You dont have javascript enabled! Please enable it!

সুন্দরপুর যুদ্ধ (মাধবপুর, হবিগঞ্জ)

সুন্দরপুর যুদ্ধ (মাধবপুর, হবিগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১৬ই জুলাই। এতে একজন গ্রামবাসী শহীদ এবং বেশ কয়েকজন আহত হন।
মাধবপুর উপজেলার ১১ নং বাঘাসুরা ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম কালিকাপুর। গ্রামটি কালিকাপুর, নোয়াগাঁও, রতনপুর, হারুনপুর, রূপনগর, গঙ্গানগর, উজ্জলপুর প্রভৃতি পাড়ায় বিভক্ত। গ্রামের মাঝখানে কালিকাপুর বাজার অবস্থিত। কালিকাপুরের প্রায় মধ্যভাগে পূর্ব-পশ্চিমে বাঘাসুরা ইউনিয়ন রাস্তা। বাজারের পাশাপাশি ইউনিয়ন অফিস, তহশিল অফিস, কালিকাপুর উচ্চ বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান কালিকাপুরের গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে। বাজারের পূর্ব পাশে নোয়াগাঁও। তার দক্ষিণ দিকে রতনপুর। রূপনগর ও নোয়াগাঁও-এর মাঝখানে দক্ষিণ বরাবর রাস্তাটি রতনপুর গেছে। রতনপুরের পূর্ব পাশে সুন্দরপুর গ্রাম।
১৫ই জুলাই হঠাৎ তিনজন সশস্ত্র পাকসেনা রতনপুরের মোগল হুসেন নামের এক লোকের বাড়িতে গিয়ে তাকে মুরগি ধরে দেয়ার নির্দেশ দেয়। সে ভীত হয়ে মুরগি ধরার নামে ঘরের ভেতর দিয়ে আড়ালে চলে যায়। পাকসেনারা কিছু সময় অপেক্ষা করে ঘরে প্রবেশ করে ঐ লোকটির স্ত্রী দুবরাজ বেগমকে দেখতে পায়। পাকসেনাদের ঘরে ঢুকতে দেখে দুবরাজ হতবুদ্ধি হয়ে যায় এবং নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে। পাকসেনাদের লোলুপ দৃষ্টি লক্ষ করে দুবরাজ ঘর থেকে পালাতে চাইলে তারা তাকে ঝাপটে ধরে। ভয়ার্ত অসহায় এ নারী শত অনুনয়-বিনয় করেও তাদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি। তিন-তিনটি পশু পালাক্রমে তার দেহ নিষ্পেষিত করে। তাদের নৃসংশতায় দুবরাজ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে।
অস্তে-আস্তে পাড়া-প্রতিবেশীরা এসে জড়ো হয়। ততক্ষণে পাকসেনরা এলাকা ছেড়ে হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডের পথে শাহজীবাজার ক্যাম্পের দিকে চলে গেছে। খবর পেয়ে পাড়া-প্রতিবেশীদের পাশাপাশি আশপাশের গ্রামবাসীও আসে। ঘটনার আকস্মিকতা ও বিভৎসতায় তারা সমবেদনার ভাষাও ভুলে যায়। ক্ষোভে-দুঃখে ম্রিয়মাণ জনমানসে অকস্মাৎ জ্বলে ওঠে প্রতিহিংসার স্ফুলিংগ। সকলে প্রতিজ্ঞা করে প্রতিশোধ নেয়ার।
সেদিন ছিল হাটবার। কালিকাপুর বাজারে আগত মানুষের মুখে-মুখে ঘটনার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। তাদের কাছ থেকে নিমেষে সমস্ত এলাকায় জানাজানি হয়ে যায়। দুবরাজ বেগমের আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে এলাকার প্রতিটি মানুষের অন্তরে। প্রত্যেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদের শপথ নিয়ে ঘরে ফেরে। সবার মুখে এক কথা পাকসেনারা যদি আবার আসে তবে ‘যার যা আছে’ তা নিয়েই ছুটে আসবে সবাই।
অনেকে মনে করেছিল, এটি একটি দুর্ঘটনা। খুব তাড়াতাড়ি হয়তো পাকসেনারা আর এদিকে আসবে না। কিন্তু পরদিন ১৬ই জুলাই সকাল আটটার দিকে তারা গ্যাস ফিল্ডের পথে সুন্দরপুর হয়ে রতনপুরের দিকে আসতে থাকে। সুন্দরপুর এবং রতনপুরের মাঝখানে ছোট্ট একটি ফসলি মাঠ। পাকসেনারা সুন্দরপুর আসতেই স্থানীয় লোকজন ‘কুহু’ ধ্বনিতে সংকেত দিতে থাকে। নিমেষে ‘কুহু’ ধ্বনি রতনপুর, নোয়াগাঁও, কালিকাপুর, রূপনগর, গঙ্গানগর, উজ্জলপুর, হারুনপুর, ভাটিসুন্দরপুর প্রভৃতি গ্রাম মুখরিত করে তুলে। সঙ্গে-সঙ্গে সকলেই লাটিসোঁটা নিয়ে রতনপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
সুন্দরপুর এবং রতনপুরের প্রায় মাঝামাঝি স্থানে রাস্তায় খাকি পোশাক পরিহিত স্টেনগান হাতে তিনজন পাকসেনা। তাদের সঙ্গে ইস্কান্দর নামে স্থানীয় একজন প্রাক্তন সৈনিক দাঁড়ানো। তিনি একবার তাদের উদ্দেশে একবার জনগণের উদ্দেশ্যে শান্ত থাকার অনুরোধ করেন। তাদেরকে ঘিরে উত্তর ও পশ্চিমে প্রায় অর্ধচন্দ্রাকারে অসংখ্য মানুষ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে দাড়ানো। কিছুক্ষণ পরপর তাদের ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এতে ভীত- সন্ত্রস্ত হয়ে পাকসেনারা গুলি করার জন্য উদ্যত হয়, আর ইস্কান্দর তাদেরকে থামাতে চেষ্টা করে। এ অবস্থায়ই কিছু লোক মারমুখী হয়ে অগ্রসর হতে থাকলে পাকসেনারা গুলি করতে থাকে।
মারমুখী জনতার মধ্য থেকে হঠাৎ ইসলাম উদ্দিন (পিতা নছম উদ্দিন, রূপনগর) নামে এক অসীম সাহসী ব্যক্তি একটি ফিগল (দেশীয় অস্ত্র) হাতে ‘গুলি নাই, ফাক্কা আওয়াজ’ বলে সামনের দিকে দৌড়ে এগুতে থাকেন। তার দেখাদেখি আরো অনেকে এগিয়ে যায়। খানিকটা এগুতেই ইসলাম উদ্দিন গুলির আঘাতে অকস্মাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। গুলির মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। অবিরাম গুলিবর্ষণ চলে। বহু লোক গুলিবিদ্ধ হয়। কিন্তু এরপরও যুদ্ধংদেহী জনতা সামনে অগ্রসর হতে থাকে। অবস্থার ভয়াবহতা চিন্তা করে পাকসেনারা অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে-করতে পেছন দিকে ক্যাম্পের উদ্দেশে পালাতে থাকে।
পাকবাহিনীর এই নির্বিচার গুলিবর্ষণে আব্দুল আলী (পিতা মো. আতাব উল্লা, রূপনগর) গুরুতর আহত হন। পাকসেনারা চলে যাবার পর আব্দুল আলীসহ আরো যারা আহত হন, তাদের নিজ-নিজ বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি একটি স্মরণীয় ঘটনা। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!