You dont have javascript enabled! Please enable it!

সুগন্ধা নদীর তীর বধ্যভূমি (ঝালকাঠি সদর)

সুগন্ধা নদীর তীর বধ্যভূমি (ঝালকাঠি সদর) ঝালকাঠি সদর উপজেলার অন্তর্গত। পাকবাহিনী ২৭শে এপ্রিল ঝালকাঠি দখল করার পর থেকেই এখানে শুরু করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। এ-সময় সিরাজ সিকদার (পরবর্তীতে সর্বহারা পার্টির নেতা) পরিচালিত পালবাড়ী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পটি কীৰ্ত্তিপাশায় সরিয়ে নেয়া হয়। পরে সেখান থেকেও অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। হানাদার বাহিনী দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য বন্দর এই ঝালকাঠিতে ২৭শে এপ্রিল বিকেলে অগ্নিসংযোগ করে। এতে কোটি-কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বার্মা অয়েল ডিপোতে অগ্নিসংযোগ করলে ২-৩ দিন ধরে আগুন জ্বলতে থাকে। বহুদূর থেকে সে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যায়। সেদিন থেকে ৮ই ডিসেম্বর ঝালকাঠি মুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত ৭ মাসে পাকবাহিনী এখানে কমপক্ষে ১৫ হাজারের মানুষকে হত্যা করে। তাদের এই হত্যাকাণ্ডের সহযোগী ছিল ঝালকাঠি থানার ওসি সিকান্দার, এসআই শাহ আলম, ইসমাইল, আলতাব, আবদুল বারেক, আজাহার প্রেসিডেন্ট, আবদুর রব, হাফেজ ফয়েজ, আলী হোসেন, আ. হাকিম, আ. আজিজ, সলিমদ্দিন মিয়া, আ. রাজ্জাক, আশ্রাব আলী, মোবারক, আবদুল লতিফ প্রমুখ। এদের সহায়তায় পাকবাহিনী বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনদের ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতনের পর পৌরসভার সম্মুখস্থ সুগন্ধা তীরের এ বধ্যভূমিতে হত্যা করে।
পাকবাহিনী তাদের এ-দেশীয় দোসর মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠিত শান্তি কমিটির সহায়তায় প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে শ-শ নারী-পুরুষকে ধরে আনত। তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে তরুণীদের ঝালকাঠি থানার সন্নিকটস্থ আরসিও ভবনে আটকে রাখা হতো। এসময় তাদের পরনের বস্ত্রাদি খুলে নেয়া হতো, যাতে তারা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা না করতে পারে। এরপর বর্বর পাকবাহিনী, রাজাকার- ও -আলবদর-রা পালাক্রমে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত। অনবরত নির্যাতন আর অনাহারে তারা যখন নিস্তেজ হয়ে পড়ত, তখন সুগন্ধা নদীতীরের এই বধ্যভূমিতে নিয়ে তাদের হত্যা করা হতো। আর পুরুষদের রাখা হতো থানা হাজত, পালবাড়ী মিলিটারি ক্যাম্প, টাউন পুলিশ ফাঁড়ি প্রভৃতি স্থানে। সারারাত তাদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়ে ভোরবেলা সূর্যোদয়ের পূর্বে এ বধ্যভূমিতে এনে হত্যা করা হতো।
কুখ্যাত পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আজমত হায়াত মালিক খানের নেতৃত্বে ও নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ঝালকাঠি, নলছিটি, কাঁঠালিয়া ও রাজাপুরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিরীহ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন, আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক এবং মুক্তিবাহিনীর লোকজনদের ধরে এনে এ বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করত এবং তাদের লাশগুলো নদীতে ভাসিয়ে দিত। এপ্রিল মাসের কোনো একদিন আলী হোসেন ওরফে আলী চেয়ারম্যান এবং আশ্রাব আলী হাওলাদার ওরফে আশ্রাব মেম্বার স্থানীয় এক চৌকিদারের সহায়তায় পোনাবালিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১০৮ জন হিন্দুকে ধরে এনে এখানে হত্যা করে। জুলাই মাস থেকে পাকবাহিনী লোকজনদের হত্যার পর লাশগুলো একত্রে মাটিচাপা দিতে শুরু করে। হত্যাকাণ্ডের শিকার হতভাগ্যদের দিয়ে গর্ত খুড়িয়ে সেই গর্তেই তাদের কবর দেয়া হতো। প্রতিটি গর্তে ১৫-২০টি লাশ কবর দেয়া হয়। এ বধ্যভূমিটি পরবর্তীকালে সুগন্ধা নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যায়। তখন এখান থেকে শহীদদের কঙ্কাল তুলে নিয়ে সিটি পার্কের পূর্বদিকে কবর দিয়ে সেখানে তৈরি করা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। বধ্যভূমিটি পুনরায় চর পড়ে জেগে উঠলেও সেখানে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি, তা চলে গেছে বিভিন্ন লোকের দখলে। ২০১৩ সালের দিকে পৌর মেয়র আফজাল হোসেন বধ্যভূমি এলাকায় একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেন। [শ্যামল চন্দ্র সরকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!