমুদ

সুলতান মাহমুদ, বীর উত্তম (জন্ম ১৯৪২) বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের বিমান ইউনিট ‘কিলো ফ্লাইট’-এর অধিনায়ক, স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান ও এয়ার ভাইস মার্শাল। তিনি ১৯৪২ সালের ২রা মে বর্তমান ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার এয়াকুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নুরুল হুদা এবং মাতার নাম আঙ্কুরের নেছা।
সুলতান মাহমুদ ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তারপর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সারগোদা পাকিস্তান এয়ার ফোর্স পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৮ সালে সেখান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিকুলেশন ও ১৯৬০ সালে সিনিয়র কেম্বিজ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬০ সালে তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে তিনি কমিশন প্রাপ্ত হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ করাচির নিকটবর্তী পাকিস্তান এয়ার ফোর্স মাসরুর, মৌরীপুরে কর্মরত ছিলেন। তবে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করলেও তিনি সত্তরের নির্বাচনপরবর্তী দ্রুত অবনতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর যে ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতন চালায়, তার খবর জানতে পেরে তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। পরবর্তীতে মে মাসে তিনি কর্মস্থল ত্যাগ করে করাচি থেকে শ্রীলঙ্কা হয়ে ঢাকা পৌঁছান। ঢাকা থেকে ভারত যাবার পথে দাউদকান্দি ফেরিঘাটের নিকট পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁকে আটক করার জন্য তাড়া করলে তিনি সাঁতরে মেঘনা নদী পার হয়ে অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সীমান্ত পার হয়ে প্রথমে ২নং সেক্টরে (মেলাঘর) মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি মেজর মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তমএর নেতৃত্বে ১নং সেক্টরে যোগ দেন।
এক নম্বর সেক্টরে যোগ দেবার পর বিমান বাহিনীর একজন অফিসার হয়েও প্রবল মনোবল নিয়ে স্থল যুদ্ধে সুলতান মাহমুদ পাকিস্তানি শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো সফল অপারেশনে নেতৃত্ব দেন। তার মধ্যে মদুনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্ৰ ধ্বংসের অপারেশন উল্লেখযোগ্য। সেক্টরভিত্তিক পরিকল্পিত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের তৎপরতা প্রতিরোধের অংশ হিসেবে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও চট্টগ্রামের তেল শোধনাগার ‘ইস্টার্ন রিফাইনারি’টি ধ্বংস করার বিষয়টি চিন্তা করতে থাকেন। ১নং সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম এ দুটি স্থাপনা ধ্বংস করা হলে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশেরই বেশি ক্ষতি হবে এটা ভেবে তিনি কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও চট্টগ্রামের তেল শোধনাগারের ক্ষতি না করে বরং একই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মদুনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের বৈদুতিক পাইপলাইনগুলো ধ্বংসের পরিকল্পনা করেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদকে। উল্লেখ্য, মদুনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের হালদা নদীর পশ্চিম পাশে অবস্থিত। কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ মদুনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনটি শক্তিশালী ট্রান্সফরমারের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের পূর্বাঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারদিকে বাংকার করে তার মধ্যে পাহারায় নিয়োজিত ছিল এক প্লাটুন পাকিস্তানি সৈন্য।
হালদা নদীর উভয় তীরেই ছিল শত্রুসৈন্যদের অবস্থান। পর্যবেক্ষণের জন্য নদীর ওপর নির্মিত সেতুতে বসানো হয়েছিল উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সার্চলাইট। মেজর রফিকুল ইসলামের নিকট থেকে নির্দেশনা পেয়ে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ এ অপারেশনের নিয়মিত বাহিনী ও বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয়ে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা বাছাই করে তাঁদের নিয়ে চূড়ান্ত অপারেশনের পূর্বে বেশ কয়েকটি টার্গেট রেকি করেন। এরপর ৬ই অক্টোবর ভোর রাত ৪টার সময় মুক্তিযোদ্ধারা সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫০ ফুট দূর থেকে রাইফেল, এলএমজি, এসএমজি ও ২টি রকেট লঞ্চারের সাহায্যে গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে মূল আক্রমণ শুরু করেন। শত্রুসেনারাও পাল্টা আক্রমণ করে। প্রচ গোলাগুলির এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা কাঁটাতারের উঁচু দেয়াল ডিঙ্গিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে প্রবেশ করে ট্রান্সফর্মারে গোলাবর্ষণ শুরু করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টা গোলাগুলির পর শত্রুসেনারা পরাস্ত হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সবগুলোর ট্রান্সফর্মার ধ্বংস করার ফলে দেশের পূর্বাঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এ অপারেশনে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদও পায়ে স্পিলিন্টারের আঘাতে গুরুতর আহত হন। পরবর্তীতে তিনি স্থল যুদ্ধ ছেড়ে বিমান উইং-এ যোগ দেন। উল্লেখ্য, সেপ্টেম্বর মাসে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে বিমান উইং গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি পুরনো ডাকোটা বা ডিসি বিমান, কানাডার তৈরি একটি ডিএইচসি-৩ টুইন অটার বিমান ও ফ্রান্সের তৈরি একটি অ্যালয়েট থ্রি হেলিকপ্টার প্রদান করে। এক সঙ্গে এ উইং এর ব্যবহারের জন্য ভারত সরকার নাগাল্যান্ড রাজ্যের ডিমাপুরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত পরিত্যক্ত একটি রানওয়েও ব্যবহারের অনুমতি দেয়। ২৮শে সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার, বীর উত্তম এর নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভারত থেকে প্রাপ্ত বিমানগুলোকে অপারেশন উপযোগী করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টর থেকে ৬৭ জন বিমান সেনা ও পিআইএ-এর কয়েকজন পাইলট নিয়ে একটি বিমান ইউনিট গঠন করা হয়। এ ইউনিটের নামকরণ করা হয় ‘কিলো ফ্লাইট’ এবং স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদকে এর অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে বিমান সেনারা টুইন অটার বিমানটিতে রকেট পড় লাগিয়ে প্রতিটি পাখার নিচে ৭টি করে রকেট সংযুক্ত করেন। এছাড়াও কৃত্রিমভাবে এ বিমানের মেঝেতে ২৫ পাউন্ড ওজনের ১০টি বোমা সংযুক্ত করা হয়, যা দরজা দিয়ে হাতের সাহায্যে নিক্ষেপ করা হতো। অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারটির সামনে থেকে ৩০৩ ব্রাউনিং মেশিনগান এবং দুই পাইলন থেকে ২৫ পাউন্ড ওজনের ১৪টি রকেট নিক্ষেপের সক্ষমতায় উপযুক্ত করে তৈরি করা হয়। এছাড়াও খুব নিচু দিয়ে উড়তে হবে বলে নিরাপত্তার জন্য এর তলদেশে এক ইঞ্চি পুরু স্টিল প্লেট লাগানো হয়। ডিসি-৩ বিমানটি ছিল মূলত যোধপুরের মহারাজা গজ সিংজির ব্যক্তিগত ব্যবহারের বিমান। তাঁর উপহার দেয়া এ বিমানটি মুক্তিযুদ্ধে পরিবহন কাজে ব্যবহার করা হতো। সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে অল্প দিনের মধ্যে ‘কিলো ফ্লাইট’ শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনায় সক্ষমতা অর্জন করে। তাঁর নেতৃত্বে এ ইউনিট ৩রা ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত অনেকগুলো সফল অপারেশন পরিচালনা করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জ্বালানি তেলের ডিপো (ESSO)-তে দুঃসাহসিক বিমান আক্রমণ। রাতের বেলা নিচু দিয়ে হেলিকপ্টার চালানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তবে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ৩রা ডিসেম্বর মধ্যরাতে শত্রুর রাডারকে ফাঁকি দিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে খুব নিচু দিয়ে হেলিকপ্টার চালিয়ে কোনো বিপদ ছাড়াই গোদনাইলে পাকিস্তানি জ্বালানি তেলের ডিপোর ওপর ১৪টি বোমা নিক্ষেপ করেন। মুহূর্তের মধ্যে সেগুলো বিস্ফোরিত হয়ে সেখানকার দুটি তেলের ডিপো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। এ অপারেশনে তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন বদরুল আলম বীর উত্তম, শাহাবুদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম ও দুজন টেকনিশিয়ান। উল্লেখ্য, একই দিনে কিলো ফ্লাইটের আকরাম আহমেদ, বীর উত্তম ও শামসুল আলম, বীর উত্তম চট্টগ্রামে অবস্থিত ইস্টার্ন রিফাইনারির ওপর বিমান থেকে বোমা ফেলে সেখানকার তেলের ডিপোগুলো জ্বালিয়ে দেন। এর ফলে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কার্যক্রম দু-এক দিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও ১৬ই ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে সিলেট, মৌলভীবাজার, কুলাউড়া, কুমিল্লা, ভৈরব ও শমসেরনগরসহ বেশ কয়েকটি স্থানে দুঃসাহসিক বিমান অভিযান পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ বিমান বাহিনী (Bangladesh Air Force) -এ যোগদান করেন এবং বিএএফকে পুনর্গঠনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— বিএএফ ঘাঁটি বাশার, বিএএফ ঘাঁটি মতিউর রহমান- এর প্রধান, বিএএফ একাডেমির কমান্ডেন্ট, বিএএফ সদর দপ্তরের ডাইরেক্টর অপারেশন ইত্যাদি। ১৯৮১ সালের ২৩শে জুলাই থেকে ১৯৮৭ সালর ২২শে জুলাই পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ এয়ার ফোর্স-এর প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮২ সালের ২৫শে মার্চ তিনি উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ সালে তিনি বিমান বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম ফেরদৌস আরা মাহমুদ। এ বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে ফেনী শহরে ‘সুলতান মাহমুদ হকার্স মার্কেট’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০১৮ সালে এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) সুলতান মাহমুদকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরুস্কার’ প্রদান করা হয়। [সাজাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!