You dont have javascript enabled! Please enable it!

সুজানগর থানা যুদ্ধ (সুজানগর, পাবনা)

সুজানগর থানা যুদ্ধ (সুজানগর, পাবনা) সংঘটিত হয় ১১ থেকে ১৩ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। এতে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। হানাদাররা ১৩ই ডিসেম্বর গভীর রাতে পালিয়ে গেলে ১৪ই ডিসেম্বর সুজানগর থানা হানাদারমুক্ত হয়। ১০ই ডিসেম্বর রাত ৯টায় মো. জহুরুল ইসলাম বিশু (সুজানগর থানা মুজিব বাহিনীর ডেপুটি লিডার)-এর নেতৃত্বাধীন সকল মুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা ছাদেকের বাড়িতে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। বাড়িটি ছিল সুজানগর থানা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। সুজানগর থানা এবং তার পাশে সুজানগর হাইস্কুলে তখন প্রায় ২০০ জন পাকসেনা, রাজাকার- ও মিলিশিয়া- অবস্থান করছিল। সন্ধ্যা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা যথাস্থানে সমবেত হতে শুরু করেন। রাত ৮টায় মুক্তিবাহিনীর পাবনা জেলা কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বকুল ও সুজানগর থানা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ইকবাল হোসেন এসে পৌঁছান। রাত ৯টার মধ্যে সেখানে প্রায় ৩০০ মুক্তিযোদ্ধা জমায়েত হন। রাত ১২টার দিকে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের মোট ৭টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। প্রত্যেক গ্রুপের জন্য একজন করে কুরিয়ার ঠিক করা হয়। তাদের কাজ হবে মুক্তিযোদ্ধাদের পজিশনের নির্দিষ্ট স্থান দেখিয়ে দেয়া। যুদ্ধে সার্বিক নেতৃত্ব দেবেন রফিকুল ইসলাম বকুল। মো. জহুরুল ইসলাম বিশু, ইকবাল হোসেন, ইব্রাহিম মোস্তফা দুলাল, শামছুল আলম, আব্দুর রাজ্জাক, নূরুল ইসলাম নূর এবং আব্দুস সামাদ এঁদের প্রত্যেকের ওপর একেকটি গ্রুপের নেতৃত্ব প্রদান করা হয়। কে কোন পজিশনের দায়িত্বে থাকবেন, কোন গ্রুপের কুরিয়ার কে হবে, কীভাবে যুদ্ধ শুরু হবে, নতুন করে পাবনা থেকে সেনাবাহিনী আসার চেষ্টা করলে কী করতে হবে, হানাদাররা নদীপথে গানবোটে করে এলে কীভাবে তাদের প্রতিহত করতে হবে ইত্যাদি বিষয় বিস্তারিতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বুঝিয়ে দেয়া হয়।
১১ই ডিসেম্বর রাত ১টা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন পজিশনে পাঠনো হয়। ৫০ জনের একটি গ্রুপ পাঠানো হয় বাজার ছেড়ে একটু দূরে, যাদের কাজ হবে পাবনা থেকে আর্মি এলে তাদের প্রতিহত করা এবং থানা থেকে আর্মি, রাজাকার বা মিলিশিয়া এদিক দিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে তাদের আক্রমণ করা। ৫০ জনের আরেকটি গ্রুপ চলে যায় থানা থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে সাতবাড়িয়ার দিকে। তাদের কাজ নদীপথে পাকিস্তানি বাহিনী এলে তাদের প্রতিহত করা। বাকি গ্রুপগুলোকে তাদের নির্দিষ্ট পজিশনে পাঠিয়ে দিয়ে মো. জহুরুল ইসলাম বিশু ও দুলাল তাঁদের গ্রুপ নিয়ে রওনা দেন। রাত ৪টার দিকে যুদ্ধ শুরুর সিগনাল হিসেবে বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যার দায়িত্বে ছিলেন ইকবাল হোসেন। সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হয় থানার ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ। গোলাগুলির শব্দে সমগ্র এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সময় গড়িয়ে সকাল হয়ে যায়। ক্রমশ যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে। গ্রামগঞ্জের লোকজন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রুটি, খিচুড়িসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার নিয়ে আসে।
মো. জহুরুল ইসলাম বিশু, দুলাল, হাই, তোফা, সামাদ, কাদেরসহ এ গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা থানার খুব কাছ থেকে যুদ্ধ করেন। থানা ভবনের ছাদের ওপর দুটি বাংকার তৈরি করে সেখান থেকে শত্রুরা মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে গুলি ছুড়ছিল। ভবনের নিচে তাদের বাংকার ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা ছিল খুবই বিপজ্জনক। তাই ওপরের বাংকার ভাঙ্গার জন্য একটি এনারগা রাইফেল দিয়ে গ্রেনেড ফায়ার করা হয়। কিন্তু তা ছাদের বাংকারের কাছে পৌছানোর আগেই মাটিতে পড়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এমতাবস্থায় ছাদের ওপরের বাংকার ভাঙ্গার জন্য একটি বাড়ির পাকা মেঝের পাশে আরসিএল গান সেট করা হয়। এরপর মো. জহুরুল ইসলাম বিশু কামানের ফায়ার করলে শত্রুর একটি বাংকারের বেশকিছু অংশ উড়ে যায় এবং বাংকার থেকে গুলির শব্দ আসা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু অন্যান্য স্থান থেকে শত্রুরা তুমুলভাবে গোলাগুলি করতে থাকে।
শত্রুদের আরেকটি বাংকার তখনো অক্ষত। সেটি ভাঙ্গার জন্য মো. জহুরুল ইসলাম বিশু ঘরের দেয়ালের পাশে গানটি সেট করেন। তিনি বাইনোকুলার দিয়ে দোতলার দ্বিতীয় বাংকারে টার্গেট ঠিক করেন। হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ে নিচের বাংকারে। তিনি দেখেন ঐ বাংকার থেকে একজন তাঁর দিকে রাইফেল তাক করে আছে। তিনি তাড়াতাড়ি দেয়ালের আড়ালে সরে যান। একটু অপেক্ষা করে সেখান থেকে মাথা বের না করে শুধু হাত বের করে তিনি ট্রিগারে চাপ দেন। ফলে বাংকারের বেশকিছু অংশ উড়ে যায় এবং দুজন শত্রু বাংকারের ভাঙ্গা অংশসহ মাটিতে পড়ে যায়। এ অবস্থা দেখে মুক্তিযোদ্ধারা স্লোগান দিতে শুরু করেন। অন্যান্য বাংকার থেকে শত্রুরা মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখে।
এদিকে মো. জহুরুল ইসলাম বিশু যখন দেয়ালের পাশ থেকে হাত বের করে আরসিএল গান থেকে ফায়ার করছিলেন, তখন নিচের বাংকার থেকে একটি গুলি এসে তাঁর ডান হাতে লাগে। প্রথমে তিনি তা বুঝতে পারেননি। কিছুক্ষণ পর দেখেন রক্তে তাঁর জামা ভিজে যাচ্ছে। রক্ত যাতে বেশি বের হতে না পারে সেজন্য তিনি কোমরে থাকা গামছা দিয়ে ক্ষতস্থান পেঁচিয়ে দেন এবং গোলাগুলির মধ্যেই চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত বাড়িতে চলে যান।
ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম নূর মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। তাঁর পাশেই ছিলেন অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু এবং হাবিব। তাঁরা একটুর জন্য বেঁচে যান। নূরের মৃতদেহ একটি বাংকারের কাছে পড়া ছিল। ১৩ই ডিসেম্বর গভীর রাতে পিন্টু আর হাবিব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃতদেহ সেখান থেকে নিয়ে আসেন। সুজানগর যুদ্ধের প্রথম শহীদ নূর। এরপর শহীদ হন ইব্রাহিম মোস্তফা দুলাল ও আবু বক্কার। শত্রুর গুলিতে গুরুত্বর আহত হন আনিছুর রহমান সাইদ। তাঁর দুই চোখ অন্ধ হয়ে যায়।
১৩ই ডিসেম্বর বিকেল ৩টায় খবর আসে যে, আতাইকুলার দিক থেকে পাকসেনাদের একটি দল সুজানগরের দিকে আসছে। ইকবাল হোসেন একদল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সেদিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী আর এদিকে না এসে ফিরে যায়। থানার মধ্যে যারা জীবিত ছিল তারা গভীর রাতে পালিয়ে যায়। ১৪ই ডিসেম্বর ভোরে সুজানগর থানা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। সূর্য ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে চারপাশের মানুষজন বিজয়োল্লাস করতে-করতে থানা চত্বরে জমায়েত হতে থাকে। রফিকুল ইসলাম বকুল, ইকবাল হোসেনসহ বহু মুক্তিযোদ্ধা থানার মাঠে জড়ো হন। হঠাৎ তাঁদের মধ্যে এসে উপস্থিত হন স্কয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা স্যামসন এইচ চৌধুরী (মুক্তিযোদ্ধা অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু তাঁর পুত্র)। তিনি পাবনা শহর থেকে এসে সুজানগরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা বকুল তাঁকে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের জন্য অনুরোধ করেন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান আর হাততালির মধ্য দিয়ে তিনি সুজানগরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। [মো. জহুরুল ইসলাম বিশু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!