You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা (গাইবান্ধা) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা (গাইবান্ধা)

সুন্দরগঞ্জ উপজেলা (গাইবান্ধা) ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের এলাকা। সেই সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের নেতৃত্বে কৃষক সংগঠনের উদ্যোগে হাটের তোলা (গণ্ডি) বন্ধের আন্দোলনও জোরদার ছিল এ এলাকায়। ১৯৪৯ সালে হরিপুর হাটে এ আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তেভাগা আন্দোলনের নেতা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ফয়েজ উদ্দিন ও পুটি শেখ।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর সুন্দরগঞ্জ থানা সদরে জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব থাকলেও বামনডাঙ্গা এবং চণ্ডিপুর এলাকায় আওয়ামী লীগ সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বেশ প্রভাব ছিল। সেখানে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালিত হতো। বামনডাঙ্গায় রেল স্টেশন থাকায় ঢাকা এবং মহকুমা শহর গাইবান্ধার রাজনৈতিক খবরাখবর বামনডাঙ্গায় আগেভাগে পাওয়া যেত। সে-কারণে বামনডাঙ্গায় ছাত্রদের উদ্যোগে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়মিতভাবে পালিত হতো। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সুন্দরগঞ্জ-সাদুল্যাপুর আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবু সোলাইমান মণ্ডল এমএনএ এবং সুন্দরগঞ্জ আসনে একই দলের সামছুল হোসেন সরকার এমপিএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করার পরেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের আশ্ৰয় নেয়৷ ফলে আন্দোলন-সংগ্রাম আরো বেগবান হতে থাকে।
১৯৭১ সালের ১লা মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ৩রা মার্চ আহুত পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার খবর বামনডাঙ্গায় পৌঁছলে সেখানে ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর বামনডাঙ্গায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ-এর কর্মীরা অসহযোগ আন্দোলনএর কর্মসূচির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। বামনডাঙ্গার চণ্ডিপুরে সংগ্রাম কমিটি গঠন করে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। গাইবান্ধার পাশাপাশি সুন্দরগঞ্জেও স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি গ্রহণকারী সুন্দরগঞ্জের ছাত্র- যুবকরা মাইনকার চর হয়ে ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারে ট্রেনিং নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। গাইবান্ধা মহকুমা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পর সুন্দরগঞ্জ থানা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ নেতা মোসলেম আলী (সুন্দরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, তারাপুর) সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। এর সদস্যদের মধ্যে শামসুল হোসেন সরকার এমপিএ, মকবুল আহমেদ (সুন্দরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি, বামনজল), গোলাম রব্বানী (সুন্দরগঞ্জ), বন্দে আলী (সুন্দরগঞ্জ), কমরেড কছির উদ্দিন আহমেদ (হরিপুর), কমরেড হানিফ ভূঁইয়া (চণ্ডিপুর), মোশাররফ হোসেন শাখা (বামনজল), আনোয়ার হোসেন (সুন্দরগঞ্জ) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
সুন্দরগঞ্জ এলাকায় যুদ্ধকালীন সময়ে কোনো কোম্পানি কমান্ডার ছিল না। এ এলাকায় গাইবান্ধা উপজেলা সদরের মফিজুর রহমান খোকা ও সাঘাটার শাহজাহান আলী টুকু কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শাহজাহান আলী টুকুর কোম্পানিতে সুন্দরগঞ্জের হরিপুর ইউনিয়নের ওয়াহিদ মিয়া একজন প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সুন্দরগঞ্জে পাকবাহিনী যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও মুক্তিকামী জনতা বামনডাঙ্গা-সুন্দরগঞ্জ সড়কে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। তবে ভারী অস্ত্রসজ্জিত পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সামান্য দেশীয় অস্ত্র দ্বারা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় বিধায় প্রতিরোধকারীরা পিছিয়ে চর রাজীবপুরের দিকে চলে যান। ৪ঠা এপ্রিল পাকবাহিনী সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা রেল স্টেশনে অনুপ্রবেশ করে এবং সেখানে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। ১৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী গাইবান্ধা মহকুমা শহরে অনুপ্রবেশ করার দুদিন পর অন্যান্য থানা সদরের মতো সুন্দরগঞ্জ সিও অফিসে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল জব্বারের বাড়িতে একটি রাজাকার- ক্যাম্প স্থাপিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই সুন্দরগঞ্জে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব বেশি থাকায় পাকবাহিনীর এদেশীয় সহযোগীদের সংখ্যাও বেশি ছিল। মূলত জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের তত্ত্বাবধানেই শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এখানে এদের মূল নেতা ছিল ১৯৭০ সালে নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের জামায়াতের প্রার্থী এ বি এম রেজাউল আলম খন্দকার। ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর পরাজিত প্রার্থী শেখ আব্দুল জব্বার ছিল শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। শান্তি কমিটির সদস্যদের মধ্যে আজিজার রহমান (ইমামগঞ্জ মাদ্রাসার সুপার), নুরুল হক (ধর্মপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক), খেতাব উদ্দিন বসুনিয়া (সুন্দরগঞ্জ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক), মওলানা হাসান আলী (ধুমাইটারি), মওলানা হোসেন আলী (ধুমাইটারি), আলীম উদ্দিন মাস্টার (বেলকা), কাজী আব্দুল খালেক (বামনজল), রবিজল মাস্টার (বামনজল) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। রাজাকারদের মধ্যে আব্দুল আজিজ (রাজাকার কমান্ডার, পাঁচগাছি; ঘোড়ামারা আজিজ নামে পরিচিত), রুহুল আমীন মঞ্জু (মাঠেরহাট), আব্দুর রহীম (ধুমাইটারি), কছিম মণ্ডল (ধুমাইটারি), কফিল বেপারী (ধুমাইটারি) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
গাইবান্ধা সদর থানার দরিয়াপুর ব্রিজটি মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংস করে দিলে হানাদারদের একটি বিরাট বহর লেফটেন্যান্ট আফজালের নেতৃত্বে ৯ই অক্টোবর সুন্দরগঞ্জে প্রবেশ করে। এদিন প্রথমেই গাইবান্ধা কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র বয়েজ উদ্দিন (পিতা আলম উদ্দিন সরকার, পাঁচগাছি)-কে আটকের পর নির্যাতন শেষে হত্যা করে। রাজাকার কমান্ডার আব্দুল আজিজ ও শেখ আব্দুল জব্বারের ছেলে রুহুল আমীন মঞ্জুর নেতৃত্বে সুন্দরগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়। ব্রহ্মপুত্র-তিস্তার মোহনায় লালচামার নামক স্থানে পাকবাহিনী এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। হিন্দু অধ্যুষিত হরিপুর, শ্রীপুর, কাপাসিয়া ও চণ্ডিপুর এলাকায় প্রতিনিয়ত তারা নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালায়। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে শান্তিরাম, শ্রীপুর ও ছাপরহাটি ইউনিয়ন কাউন্সিলের তিনজন চেয়ারম্যান ও দশজন মেম্বারকে শেখ আব্দুল জব্বারের চক্রান্তে সুন্দরগঞ্জ থানা সদরের সিও অফিসে স্থাপিত হানাদার ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। এভাবে এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫ শতাধিক লোককে এখানে হত্যা করা হয়, যা সুন্দরগঞ্জ সিও অফিস বধ্যভূমি নামে পরিচিত।
সুন্দরগঞ্জ সিও অফিসটি ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এছাড়া বামনডাঙ্গা রেল স্টেশন ও চণ্ডিপুর হাইস্কুলে স্থাপিত হানাদার ক্যাম্পগুলো নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সদরে যেখানে শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে, সে স্থানটি ছিল এ উপজেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি। ব্রহ্মপুত্র-তিস্তার মোহনার লালচামার স্থানে বিভিন্ন স্থান থেকে পাকবাহিনী অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে এখানে হত্যা করে ফেলে দেয়।
সুন্দরগঞ্জের কালিরবাজারে কিছু সংখ্যক পাকসেনা ও রাজাকার অবস্থান করছে এবং হরিপুরে গুদামজাত পাট শান্তি কমিটির সহযোগিতায় অন্যত্র স্থানান্তর করবে এমন সংবাদের ভিত্তিতে ৬ই জুন সুবেদার আলতাফের নেতৃত্বে ২৮ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি গ্রুপ নৌকাযোগে এসে কালিরবাজার ও হরিপুরে অপারেশন চালায়। এ অপারেশনে শান্তি কমিটির একজন প্রভাবশালী নেতা ও দুজন সশস্ত্র রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয় এবং তাদের লুণ্ঠিত মালামাল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। অপারেশন শেষে ফেরার পথে ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীর থেকে হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলি চালালেও মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে তাঁদের অবস্থানে ফিরে যেতে সক্ষম হন। ৭ই ডিসেম্বর সুন্দরগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ৩ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা গেছে। তাঁরা হলেন- আব্দুল আজিজ (পিতা বাবর উদ্দিন বেপারী, ধুমাইটারি), মসলিম উদ্দিন (পিতা জামাল উদ্দিন, ঝিনিয়া) ও করিম মণ্ডল (পিতা আউস উদ্দিন মণ্ডল, পশ্চিম ছাপরহাটি)। সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সদরের বধ্যভূমির ওপর একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে। [জহুরুল কাইয়ুম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড