You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে সুবর্ণচর উপজেলা (নোয়াখালী) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে সুবর্ণচর উপজেলা (নোয়াখালী)

সুবর্ণচর উপজেলা (নোয়াখালী) নোয়াখালী জেলার একটি উপকুলীয় অঞ্চল। জেলা সদর থেকে এর দূরত্ব ৩০ কিলোমিটারের মতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় সুবর্ণচর ছিল একটি ইউনিয়ন। ২০০৬ সালে এটি উপজেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার সংবাদ শুনে সমগ্র বাংলাদেশের ন্যায় এ উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতৃত্বে খাসের হাট, আটকোপালিয়া বাজার (বর্তমান উপজেলা হেডকোয়ার্টার্স সংলগ্ন)-সহ বিভিন্ন গ্রামের বাজারে বিশাল মিছিল বের করে বড়বড় রাস্তা প্রদক্ষিণ করে বিক্ষোভ প্রকাশ করে। মিছিলে অংশগ্রহণকারী শতশত ছাত্র-জনতা রেডিও পাকিস্তানের সংবাদ বুলেটিন প্রত্যাখ্যান করে এবং জেলা হেডকোয়ার্টার্স মাইজদীর সঙ্গে যোগাযোগ করে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে।
মুক্তিযুদ্ধকালে এ উপজেলা ছিল প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের একটি ইউনিয়ন এবং রাস্তাঘাট ছিল কাঁচা। কোনো অফিস-আদালত ছিল না। বাড়িঘরও ছিল দূর-দূরান্তে। এ অঞ্চলের প্রতিবাদমুখর ছাত্র-জনতা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জেলা হেডকোয়ার্টার্সে গিয়ে মিটিং-মিছিলে অংশ নিতেন এবং সকল কর্মসূচি বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন। এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন আজিজুল হক শান্ত, আবদুল খালেক মিয়া, ফজলুল হক, খায়রুল আলম সেলিম (বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান), নুর মোহাম্মদ কাজী, মহিব উল্যা (উকিল), সেকান্দর আলম মাস্টার, আনছার আলী মেম্বার, মকবুল আহাম্মদ, ক্ষিতীশ বাবু বিকম, ছিদ্দিক চেয়ারম্যান, মাওলানা হাবিব উল্যা প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণর-এর পর এ অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্রনেতারা প্রায় প্রতিদিনই মাইজদীতে গিয়ে জেলা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। আনছার মিয়ার হাট, খাসের হাট ও চর আমান উল্যাতে বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। অবসরপ্রাপ্ত এবং ছুটিতে আসা পুলিশ ও সেনা-সদস্যরা প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এ অঞ্চলের কিছু তরুণ উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। মে মাসে সুবিমল দাস (পিতা বড়দা প্রসন্ন দাস, চর আমান উল্যা; চৌমুহনী কলেজের ছাত্র, বর্তমানে সুবর্ণচর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার) ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত দেরাদুন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে তাঁকে সহযোগিতা করেন মোস্তাফিজুর রহমান এবং মাহমুদুর রহমান বেলায়েত (জেলা মুজিব বাহিনীর প্রধান, মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী এমপি)। আগস্ট মাসের শেষদিকে দেশে ফিরে তিনি মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসেবে কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট ও মাইজদী অপারেশনে অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সুবর্ণচর ছিল সুধারাম থানার অধীন এখানে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন জেলা হেডকোয়ার্টার্সের মুক্তিযোদ্ধারা। স্থানীয়ভাবে কোনো কমান্ডার না থাকলেও বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের মধ্যে সুবিমল দাস, সফিকুল আলম, আবু তাহের বিশ্বাস, মো. আলী আক্কাছ, জাফর আহাম্মদ, আবু বকর ছিদ্দিক, মাওলানা হাবিব উল্যা, ভূষণ কুমার দাস, সিপাহি নুর আলম ও শহীদ জয়নাল আবেদীন ছিলেন উল্লেখযোগ্য।
সুবর্ণচর উপজেলা মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত। মেঘনা নদীর জলোচ্ছ্বাস থেকে এ জনপদকে রক্ষার জন্য একটি বেড়িবাঁধ ছিল। পাকবাহিনী নদীপথে এসে এ এলাকাসহ মাইজদী হেডকোয়ার্টার্সে যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা এবং সাধারণ মানুষ বহু স্থানে বেড়িবাঁধ কেটে এবং নদীতে স্থাপিত দিকনির্দেশনা বাতি ভেঙ্গে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
দুর্গম চরাঞ্চল হওয়ায় এবং মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় অধিবাসীরা যুদ্ধের প্রারম্ভে বেড়িবাঁধ কেটে ফেলায় পাকবাহিনী এ উপজেলায় প্রবেশ করতে পারেনি। তবে সেন্টার বাজারে একটি অস্থায়ী রাজাকার ক্যাম্প ছিল।
আবু সাওদাগর, করিম চৌধুরী, মাওলানা সামছুল হক ও মৌলবী ওবায়দুল হক ছিল এ উপজেলায় পাকবাহিনীর দোসর। এদের নেতৃত্বে এখানে রাজাকার বাহিনী সৃষ্টি হয়, যারা মাইজদীসহ জেলার বিভিন্ন রাজাকার ক্যাম্পে পাকিস্তানিদের সঙ্গে থেকে মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে।
উপজেলার সেন্টার বাজারে স্বল্প সময়ের জন্য কিছু রাজাকার ছিল। তারা অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে মাইজদীতে চলে আসে। ৭ই ডিসেম্বর এ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। সুবর্ণচর উপজেলার একমাত্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন জয়নাল আবেদীন (পিতা ডা. মকবুল আহমেদ, চরজুবলী)। উপজেলার আটকোপালিয়া বাজারে শহীদ জয়নাল আবেদীনের নামে একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। [রুবাইয়া ইয়াসমিন কলি]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড