You dont have javascript enabled! Please enable it!

সুতাবাড়িয়া গণহত্যা (গলাচিপা, পটুয়াখালী)

সুতাবাড়িয়া গণহত্যা (গলাচিপা, পটুয়াখালী) সংঘটিত হয় ৮ই মে। এতে প্রায় অর্ধশত নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। সুতাবাড়িয়া এলাকা ছিল নদীবেষ্টিত। তাই এ স্থানকে নিরাপদ ভেবে পটুয়াখালী ও গলাচিপাসহ আশপাশের শহর ছেড়ে অনেকে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। সকলে ভাবত এ দুর্গম এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আক্রমণ করবে না। তাই ঘটনার দিন সকালবেলা স্থানীয় লোকজন যার-যার কাজে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ তারা দেখতে পেল একটি গানবোট কমলাকান্ত খালে নোঙর করছে। খালটি তখন বড় এবং অত্যন্ত খরস্রোতা ছিল। খালটি চিকনিকান্দি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। এ খালের তীরে হিন্দু অধ্যুষিত পাশাপাশি দুটি গ্রাম সুতাবাড়িয়া ও কুণ্ডপাড়া (মাঝগ্রাম)। গ্রামদুটি গলাচিপা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তর কোণে অবস্থিত। নিভৃত এ গ্রামদুটিতে পাকিস্তানি সেনাদের পথ চিনিয়ে এনেছিল ঐ এলাকারই রাজাকার ও শান্তি কমিটির নেতা মাওলানা আশরাফ আলী খান, হারুন খান, মুসা খান, আবদুল খালেক, শাহজাহান খোন্দকার ও তাদের অনুসারীরা।
অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ২০ জন পাকসেনা এবং উল্লিখিত রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকজন গানবোট থেকে নেমে সোজা চলে আসে সুতাবাড়িয়া গ্রামে। কেউ কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেশিনগান বসিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে। তখন বেলা আনুমানিক ১১টা হবে। হানাদাররা বাড়িঘরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। একদিকে দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলছে, অপরদিকে চলছে মেশিনগানের গুলি। মানুষ প্রাণ বাঁচাতে দিকবিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। কিন্তু মেশিনগানের গুলি তাদের বিদ্ধ করে। রাস্তায়, বাগানে, মাঠে-ঘাটে, বাড়ির উঠানে, ঘরের মধ্যে, ঘরের পেছনে সর্বত্র লাশ আর লাশ। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে প্রায় অর্ধশত হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোককে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ড শেষে বিক্ষিপ্ত লাশগুলো খোলা আকাশের নিচে ফেলে রেখে তারা কুণ্ডুপাড়ার দিকে চলে যায়। বিকেলের দিকে লোকজন এসে লাশগুলো যার-যার বাড়িতে নিয়ে মাটিচাপা দেয়।
সুতাবাড়িয়া গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো— নায়েববাড়ি গণকবর (৬টি), শশীদাস বাড়ি গণকবর (৫টি), ঠাকুর বাড়ি গণকবর (৩টি), সন্নামত বাড়ি গণকবর (২টি) এবং ভূমালি বাড়ি (২টি)। এছাড়া অন্যান্য স্থানেও কয়েকটি গণকবর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।
সুতাবাড়িয়া গণহত্যায় শহীদদের মধ্যে ২৭ জনের নাম- পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- সোনাই সোমাদ্দার (২২) (স্বামী বিমল চন্দ্র সোমাদ্দার, সুতাবাড়িয়া), কালী প্রসন্ন সোমাদ্দার (৬০) (পিতা অভয় চরণ সোমাদ্দার, ঐ), পারুল বালা সোমাদ্দার (৪৫) (স্বামী কালী প্রসন্ন সোমাদ্দার, ঐ), দুলাল দাস (২৫) (পিতা শচীন্দ্র দাস, ঐ), সত্যরঞ্জন দাস (৩৮) (পিতা শশী দাস, ঐ), জগদীশ দাস (১৩) (পিতা সত্যরঞ্জন দাস, ঐ), নিরঞ্জন গাঙ্গুলী (৫৫) (পিতা হীরালাল গাঙ্গুলী, ঐ), অণিমা রানী গাঙ্গুলী (২০) (পিতা নিরঞ্জন গাঙ্গুলী, ঐ), কনক প্রভা গাঙ্গুলী (৫০) (স্বামী নিরঞ্জন গাঙ্গুলী, ঐ), প্রফুল্ল সন্নামত (৬০) (পিতা মহিম সন্নামত, ঐ), রাজবিহারী দাস (৫০) (পিতা রাসবিহারী দাস, ঐ), নিলু রঞ্জন দাস (২০) (পিতা মনোরঞ্জন দাস, ঐ), বাসন্তী রানী দাস (১৯) (স্বামী বঙ্কিম চন্দ্র দাস, ঐ), সুমিত্রা দত্ত (১৩) (পিতা বিশ্বেশ্বর দত্ত, ঐ), বিমল ভুঞ্জমালী (১২) (পিতা মনোরঞ্জন ভুঞ্জমালী, ঐ), বিদ্যাবতী দাস (৭০) (স্বামী ললিত মোহন দাস, ঐ), সাবিত্রী রানী দত্ত (৬০) (স্বামী চন্দ্ৰ কান্ত দত্ত, ঐ), শ্রীকান্ত নাথ (৪০) (পিতা নিশিকান্ত নাথ, ডাকুয়া), বাসুদেব পাল (৪৩) (পিতা গোপাল চন্দ্র পাল, গলাচিপা বন্দর), সুবল কুণ্ডু (৪১) (পিতা নিকুঞ্জ কুণ্ডু, পটুয়াখালী শহর), রমণী মোহন সাহা (৪৫) (পিতা শশিমোহন সাহা, পটুয়াখালী সদর), অরুণ কুণ্ডু (৪৫) (পিতা গুপিনাথ কুণ্ডু, পটুয়াখালী সদর), অমরী দাস (৩৮) (স্বামী রাই চরণ দাস, সুতাবাড়িয়া), ক্ষেত্রমোহন নাথ (৪৮) (পিতা মদন মোহন নাথ, গলাচিপা বন্দর), নিরঞ্জন বিশ্বাস (৪৭) (পিতা শরৎ চন্দ্র বিশ্বাস, গলাচিপা বন্দর), রাধিকা মোহন সাহা (৫০) (স্বামী রাই চরণ সাহা, গলাচিপা বন্দর) এবং রাধেশ্যাম কুণ্ডু (৪৮) (গলাচিপা বন্দর)। সুতাবাড়িয়ার নায়ে বাড়ির গণহত্যা ও গণকবরের স্থানটি ইটের নীচু পিলার দিয়ে চিহ্নিত রয়েছে। শশীদাস বাড়ির গণহত্যা ও গণকবরের স্থানটিও সনাক্তকৃত। [মো. আ. হালিম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!