সুন্দরবনের শেলা নদীতে পাকিস্তানি হানাদারদের গানবোটে হামলা (শরণখোলা, বাগেরহাট)
সুন্দরবনের শেলা নদীতে পাকিস্তানি হানাদারদের গানবোটে হামলা (শরণখোলা, বাগেরহাট) পরিচালিত হয় ২২শে সেপ্টেম্বর। এতে ৫০ জন পাকসেনা নিহত ও অনেকে আহত হয়।
১৮ই আগস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পূর্ব সুন্দরবনের ভোলা নদীতে একটি পাকিস্তানি গানবোট ঘায়েল হয়। এ ঘটনার পর থেকে ভোলা নদীতে পাকবাহিনীর গানবোটের টহল বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে পাকিস্তানি হানাদাররা মংলা- ঢাকা বা ঢাকা-মংলা নৌচলাচল রুট এড়িয়ে চলে। তারা শেলা নদী ঘুরে বলেশ্বর বিকল্প নদীপথে ঢাকা-মংলা নৌরুট ব্যবহার করছিল। ২০শে সেপ্টেম্বর সুভতিতে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধা চৌকি থেকে কমান্ডার জিয়াউদ্দিনের কাছে খবর আসে যে, ঐ পথে প্রায় নিয়মিতভাবে পাকসেনাবাহিনীর খাদ্যবাহী জাহাজ ও স্টিমার চলাচল করছে। সেনাবাহিনী বহনকারী কোনো নৌযান দেখামাত্র তা আক্রমণ করার জন্য জিয়াউদ্দিন তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ দেন। নির্দেশ অনুযায়ী মুক্তিবাহিনীর অর্ধ শতাধিক গেরিলাযোদ্ধা শেলা নদীর উত্তর তীরে অবস্থান করেন। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অবস্থান থেকে পাকসেনা ভর্তি একটি স্টিমার লক্ষ করে গুলি চালান। কিন্তু পাকসেনারা স্টিমারের ছাদে বালির বস্তা দিয়ে বানানো বাংকারের পেছন দিক থেকে ভারী মেশিন গানের পাল্টা গুলি ছুড়ে কোনোরূপ ক্ষতি ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের আওতার বাইরে চলে যায়। এ ঘটনার দুদিন পর মুক্তিযোদ্ধারা অভিনব একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। স্থানীয় হাট-বাজার থেকে তাঁরা শতাধিক নতুন গামছা সংগ্রহ করেন। শেলা নদীর যে স্থানটি বনের খুব কাছ দিয়ে প্রবাহিত, সেখানকার বড়-বড় গাছে কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে উঠিয়ে দেয়া হয়। গাছে উঠে তাঁরা নিজেদের শরীর গামছা দিয়ে গাছের ডালের সঙ্গে খুব শক্ত করে বাঁধেন। এরপর তাঁরা সুবিধামতো পজিশন নেন। তৃতীয় ও চতুর্থ দিনের মাথায় পাকসেনা বহনকারী একটি স্টিমার মুক্তিযোদ্ধাদের ফায়ার রেঞ্জের মধ্যে আসতেই স্টিমারের ছাদে অবস্থানরত পাকসেনাদের লক্ষ করে গেরিলারা গাছের উঁচু থেকে ব্রাশ ফায়ার শুরু করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ছোড়া গুলিতে ছাদে অবস্থানরত ৫০ জন পাকসেনা নিহত ও অনেকে আহত হয়। পাকসেনাদের কাছে এমন ঘটনা ছিল অপ্রত্যাশিত। যে পাক সেনাটি স্টিমারের বাংকারে বসে ভারী মেশিনগান চালাচ্ছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে সেও নিহত হয়। এ অবস্থায় স্টিমারের সারেং- সুকানি নিরাপদ স্থানে আশ্রয়ের খোঁজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে নিয়ন্ত্রণহীন স্টিমার প্রবল জোয়ারের তোড়ে ভাসতে-ভাসতে মুক্তিযোদ্ধাদের ফায়ার রেঞ্জের বাইরে চলে যায়। কিছু সময় পর ইঞ্জিন পুনরায় চালু হলে প্রাণে বেঁচে যাওয়া পাকসেনারা খুলনার দিকে চলে যায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২৩শে ডিসেম্বর মেজর জিয়াউদ্দিন খুলনা সার্কিট হাউজে অবস্থান করছিলেন। তখন খুলনার সিভিল সার্জন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। পরিচয় পর্বের পর এক পর্যায়ে সিভিল সার্জন মেজর জিয়াউদ্দিনকে জানান, সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে হাসপাতালে ৭০ জন পাকসেনা ভর্তি হয়। তারা প্রত্যেকেই বুলেটবিদ্ধ ছিল। হাসপাতালের বিছানায় গুলিবিদ্ধ আহত সেনারা কাতরাচ্ছিল আর বলছিল ‘সুন্দরবনকা সারা দেরাকত মে মুক্তি হায়’ অর্থাৎ সুন্দরবনের গাছে-গাছে মুক্তিযোদ্ধা। [শেখ মশিউর রহমান] সুন্দিশাইল গণহত্যা (গোলাপগঞ্জ, সিলেট) সংঘটিত হয় ২৫ ও ২৬শে অক্টোবর। এতে ২৩ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন।
ভারতের বারপুঞ্জি ক্যাম্প থেকে এসে ৩৬ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল গোলাপগঞ্জ থানার সুন্দিশাইল গ্রামের মোকাম টিলায় অবস্থান নেন। দীর্ঘ পথ হেঁটে পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রামবাসী খাদ্য ও আশ্রয় দেয়। ২৫শে অক্টোবর সকালে পার্শ্ববর্তী আমুড়া গ্রামের রাজাকার- ঈমানী সুন্দিশাইলে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করতে থাকে এবং তাঁদের ধরিয়ে না দিলে পাকবাহিনীকে ডেকে এনে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। এ-সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা মোকাম টিলা থেকে নিচে নেমে এসে ঈমানীকে লক্ষ করে গুলি ছোড়েন। কিন্তু গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং ঈমানী পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পর আতঙ্কিত গ্রামবাসী পার্শ্ববর্তী রানাপিং- এ পালিয়ে যায়। মোকাম টিলায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান অব্যাহত থাকে। বেলা ১২টার দিকে বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও রাজাকার তিন দিক থেকে সুন্দিশাইল গ্রামে হামলা চালায়। তারা ১৮ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পাকসেনারা আবার ২৬শে অক্টোবর সুন্দিশাইল গ্রামে গণহত্যা চালায়। এ-সময় সুন্দিশাইল ও কালীডহর গ্রামের ৫ জন প্রাণ হারান। দুদিনের গণহত্যায় নিহত যাদের নাম জানা যায়। তারা হলেন- সুন্দিশাইল গ্রামের খুর্শেদ আলী, আসদ আলী, তুতা মিয়া, চান্দ মিয়া, মুবেশ্বর আলী, কুটুচান্দ মিয়া, ওয়ারিছ আলী, মস্তন আলী, ওহাব আলী, সুনু মিয়া, মাতাই মিয়া, আনু মিয়া, কুটলা মিয়া, মানিক মিয়া, খালিক মিয়া, সমুজ আলী এবং কালীডহর গ্রামের (বুধবারী বাজার ইউনিয়ন) চুনু মিয়া ও মুতলিব আলী পাকসেনা ও রাজাকারদের নির্যাতনে নিহত হন। এর দুদিন পর গ্রামে ফিরে এসে গ্রামবাসী নিহতদের বিভিন্ন স্থানে দাফন করে। রাজাকার ঈমানী ছাড়াও শান্তি কমিটির সভাপতি সাদেক আহমদ চৌধুরী (রণকেলী), শান্তি কমিটির সহ-সভাপতি হোসেন আহমদ চৌধুরী হাছনু মিয়া (রণকেলী), আব্দুল মালিক চৌধুরী মাখন মিয়া (আমুড়া), মুহিব উদ্দিন মইয়ব (আমুড়া)-সহ আরো অনেক রাজাকার এ হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করে।
সুন্দিশাইলের ২ দিনের গণহত্যায় শহীদ ২৩ জনের (১৯ জনের নামসহ) স্মরণে নির্মিত হয় নামাঙ্কিত স্মৃতিস্তম্ভ। [কাজল কান্তি দাস]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড