You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন পর্যন্ত সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার জনগণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯৬৯ সালে আবদুস সামাদ আজাদ-এর আওয়ামী লীগ এ যোগদান, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা বরুণ রায় ওরফে প্রসূন কান্তি রায়ের রাজনৈতিক তৎপরতা ইত্যাদি জনগণের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে জোরদার করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ জেলার সর্বস্তরের জনগণকে সংগঠিত করতে তৎপর হন। ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে তাঁরা জনগণকে সক্রিয় করে তোলেন। ৪ঠা মার্চ ছাত্র-জনতা সুনামগঞ্জ শহরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। লঞ্চঘাট এলাকার পুলিশ ফাঁড়িতে (গারদ) পতাকা উত্তোলনের সময় পুলিশ গুলি করতে উদ্যত হলে ছাত্র-জনতা ইট-পাটকেল ছোড়ে।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ পরের দিন বেতারে সম্প্রচারিত হলে সুনামগঞ্জ মিছিলের শহরে পরিণত হয়। মিছিলের স্লোগান ছিল “জিন্নার পাকিস্তান, আজিমপুরের গোরস্তান।’ এ আন্দোলনে কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তারা অর্থ দিয়েও সহযোগিতা করে।
একদিকে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন চলছিল, অন্যদিকে দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী এমএনএ (হাছননগর)-এর বাড়িতে প্রতিরাতে সভা করে পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করা হতো। পাকসেনারা সুনামগঞ্জে প্রবেশ করার পূর্ব পর্যন্ত এখানকার প্রশাসন চলত স্থানীয় নেতাদের নির্দেশে। ব্যাংক, বিমা, থানা, ডাকঘর, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, ট্রেজারি সবই তাঁদের নির্দেশমতো চলত। সামাজিক শৃঙ্খলা ও জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্রদের ওপর।
২৩শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল রাজনৈতিক দলের নেতারা মিলিত হয়ে পুরাতন পৌরসভার অফিস প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। এদিনই ছাত্রদের এক বিশাল সমাবেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানানো হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ছাত্রনেতা সুজাত আহমদ চৌধুরী। বক্তব্য রাখেন গোলাম রব্বানী, আব্দুস শহীদ চৌধুরী, সুদীপ্ত দাস, তালেব উদ্দিন আহমদ, মুজিবুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ। পরে ছাত্ররা ইয়াহিয়ার কুশপুত্তলিকা দাহ করে এবং পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দেয়।
২৪শে মার্চ ছাত্র-জনতা মহকুমা প্রশাসকের নিকট অস্ত্রাগারের চাবি চাইলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। এ-সময় পাকবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য উপজেলার আনসার-মুজাহিদদের সংগঠিত করা হয়। সারারাতব্যাপী শহরে পাহারা বসানো হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা এসডিও-র বাসভবন ঘেরাও করে রাখে। ২৫শে মার্চ আনসার এডজুট্যান্টের নিকট থেকে চাবি নিয়ে অস্ত্রাগার থেকে ৫০টি রাইফেল ও কিছু গুলি সংগ্রহ করা হয়। দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী এমএনএ, আলফাত উদ্দিন আহমদ, হোসেন বখত প্রমুখ নেতার পরামর্শে নজির হোসেন, আশ্রব আলী, নওয়াব আলী, মনোয়ার বখত নেক প্রমুখ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার ও মুজাহিদদের একটি তালিকা করে তাঁদের মধ্যে এসব অস্ত্র ও গুলি বিতরণ করেন।
আসন্ন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সুনামগঞ্জ অঞ্চলে আওয়ামী লীগ ও ওয়ালী ন্যাপ নেতাদের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে ওঠে। দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী এমএনএ (আওয়ামী লীগ), হোসেন বখত (আরপিননগর, আওয়ামী লীগ), আলফাত উদ্দিন আহমদ (পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, ভাসানী ন্যাপ), আকমল আলী (হাছননগর, আওয়ামী লীগ), শওকতুল ইসলাম আজাদ (পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, ওয়ালী ন্যাপ), নজির হোসেন (কমিউনিস্ট পার্টি), আলী ইউনুস (জামাইপাড়া, ওয়ালী ন্যাপ), আব্দুর রইছ (হাছননগর, আওয়ামী লীগ), আব্দুল বারী (হাছননগর), অমর চাঁদ দাস (শ্যামারচর, দিরাই) প্রমুখ একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে প্রচার চালাতে থাকেন। ২৭শে মার্চ সুনামগঞ্জ মহকুমায় সর্বদলীয় স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী এমএনএ আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। পরিষদের অন্য সদস্যরা ছিলেন— আবদুস সামাদ আজাদ এমএনএ, মোহাম্মদ আব্দুল হক এমএনএ, আব্দুল হাকিম চৌধুরী এমপিএ, আবদুল জহুর মিয়া এমপিএ, শামসু মিয়া চৌধুরী এমপিএ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপিএ, হোসেন বখত, মো. আলী ইউনুস, আলফাত উদ্দিন আহমদ এবং আবদুল কদ্দুস।
সুনামগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদের নবনির্বাচিত ভিপি হুমায়ুন কবীর চৌধুরী (বড়পাড়া) এবং জিএস জামিলুল হক চৌধুরী (কুলঞ্জ, দিরাই উপজেলা)-সহ অন্য নেতারাও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৭ই মার্চের ভাষণের পর ছাত্রলীগ-এর সঙ্গে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতারাও এগিয়ে আসেন। ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন মুজিবুর রহমান চৌধুরী, সুজাত আহমদ চৌধুরী, আব্দুল মালেক, তালেব উদ্দিন আহমদ, প্রমোদ চন্দ্র তালুকদার, সুনীল সমাজপতি, আলী আসগর, মতিউর রহমান; ছাত্র ইউনিয়ন-এর ছিলেন— আব্দুস শহীদ চৌধুরী, রমেন্দ্র কুমার দে মিন্টু, অজিত কুমার নাগ, বজলুল মজিদ খসরু, এম সাব্বির মিনু, হুমায়ুন কবীর চৌধুরী, সুদীপ্ত দাস, সুশান্ত রঞ্জন ভদ্র সাধন, সাইফুর রহমান সামছু, বেলায়েত হোসেন এবং ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) থেকে ছিলেন- আব্দুর রব শেলী, সত্যব্রত রায় বুলু, স্বপন কুমার দেব, আবু লেইস, আবু সুফিয়ান, এনামুজ্জামান চৌধুরী প্রমুখ। জেলার নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএ-গণ ঢাকার জাতীয় নেতাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রতিনিয়ত অবহিত থাকতেন। তাঁরা অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করেন। ১৪ই মার্চ থেকে সরকারি জুবিলী হাইস্কুল মাঠে অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণ দেন বিমান বাহিনীর প্রাক্তন সদস্য আছদ্দর আলী চৌধুরী (লাল মিয়া), মতিউর রহমান চৌধুরী, পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডের (পিএনজি) প্রাক্তন অনারারি লেফটেন্যান্ট কাজী বশির উদ্দিন (নানু মিয়া মোক্তার), পিএনজি-র প্রাক্তন সদস্য আশ্রব আলী, নওরোজ আলী (বাবন মিয়া), প্রাক্তন আনসার কমান্ডার নওয়াব আলী প্রমুখ। প্রশিক্ষণে সার্বিক নেতৃত্ব দেন আছদ্দর আলী চৌধুরী ও মতিউর রহমান চৌধুরী।
২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার খবর সুনামগঞ্জে পৌঁছলে সর্বদলীয় নেতৃবৃন্দ পাকবাহিনীকে প্রতিরোধকল্পে এদিন রাতে দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী এমএনএ-র বাড়িতে এক জরুরি সভায় বসেন। সভায় বিভিন্ন কৌশল নিয়ে আলোচনার পর বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাস্তায়-রাস্তায় মাটি খুঁড়ে ও গাছ ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। আনসার এডজুট্যান্ট এম এ মোকাব্বিরের নেতৃত্বে আনসার, মুজাহিদ ও ছাত্রদের পিটিআই প্রাঙ্গণে জড়ো করা হয়। পাকসেনারা যাতে সুনামগঞ্জ শহরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য আহসানমারা ও ডাবর ফেরি সরিয়ে ফেলা হয়। শহরের ওয়েজখালীতে বাঙ্কার খনন করে নায়েক আনিস, আনসার মালদার আলী, তারা মিয়া, কামাল মিয়া প্রমুখকে সশস্ত্র পাহারায় বসানো হয়। পাকসেনাদের প্রতিহত করার জন্য আমবাড়িতেও একটি প্রতীরক্ষা ব্যূহ তৈরি করা হয়। কিন্তু সব প্রতিরোধ ভেঙ্গে ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় পাকবাহনী ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে সুনামগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে এবং সুনামগঞ্জ পিটিই স্কুল ও সার্কিট হাউজে ক্যাম্প স্থাপন করে। শহরে প্রবেশ করেই তারা সদর থানার পুলিশ বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে এবং সারা শহরে সান্ধ্য আইন জারি করে। ২৮শে মার্চ সকালে রাজনৈতিক নেতারা সান্ধ্য আইন অমান্য করার সিদ্ধান্ত নেন। এ-সময় পাকসেনারা শহরের ট্রাফিক পয়েন্টে লক্ষ্মী ভাণ্ডারের মালিক বলরাম দে-কে নির্যাতন করে। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের বাড়িতে হানা দেয়। এ খবর শুনে গ্রাম- গঞ্জের লোকজন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শহরে আসতে শুরু করে এবং সকাল ১১টার দিকে উভয় পক্ষে যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনী সুনামগঞ্জ শহরে প্রবেশ স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে শান্তি কমিটি, রাজাকার- ও আলবদর বাহিনী গঠন করে। ১০ই মে গঠিত সুনামগঞ্জ মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয় এম মনসুর আলী ওরফে শওকত মিয়া (পিতা মনোহর আলী, আলীমাবাগ, সুনামগঞ্জ পৌরসভা), ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন এডভোকেট (খরিদিরচর, ছাতক), জেনারেল সেক্রেটারি ফারুক চৌধুরী (পিতা মকবুল হোসেন চৌধুরী, হাছননগর, সুনামগঞ্জ), এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মজম্মিল আলী (লক্ষণশ্রী, সুনামগঞ্জ), অফিস সেক্রেটারি এডভোকেট আফতর আলী (ব্রাহ্মণগাঁও, সুনামগঞ্জ) এবং ট্রেজারার এডভোকেট আব্দুল গণি আবুল (ব্রাহ্মণগাঁও, সুনামগঞ্জ)। কমিটির সদস্য ছিল- আবু হানিফা আহমদ ওরফে নবাব মিয়া (ষোলঘর), আবু মিয়া (চৌমুহনী), মোহাম্মদ ওয়ালী (আলীমাবাগ), তজম্মুল হোসেন চৌধুরী ওরফে কাচা মিয়া (নতুনপাড়া), ডা. আহমদ রেজা বিহারী (হাছননগর), হারুনুর রশীদ (ফকিরনগর), সাদির উদ্দিন আহমদ (হাছননগর), এডভোকেট মুজিবুর রহমান চৌধুরী, এডভোকেট আব্দুল মতিন, গেদা মিয়া তালুকদার (আরপিননগর), আব্দুল কাদির চৌধুরী (হাছননগর), মিসবাউদ্দোজা আহমদ (সুনামগঞ্জ), আব্দুল মতলিব (হাছননগর), আব্দুল আজিজ মোক্তার (আলীমাবাগ), আব্দুল গণি চৌধুরী, আছদ্দর চৌধুরী (জামাইপাড়া), কামরুল ইসলাম মাস্টার (জানিগাঁও), মনোয়ার আলী তহশিলদার (জানিগাঁও), মোহাম্মদ বখত ওরফে গনরাজ মিয়া (বড়পাড়া), আব্দুর রশীদ (হবতপুর), আছকর আলী (হবতপুর), বাহাদুর আলী (মদনপুর), এ জব্বার বিএ (আরপিননগর), আব্দুল ওয়াহাব (আলমপুর), আব্দুল খালেক (আলমপুর), আফতর আলী এমএ (ব্রাহ্মণগাঁও), ডা. মোহাম্মদ করম আলী (মোহাম্মদপুর), আব্দুল জব্বার (মাইজবাড়ি), ইসহাক আলী (কান্দিগাঁও), খুরিশদ আলী (বুড়িস্থল), নুরুল ইসলাম (আলীপুর), ডা. মুহিব উদ্দিন (আরপিননগর), মুন্সী মোবারক আলী (সোনারপাড়া), ইয়াকুব আলী (খাগেরগাঁও), সাজিদ উল্লাহ (পৈন্দা), আজিম উল্লাহ (রাবার বাড়ি), আব্দুল হেকিম (জগাইরগাঁও), পীর আব্দুল বারী (টোকেরগাঁও), আবুল মনসুর আহমদ (লক্ষ্মীপুর), মাওলানা সিরাজুল ইসলাম (সুকদেবপুর), সুনা মিয়া (সেরমস্তপুর), সৈয়দ আকবর আলী (মামদপুর, বর্তমান মোহাম্মদপুর), আপ্তাব উদ্দিন আহমদ (রাধানগর), ডা. মহিউদ্দিন (চিনাকান্দি), আব্দুর রউফ (উজানিগাঁও), আবুল হোসেন চৌধুরী মোক্তার (সুনামগঞ্জ), রফিকুল বারী (মুড়ারবন্দ), এডভোকেট রফিকুল বারী চৌধুরী, ফজলুল করীম (ছাতক), সুজন চৌধুরী (ছাতক), আব্দুল মন্নান (ছাতক), হাছন আলী (ছাতক), জিয়াউল হক (ছাতক), মোবাশ্বির আলী (ছাতক), মতছির আলী (ছাতক), সুরুজ আলী (ছাতক), নুরুল আবেদীন (ছাতক), আব্দুল বারী (ছাতক), আবুল হোসেন (জয়শ্রী, ধর্মপাশা), আব্দুল হেকিম (পাইকারহাটি, ধর্মপাশা), আব্দুল খালেক (দৌলতপুর, শাল্লা), শরাফত আলী (সুলতানপুর, শাল্লা), নজরুল ইসলাম চৌধুরী (দিরাই), আব্দুল ওয়াহাব (দিরাই), আব্দুল খালেক (ভীমখালী, জামালগঞ্জ), আসাবুর রাজা চৌধুরী (আশারকান্দি, জগন্নাথপুর) এবং আহমদ মল্লিক (মল্লিকপুর, তাহিরপুর)।
শান্তি কমিটির প্রথম বৈঠক হয় ১২ই মে চেয়ারম্যান এম মনসুর আলীর বাসায়। এতে বক্তব্য দেয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফারুক চৌধুরী। ১৭ই জুন এখানে আরেকটি সভা হয়। সভায় ফারুক চৌধুরী, আছদ্দর চৌধুরী, কামরুল ইসলাম মাস্টার, আব্দুল গণি, করম আলী, হারুনুর রশীদ, গেদা মিয়া, আব্দুর রশীদ, আজিম উল্লাহ, আব্দুল ওয়াহাব, আব্দুল মোতাল্লিব, সাদির উদ্দিন আহমদ, সৈয়দ আব্দুল বারী, সিরাজুল ইসলাম, আব্দুল খালেক, খুরশিদ আলী, ইসহাক আলী, সৈয়দ আকবর আলী, এম মহিউদ্দিন, সাজিদ উল্লাহ, আফতর আলী, আব্দুর রউফ, বাহাদুর আলী, নুরুল ইসলাম, আব্দুল হেকিম, আবুল মনসুর আহমদ, মনোয়ার আলী তহশিলদার, আব্দুল জব্বার, মুন্সী মোবারক আলী, তজম্মুল হোসেন, আব্দুল কাহার, আসকর আলী, আবু মিয়া, রফিকুল বারী (ছাত্র), সুরুজ আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিল। শান্তি কমিটির সংগঠকদের নেতৃত্বেই রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। এ তিন বাহিনীর সদস্যরা এলাকায় লুটপাট, ধর্ষণ ইত্যাদি মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। যুদ্ধের সূচনাতেই পাকসেনাদের গুলিতে গণেশ দাস নামে একজন রিকশাচালক গুরুতর আহত হয় পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। পাকসেনারা গণিগঞ্জ গ্রামে ঢুকে লুটপাট ও নারীদের ওপর নির্যাতন শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধারা এসে তাদের ওপর আক্রমণ চালান এবং গণিগঞ্জ মুক্ত করেন। ১৫ই মে সকালে পাকবাহিনী চারটি স্পিডবোটে এসে পূর্ব ইব্রাহীমপুর গ্রামে প্রবেশ করে বিভিন্ন পাড়ার প্রায় একশ বাড়িঘড়ে অগ্নিসংযোগ করে।
সুনামগঞ্জ পিটিআই স্কুল ক্যাম্প ছিল পাকসেনাদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এখানে সাধারণ মানুষদের ধরে এনে বন্দি করে রাখা হতো এবং অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। ২রা এপ্রিল পাকবাহিনীর বিমান হামলায় সুনামগঞ্জ সদরে অনেকে প্রাণ হারান। উপজেলায় একটি বধ্যভূমি ও দুইটি গণকবর আছে— সুনামগঞ্জ পিটিই স্কুল বধ্যভূমি ও ডলুরা গণকবর ও নলুয়া গণকবর। ডলুরায় ৪৮ জন শহীদকে গণকবর দেওয়া হয়।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। ২৮শে মার্চ সার্কিট হাউজে অবস্থানরত পাকসেনাদের সঙ্গে বাঙালি ইপিআর, আনসার, ছাত্র-জনতা ও মুজাহিদদের যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে আনসার কমান্ডার আবুল হোসেন পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। ১৫ই আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা আহসানমারা সেতু ধ্বংস করে দেন। সৈয়দপুর-নলুয়া যুদ্ধে পাকসেনাদের গুলিতে গিয়াস উদ্দিন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা রহিম বক্স নারায়ণতলা এলাকায় অস্ত্রহাতে গুলি ছুড়তে-ছুড়তে এগিয়ে গেলে পাকসেনাদের ছোড়া গুলিতে তাঁর মাথার খুলি উড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই তিনি শহীদ হন। মঙ্গলকাটা এলাকায় যুদ্ধরত তালেব উদ্দিন আহমদকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে আহসানমারা সেতু এলাকায় গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানি দালাল ও রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পেয়ে পাকসেনারা ঝরঝরিয়া এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। এতে ওয়ারিছ আলী নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আমবাড়ি আক্রমণের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মাইনের আঘাতে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। আহসানমারার পাশে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের একটি জিপগাড়ি ধ্বংস করে দেন। এছাড়া বেরীগাঁও, সৈয়দপুর, বিরামপুর, নীলপুর, মুসলিমপুর, মঙ্গলকাটা ইত্যাদি স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন পরিচালনা করেন। ৬ই ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- আব্দুল নূর, বীর প্রতীক (পিতা আশ্রব আলী, বাহাদুরপুর)।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ছয়জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন- আবুল হোসেন (পিতা জায়ফর মোহাম্মদ, অচিন্তপুর; আনসার কমান্ডার, ২৮শে মার্চ সুনামগঞ্জ শহরের সতীশ চন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে যুদ্ধরত অবস্থায় শহীদ), মরম আলী (বাঁশতলা, দোয়ারা বাজার; কৃষক পরিবারের সন্তান, ১৬ই আগস্ট পাকসেনাদের জয়কলস ঘাঁটিতে অভিযান চালানোর সময় শহীদ), গিয়াস উদ্দিন (সৈয়দপুর-নলুয়া যুদ্ধে শহীদ), রহিম বক্স (নারায়ণতলার যুদ্ধে শহীদ), তালেব উদ্দিন আহমদ (মঙ্গলকাটা যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ধরে নিয়ে আহসানমারা সেতু এলাকায় হত্যা করে) ও ওয়ারিছ আলী (ঝরঝরিয়া যুদ্ধে শহীদ)।
উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সুনামগঞ্জ শহরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলকসহ স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। শহরের ট্রাফিক পয়েন্ট এলাকায় ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ’ এবং সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে তালেব, গিয়াস ও জগৎজ্যোতি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। শহরের বক পয়েন্ট এলাকার নাম হোসেন বখত চত্বর রাখা হয়। জগৎজ্যোতি দাস, বীর বিক্রমএর নামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসের নাম শহীদ তালেব ছাত্রাবাস এবং বিডি হলের নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন মিলনায়তন রাখা হয়। এছাড়া ডলুরা এলাকায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সমাধিস্থল নির্মাণ করা হয়। [আকরাম উদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড