You dont have javascript enabled! Please enable it!

সুন্দরবন প্রতিরোধযুদ্ধ (শরণখোলা, বাগেরহাট)

সুন্দরবন প্রতিরোধযুদ্ধ (শরণখোলা, বাগেরহাট) সংঘটিত হয় ২রা সেপ্টেম্বর। এতে ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
২রা সেপ্টেম্বর মোড়েলগঞ্জ যুদ্ধে বিজয়ের পর সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ সুন্দরবনে তাঁর হেড- কোয়ার্টার্সে ফিরে গিয়ে সহ-মুক্তিযোদ্ধাদের নিকটবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত রাজাকার- ক্যাম্পগুলো আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এ পরিকল্পনায় প্রথম টার্গেট করা হয় মঠবাড়িয়া রাজাকার ক্যাম্প। মোড়েলগঞ্জ বিজয়ের সপ্তাখানেকের মধ্যেই খবর আসে যে, মোড়েলগঞ্জে রাজাকাররা পুনরায় সংগঠিত হচ্ছে। রাজাকাররা পাকবাহিনীর সহায়তা নিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর হত্যা, নির্যাতন ও অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যে বাড়ির বাগানে বসে মোড়েলগঞ্জ যুদ্ধে রাজাকারদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, সে বাড়ির মালিক আব্দুর রহমান খান ও তার পুত্র মারুফ হোসেনকে রাজাকাররা নির্মমভাবে হত্যা করে। তারা আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আব্দুল মজিদ ও ন্যাপ নেতা সাহাব উদ্দিনকে হত্যা করে। আরো খবর আসে যে, পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে জেনে গেছে। যে-কোনো সময় তারা সুন্দরবনে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ করতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তার জন্য মেজর জিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করেন। হানাদার বাহিনী যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের হেড-কোয়ার্টার্সের নিকটবর্তী হতে না পারে, সেজন্য মুক্তিযোদ্ধাদের স্থল ও নৌপথের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পাহারায় বসান হয়।
মেজর জিয়া ২রা সেপ্টেম্বর ভোরবেলায় কয়েকটি নৌকায় ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মঠবাড়িয়া থানা ও রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের লক্ষ্যে হেড-কোয়ার্টার্স থেকে রওনা হন। শরণখোলা বেজ অফিসের কাছাকাছি আসতেই তিনি দেখতে পান ভোলা নদী দিয়ে মংলা থেকে চারটি গানবোট রেঞ্জ অফিসের দিকে আসছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য মেজর জিয়া নৌকাগুলো শরণখোলা বেড়িবাঁধের নিকট ভিড়িয়ে পানিতে ডুবিয়ে দেন। সহ-মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি বেড়িবাঁধের অপর পাশে আত্মগোপন করেন এবং গানবোট প্রতিহত করার প্রস্তুতি নেন। গানবোটগুলো রেঞ্জ অফিসের ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছে। একটি গানবোট তীরে এসে ভেড়ে। নোঙ্গরকৃত গানবোটের আরোহী পাকবাহিনী স্থলপথে নেমে নৌকার আরোহী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিসের ভেতর লিয়াকত আলী খানসহ ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তখনো ঘুমন্ত ছিলেন। গানবোটের শব্দে তাঁদের ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙ্গতেই তাঁরা দেখতে পান অফিসের ঘাটে একটি গানবোট ভেড়ানো। সিঁড়ি দিয়ে কয়েকজন পাকসেনা নেমে আসছে। তাৎক্ষণিকভাবে লিয়াকত আলী খানের মুক্তিযোদ্ধা দল পজিশনে গিয়ে পাকবাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলি খেয়ে ৩ জন পাকসেনা সিঁড়ির ওপর থেকে নিচে পড়ে মারা যায়। গানবোটটি তখন লাশ ফেলে নদীর মাঝখানে সরে গিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারাও পিছু ধাওয়া করে গানবোটটির দিকে অবিরাম গুলি বর্ষণ করেন। এ-সময় তাঁরা দেখতে পান নদীর মধ্যে অবস্থিত পাকসেনাদের আরো ২টি গানবোট মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে অবিরাম গুলি ছুড়ছে। কিছু সময় পর পালিয়ে যাওয়া গানবোটটি কভারিং ফায়ারের মধ্য দিয়ে পুনরায় রেঞ্জ অফিসের ঘাটে এসে ভেড়ে এবং ফেলে যাওয়া লাশগুলো সংগ্রহ করে চলে যায়। একই সময় গোলাবুনিয়া খালের নিকটবর্তী স্থল থেকে কভারিং ফায়াররত গানবোট লক্ষ্য করে মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আব্দুল গফফার গ্রেনেড চার্জ করেন। এতে একটি গানবোট বিধ্বস্ত হয়, আরেকটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধারা মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকেন এবং ভোলা নদীর পাড় থেকে পলায়নরত গানবোট লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকেন। এতে আরেকটি গানবোটও বিকল হয়ে যায়। গানবোটগুলো বিকল হয়ে নদীর মাঝখানে স্থির হয়। পাকসেনারা নদীর দুই তীর লক্ষ্য করে অব্যাহত গোলা নিক্ষেপ করে। মুক্তিযোদ্ধারা বেড়িবাঁধের আড়াল ও গভীর জঙ্গলে অবস্থান করায় তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। এক পর্যায়ে গোলার একটি অংশ মুক্তিযোদ্ধা হালিম তালুকদার এবং সামছুদ্দিনের হাতে লাগে। এতে তাঁরা আহত হন। পরের দিন ৩রা সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে খবর আসে যে, পিরোজপুর থেকে আরো ২টি গানবোট বগি বন্দরের কাছাকাছি পৌঁছেছে। সেখানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গানবোট ঠেকানো বা মোকাবেলা করার মতো কোনো অস্ত্র নেই। এ অবস্থায় জিয়াউদ্দিন কয়েকজন সহযোদ্ধাসহ এ্যনার্গা গ্রেনেড নিয়ে দ্রুত বগিতে পৌঁছান। বগিতে গিয়ে তিনি দেখতে পান গানবোট ২টি বলেশ্বর নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। পাকহানাদার বাহিনী এ অবস্থায় গোলা ছুড়তে-ছুড়তে সুন্দরবনের দিকে চলে যায় এবং উত্তর দিক দিয়ে পিরোজপুরে প্রত্যাবর্তন করে।
যুদ্ধের থেমে গেলে বেলা ১টার দিকে খালের পাড়ে অবস্থিত মুদি দোকান থেকে গুড়মুড়ি সংগ্রহ করে কমান্ডার জিয়াউদ্দিন ও তাঁর সহযোদ্ধারা সকালের নাস্তা করেন। বিকেল ৪টার দিকে তাঁরা শরণখোলা গ্রামে ফিরে যান। এ- সময় মংলা থেকে আসা পাকবাহিনীর আরো ২টি গানবোট প্রবল গোলাবর্ষণ করে এবং তাদের বিকল হওয়া গানবোটগুলো নিয়ে মংলার দিকে চলে যায়। সারাদিন মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধ করে ক্লান্ত ও অনাহারী ছিলেন। শরণখোলাবাসী তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে। [শেখ মশিউর রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!