সুন্দরবনে পাকবাহিনীর গানবোট হামলা (শরণখোলা, বাগেরহাট)
সুন্দরবনে পাকবাহিনীর গানবোট হামলা (শরণখোলা, বাগেরহাট) পরিচালিত হয় ১৫-২৬শে অক্টোবর পর্যন্ত। এতে ৫ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়।
১৫ই অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা তুষখালি সরকারি খাদ্য গুদামে পাহারারত রাজাকার- ও পার্শ্ববর্তী রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে রাজাকাররা পরাভূত হয়। তদের কাছ থেকে দখলকৃত অস্ত্রশস্ত্রসহ মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে সুন্দরবনে ফিরে আসেন। এর পরপর পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরিশাল, বাগেরহাট, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ভোলা, মংলা ও খুলনায় অবস্থানরত পাকবাহিনী একযোগে সুন্দরবনে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে আক্রমণ শুরু করে। বাগেরহাট ও পিরোজপুরের রাজাকার বাহিনীর সদস্যরাও পাকবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। এর ফলে হানাদার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা কয়েক হাজারে দাঁড়ায়। বিশেষভাবে খুলনায় অবস্থানরত বেলুচ রেজিমেন্টের সকল সৈন্য এ অভিযানে যোগ দেয়। অভিযানে সুন্দরবনে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্প লক্ষ করে হানাদার বাহিনীর গানবোটগুলো থেকে মুহুর্মুহু গোলা নিক্ষিপ্ত হয়। ১৫ই অক্টোবর থেকে ১২ দিন পর্যন্ত অব্যাহতভাবে এ হামলা চলে। হামলায় পাকবাহিনী বোমারু বিমান ব্যবহার করে। পাকবাহিনীর পক্ষ থেকে গানবোট ও বিমান হামলার নেতৃত্ব দেয় পটুয়াখালীতে অবস্থানরত বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর নাদের পারভেজ। এ আক্রমণে পটুয়াখালী থেকে পাকবাহিনীর ৬টি গানবোট, মর্টার সজ্জিত কয়েকটি লঞ্চ, পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও রাজাকার বাহিনী যোগ দেয়। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনী সুন্দরবনের পূর্ব প্রান্তে বলেশ্বর নদীতে পৌছায়। তারা বলেশ্বর নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত সুন্দরবন অঞ্চলে এলোপাথাড়ি গোলাবর্ষণ করে। পাকবাহিনীর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী খুলনা, মংলা, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও বরিশাল থেকে আরো অসংখ্য গানবোট ও লঞ্চ এসে এ অভিযানে যোগ দেয়। তারা সুন্দরবনের চারদিক ঘিরে ফেলে। মিরেজ ফাইটার বিমান থেকে সুন্দরবনে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা পরিচালনা করা হয়। পাকিস্তানি সম্মিলিত বাহিনী প্রত্যহ দিনের বেলা আক্রমণ পরিচালনা করত, আর রাতের বেলা তারা সুন্দরবন থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করত। এসব প্রতিকূল অবস্থার ভেতরেও মুক্তিযোদ্ধারা বলেশ্বর নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত সুন্দরবনের বিভিন্ন অবস্থান থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে পাল্টা আক্রমণের কৌশল অবলম্বন করে হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করতে থাকেন। ২১শে অক্টোবর রাজাকার ও পাকবাহিনীর সঙ্গে বগিতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের এক বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে এর নেতৃত্ব দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার আলাউদ্দিন। সহযোগী কমান্ডার ছিলেন নুরুল ইসলাম ক্যাশিয়ার। নুরুল ইসলাম ক্যাশিয়ারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল আগে থেকেই যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য সংগঠিত ছিল। সংঘর্ষের পরপর কয়েকটি গানবোট বগি এলাকায় এসে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। তবে গানবোটগুলো বন অফিসের দিকে না গিয়ে উত্তরে অবস্থিত গাবতলা গেটের নিকট এসে ভেড়ে। পাকবাহিনী গানবোট থেকে অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। সেখানে পূর্ব থেকেই অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বেলায়েত হোসেন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে গানবোট লক্ষ করে গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখেন। উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ গুলি বিনিময় হয়। পাকবাহিনীর অবিরাম গুলিবর্ষণের মুখে মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার বেলায়েত হোসেন টিকতে না পেরে পিছু সরে আসেন। এই ফাঁকে পাকবাহিনী গানবোট থেকে রাস্তায় নেমে ব্রাশ ফায়ার করতে-করতে বগির দিকে অগ্রসর হয়। পাকবাহিনীর গুলিতে ধানক্ষেতে অবস্থানরত গাবতলা ও বগি গ্রামের ৫ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হয়। এরপর পাকসেনারা ৬টি গানবোট নিয়ে বগি বন্দরে হামলা চালায়। বগি বন অফিস লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করে। গুলির আঘাতে বন অফিসের দরজা-জানালা ও ছাদ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা তখন ঐ ভবনে ছিলেন না। তাঁরা তখন কমান্ডার আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে নদীর তীরে অবস্থিত কয়েকটি দুর্ভেদ্য বাংকারে অবস্থান করছিলেন। পাকসেনাদের প্রচণ্ড গুলির মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা জবাব না দিয়ে চুপচাপ ছিলেন। এরূপ অবস্থায় এ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আর কোনো অবস্থান নেই ভেবে পাকসেনারা গানবোটগুলো নদীর তীরে ভেড়ায় এবং তীরে নামার প্রস্তুতি নেয়। সেই মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধারা হাবিলদার আলাউদ্দিনের নির্দেশে এলএমজি ও অটো রাইফেল থেকে গানবোট লক্ষ করে ব্রাশ ফায়ার শুরু করেন। এতে গানবোটের ওপরে থাকা বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত ও আহত হয়। এ-সময় কাছাকাছি দূরত্বের একটি বাংকারে অবস্থান নেয়া নূরু ক্যাশিয়ার এবং সহযোদ্ধা আব্দুল হাকিম গানবোট লক্ষ করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। তবে অল্পের জন্য তা লক্ষ্যচ্যুত হয়। মেজর জিয়াউদ্দিন এ-সময় তাফালবাড়ি ও গাবতলীর মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করছিলেন। দুপুরের দিকে তিনি যখন বগিতে এসে পৌঁছান, তখন উপস্থিত সকল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলাউদ্দিনের কৃতিত্বের কথা তাঁকে জানান। তখনো পাকবাহিনীর গানবোটগুলো বগিতে অবস্থান করছিল। সেগুলো আবারো ফিরে আসতে পারে ভেবে মেজর জিয়াউদ্দিন শরণখোলা থেকে আরো একদল মুক্তিযোদ্ধাকে বগিতে আসার নির্দেশ দেন। গানবোটগুলো আর কোনো আক্রমণ না করে বরং বিকেল বেলা সুভতির দিকে চলে যায়। এ-যুদ্ধে একটি গানবোটের ৬ জন আরেকটির ৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। [শেখ মশিউর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড