মুক্তিযুদ্ধে সীতাকুণ্ড উপজেলা (চট্টগ্রাম)
সীতাকুণ্ড উপজেলা (চট্টগ্রাম) বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামেই সীতাকুণ্ডের মানুষ পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি জাতি স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ-এর পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তা উপেক্ষা করে ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিলে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন- শুরু হয়। সীতাকুণ্ডের সর্বস্তরের মানুষ আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে স্বাধীনতার আহ্বান জানালে এ উপজেলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।
সীতাকুণ্ড থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ মামুন ও সাধারণ সম্পাদক ডা. এখলাছ উদ্দিন জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করেন। চট্টগ্রাম জেলা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ও জাতীয় পরিষদের সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকীর নির্দেশনা অনুযায়ী সীতাকুণ্ড থানা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত করা হয় ডা. আখতারুজ্জামানকে। অন্যদিকেছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ইউসুফ সালাউদ্দিন নিজ এলাকা সীতাকুণ্ডে এসে ছাত্রলীগ –ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে দফায়-দফায় বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে উপস্থিত থাকতেন থানা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দসহ ছাত্রলীগের এস এম হাসান, আবুল কালাম আজাদ, ফরিদপুরের সিরাজ, স্টেশন মাস্টারের ছেলে শামছুল আলম টিপু, শঙ্কর নারায়ণ, মোহাম্মদ খালেদ প্রমুখ। ছাত্রলীগ নেতা আবুল কালাম আজাদকে আহ্বয়ক করে সীতাকুণ্ড থানা ছাত্র সাংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। স্কুল পর্যায়েও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সীতাকুণ্ড স্কুলের ছাত্র ফছিউল আলমকে আহ্বায়ক ও মোতাহার সিদ্দিকীকে সদস্য সচিব করে স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। থানা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ছিলেন এস এম হাসান ও সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ। এর অন্যান্য সদস্যরা হলেন— জয়নাল, শাহজাহান, মজিব প্রতীক: বাঙালী, রফিক, শামছুল হক প্রমুখ।
২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান, এম এ মামুনসহ নেতৃবৃন্দ সীতাকুণ্ড পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার পীযূষ ভট্টাচার্য-এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি জানতে পারেন। এদিন রাতে এ ঘোষণাটি ভাটিয়ারী ইউনিয়নের সুলতান আহম্মদ চৌধুরী (পিতা দফর আলী চৌধুরী) ব্যক্তিগত টেলিফোনের মাধ্যমে জানতে পারেন। বার্তাটি পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাশেম রাজা, কমান্ডার মুহাম্মদ মিয়া, টি এম ইসমাইলকে জানান। তাৎক্ষণিকভাবে টি এম ইসমাইল, ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ শফি, আলতাফ-এর নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামী ছাত্র-যুবকরা বিএমএ গেইটস্থ ধামার খালের ব্রিজটি ধ্বংসের চেষ্টা করে। একই সঙ্গে স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি দ্রুত প্রচারের জন্য সিলিমপুর ওয়ারলেস অফিসে যোগাযোগ করেন। ২৬শে মার্চ সকাল ৭টার দিকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত অনুরূপ একটি বার্তা সিলিমপুর ওয়ারলেস টাওয়ারের মাধ্যমে আসে, যা পরবর্তীতে বহিঃনোঙরে নোঙর করা বিদেশী জাহাজে ধরা পড়ে। নোঙরে থাকা বিদেশী জাহাজ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তাটি সঙ্গে-সঙ্গে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
এ সময় ছাত্রলীগ নেতা এস এম হাসান, আবুল কালাম আজাদসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ মাইকযোগে ঘোষণাটি প্রচারের জন্য রাস্তায় নেমে পড়েন। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম আর সিদ্দিকীর ব্যক্তিগত জিপ গাড়িতে মাইক বেঁধে ঘোষণার বার্তাটি প্রচার শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা বার্তাটি ছাত্র-জনতার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ সৃষ্টি করে। ২৭শে মার্চ সর্বপ্রথম আর্মি কমিশন কোরের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা হারুন-উর-রশিদের উদ্যোগে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে গজারিয়া দিঘির পাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু হয়। এ ক্যাম্পে থানা ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতৃবৃন্দ সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। টি এম ইসমাইলের নেতৃত্বে ভাটিয়ারী সমুদ্রের বেড়িবাঁধে, সুবেদার আবুল মুনসুরের নেতৃত্বে বাঁশবাড়িয়া পাহাড়ে, নায়েক সফিউল আলমের উদ্যোগে পশ্চিম মহাদেবপুরে, এস এম খোরশেদের নেতৃত্বে মহালঙ্কা ও বাকখালীর বেড়িবাঁধে এবং আনোয়ার উল্ল্যাহর নেতৃত্বে শেখনগর পাহাড়ে স্বাধীনতাকামী ছাত্র- যুবকদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। মুরাদপুরের ওস্তাদ সুবেদার অজিউল্ল্যাহর উদ্যোগে রামগড় স্কুল মাঠে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করা হয়। এপ্রিলের শেষের দিকে স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতা দলে-দলে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রবেশ করতে থাকে। মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী এমএনএ ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতের সহযোগিতা প্রার্থনা করেন। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী সচিন্দ্রলাল সিংহকে নিয়ে দিল্লিতে গিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। এরপর তিনি ত্রিপুরা সেক্টরে যুব প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। থানা আওয়ামী লীগ নেতা এম এ মামুন ও ডা. এখলাছ উদ্দীন এই রিক্রুটিং ক্যাম্প ও ট্রেনিং ক্যাম্পের রাজনৈতিক মোটিভেটর নিযুক্ত হন। রিক্রুটিং ক্যাম্প থেকে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ গ্রুপ হরিণা ক্যাম্প হয়ে উম্পিনগর ক্যাম্পে, সালাউদ্দিন হারুন গ্রুপ হাফলং ট্রেনিং সেন্টারে, মো. আবুল কালাম আজাদ ওরফে আলেকজান্ডার গ্রুপ আসাম রাজ্যের হিফলং সেনা ক্যাম্পে, নূর আহমদ গ্রুপ পশ্চিম উদয়নগর আর্মি ক্যাম্পে, রেহান উদ্দিন রেহান গ্রুপ তিস্তা ক্যাম্পে, মো. নুরুল আলম গ্রুপ উত্তর প্রদেশের টান্ডুয়া যাকাতায় বিএলএফ ক্যাম্পে, এস এম খোরশেদ ও সিরাজউদ্দৌলা গ্রুপ উম্পিনগর ক্যাম্পে, নৌকমান্ডো মো. নুরুল গণি গ্রুপ শান্তিপুর পলাশি মাঠ ক্যাম্পে, এ কে এম সরোয়ার কামাল দুলু দেরাদুন ও টান্ডুয়া ট্রেনিং সেন্টারে, মমিন উল্ল্যাহ গ্রুপ উম্পিনগর ক্যাম্পে, মো. ইউসুফ আলী গ্রুপ উম্পিনগর ক্যাম্পে, এ জেট বজলুল করিম গ্রুপ উত্তর প্রদেশের টান্ডুয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে, জসিম উদ্দীন গ্রুপ বগা-পা ট্রেনিং সেন্টারে, এ কে এম মফিজুর রহমান গ্রুপ উম্পিনগর ক্যাম্পে, আফতাব উদ্দিন আহম্মদ আগরতলা এস ডি বর্মণদের বাড়িস্থ ক্যাম্পে, মো. রুস্তম আলী নাগাল্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারে, এম শামছুল আমিন ত্রিপুরাস্থ পাহাড় ও জঙ্গলে, মেজর এস টি ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে এ কে এম আবু তাহের গ্রুপ উম্পিনগর ব্রে-কোম্পানি ট্রেনিং ক্যাম্পে, মো. শামছুল আলম গ্রুপ আগরতলা উম্মি তেলিমুড়া ক্যাম্পে, শ্রমিক নেতা এ টি এম নিজাম উদ্দিন গ্রুপ হরিণা আর্মি ক্যাম্পে, মো. মোজাফ্ফর হোসেন ও আবদুল মতিন গ্রুপ হাফলং সামরিক ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নেয়। এছাড়া নুরুল হুদা কিছুদিন শ্রীনগর অভ্যর্থনা ক্যাম্পে থেকে প্রশিক্ষণ শুরু না হওয়ায় দেশে ফিরে আসেন। তিনি দ্বিতীয় দফা ত্রিপুরার তিস্তা ক্যাম্পে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। হরিণা ১নং আর্মি ক্যাম্পের চিফ ইন্সট্রাক্টর ছিলেন মুরাদপুরের ওস্তাদ সুবেদার ওজিউল্ল্যাহ। হরিণা রিক্রুটিং ক্যাম্পের রিক্রুটার ছিলেন কাজী সিরাজুল ইসলাম। এ সেক্টরের সাব-কমান্ডিং অফিসার ছিলেন মুরাদপুরের ক্যাপ্টেন শামছুল হুদা। ১নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম। যুদ্ধের শুরুতে কিছুদিনের জন্য মেজর জিয়াউর রহমান- এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন।
সীতাকুণ্ড উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে যাঁরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা হলেন- ডা. আখতারুজ্জামান (থানা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক), এম এ মামুন (থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি), ডা. এখলাছ উদ্দীন (থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী, নুরুল আলম কোম্পানি, জাফর আহম্মদ চৌধুরী (ন্যাপ নেতা), এ টি এম নিজাম উদ্দীন (শ্রমিক নেতা), নুর আহম্মদ (ভাটিয়ারি এলাকার শ্রমিক নেতা), এস এম হাসান (থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক), নুরুল আলম কালু, আলম হাসেম (উত্তর ছলিমপুর), কামাল কাদের (নাট্যকার), শামছুদ্দোহা (প্রফেসর), মাহবুবুল আলম, হারুন উর রশিদ (প্রফেসর), ডা. আফাজ উল্ল্যাহ, আইনুল করিম, আহম্মদ শামছুদ্দিন, শফিউর রহমান ওরফে ফকির ভূঁইয়া, ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল আবছার, মিজান কেরানি, তোফায়েল আহম্মদ, বি এ দেলোয়ার হোসেন, হাফেজুর রহমান, জহুর ইসলাম চৌধুরী, বকু সওদাগর, আহমদুর রহমান, ডা. প্রমোদ দাশ, রামমোহন চৌধুরী, ডা. জগবন্ধু নাথ, সফি উল্ল্যাহ সওদাগর, গোলাম রহমান সওদাগর, মুলকুতের রহমান, মনা শীল, ডা. এ কে এম ওয়াহিদী, আবুল কালাম আজাদ, ডা. ফয়েজ আহম্মদ, নুরুল ইসলাম চেয়ারম্যান প্রমুখ। এ উপজেলার যুদ্ধকালীন থানা কমান্ডার ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার ইউসুফ সালাউদ্দিন (এফএফ) এবং কাজি সিরাজুল আলম (বিএলএফ)।
২৬শে মার্চ রাতে কুমিল্লা থেকে একটি পাকিস্তানি কনভয় চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ খবর পেয়ে সীতাকুণ্ডের মুক্তিকামী জনতা লাঠিসোঁটা, পাথর ও রড নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে এবং মহাসড়কে গাছের গুড়ি ফেলে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। থানা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা এস এম হাসান এ কে এম সালাউদ্দিন, শামছুল আলম টিপু ও তাহের হোসেন বর্ণালী ক্লাবে নিজেদের প্রযুক্তি দিয়ে পেট্রোল বোমা ও ককটেল তৈরি করে প্রতিরোধকারী ছাত্র-জনতাকে সরবরাহ করতে থাকেন। বিকেল ৫টার মধ্যে পাকিস্তানি কনভয় প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে সীতাকুণ্ড বাজার অতিক্রম করে। এ-সময় ছাত্র-জনতা কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের সম্মুখে অবস্থিত ব্রিজটি ভেঙে দেয়। পাকসেনারা বিকল্প পথে বাড়বাকুণ্ড বাজার অতিক্রমকালে বদিউল আলম ওরফে বাদশা মিয়া নামে একজন তাদের লক্ষ করে বোতলভর্তি এসিড নিক্ষেপ করেন এবং একজন পাকসেনাকে জাপটে ধরে অস্ত্র কেড়ে নেয়ার চেষ্টা চালান। তখন পাকসেনারা তাকে গুলি করে হত্যা করে। তিনি পাকবাহিনীর হাতে প্রথম শহীদ। পাকবাহিনী সন্ধ্যার মধ্যে মসজিদ্দা স্কুলের সামনে পৌঁছলে ঐ স্কুলের ছাত্র কামাল রাস্তায় নেমে তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। সঙ্গে-সঙ্গে পাকসেনারা গুলি করে তাঁর বুক ঝাজরা করে দেয়। এখান থেকে মাত্র ৫০০ গজ সামনে কুমিরায় গিয়ে পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এ প্রতিরোধযুদ্ধ এক পর্যায়ে সম্মুখ যুদ্ধে পরিণত হয়। টানা ২ ঘণ্টা এ-যুদ্ধ স্থায়ী হয়। পাকবাহিনীর দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ দেড় শতাধিক সৈনিক এ-যুদ্ধে প্রাণ হারায়। অপর দিকে ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা (ইপিআর সদস্য) শহীদ হন। কুমিরা প্রতিরোধযুদ্ধএর নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়া, সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. আখতারুজ্জামান ও শ্রমিক নেতা এ টি এম নিজাম উদ্দীন।
১৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী সীতাকুণ্ডে অনুপ্রবেশ করে বেশ কয়েকটি স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা কুমিরা পাহাড়ে অবস্থিত টিবি হাসপাতাল, রেলস্টেশন, হাফিজ জুট মিলস, গুল আহমদ জুট মিলস, গানধারা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, এস কে এম জুট মিলস, সীতাকুণ্ড স্কুল মাঠ, বালিকা বিদ্যালয় মাঠ, রেলওয়ে ডেবার পাড়, সদর রেলস্টেশন, গজারিয়া দীঘির পাড়, ডাকবাংলো ও বারৈয়ারঢালা রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
১৮ই এপ্রিল সীতাকুণ্ড পাকসেনাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা সাংগঠনিকভাবে ব্যাপক তৎপরতা চালাতে থাকে। তারা ইসলাম ধর্ম ও ইসলামী রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষার নামে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকে। একই সঙ্গে তারা সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন এলাকায় রাজাকার, আলবদর, -আলশামস বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠন করে।
সীতাকুণ্ড উপজেলায় পাকবাহিনীর উল্লেখযোগ্য দোসর ছিল— প্রফেসর সামছুল হক এমপিএ (পাকিস্তান সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন মন্ত্রী), মীর হারুনুর রশিদ (সৈয়দপুর; শান্তি কামিটির সদস্য), মনিরুল ইসলাম (মহাদেবপুর), নোয়াব আলী (পিতা হাবিব, মহাদেবপুর; রাজাকার কমান্ডার), দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী (পিতা সুলতান আহম্মদ চৌধুরী, সদর সীতাকণ্ড পৌরসভা; আলবদর বাহিনীর কমান্ডার), জালাল বলি (ইদিলপুর, শান্তি কমিটির সদস্য), বি এ ফয়েজ উল্ল্যা (পিতা আব্দুল মালেক, মুরাদপুর; থানা শান্তি কমিটির কো-চেয়ারম্যান), নুরুল আলম জিয়াদি (পিতা ইমান আলী, মুরাদপুর; আলবদর বাহিনীর প্রধান), মুস্তফা মৌলভী (নড়ালিয়া; রাজাকার), হাফেজ আবুল খায়ের (নড়ালিয়া; থানা রাজাকার কমান্ডার), খলিল আহম্মদ চৌধুরী (বাঁশবাড়িয়া; রাজাকার), নুর উদ্দিন চৌধুরী (মসজিদ্দা; শান্তি কমিটির সদস্য), ডা. গোলামুর রহমান (বারআউলিয়া, শান্তি কমিটির সদস্য), মোসলেম উদ্দিন (বারআউলিয়া, শান্তি কমিটির সদস্য), মুন্সি মিয়া ওরফে কানকাটা মুন্সি (উত্তর ছলিমপুর), মাস্টার আবুল কাসেম (উত্তর ছলিমপুর), আবু বক্কর সিদ্দিকী (ছলিমপুর; শান্তি কমিটির সদস্য) ও নূর আলম (উত্তর ছলিমপুর; রাজাকার)।
৪ঠা এপ্রিল সীতাকুণ্ড মহন্তের হাটে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান থেকে গুলি বর্ষণ করলে পেশকার পাড়ার শামছুদ্দিন ও লেদু, গোলাবাড়িয়ার মো. শফিক, মুরাদপুরের জহুরুল হক, দোয়াজীপাড়ার মাহবুবুল হক এবং ইদিলপুরের তোরাব আলীসহ ২০ জনের মতো সাধারণ মানুষ নিহত হয়। এটি মহন্তের হাট গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। ১৫ই এপ্রিল পাকবাহিনী চট্টগ্রাম শহর হয়ে সীতাকুণ্ডে মার্চ করে। পথে সোনাইছড়ি এলাকায় তারা একই পরিবারের ৫ জন সহ মোট ৯ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করে, যা সোনাইছড়ি গণহত্যা নামে পরিচিত। পাকবাহিনী কুমিরা স্টেশন ও টিবি হাসপাতালে দুদিন অবস্থান করার পর ১৮ই এপ্রিল সীতাকুণ্ডে প্রবেশ করে ৭ জন মানুষকে হত্যা করে, যা সীতাকুণ্ড গণহত্যা বলে পরিচিত। ১৯শে এপ্রিল তারা অধ্যাপক হারুন আল রশিদকে তাঁর মধ্য মহাদেবপুরের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে ২২শে এপ্রিল গান্ধারা লি. ফ্যাক্টরির ভেতরে হত্যা করে। ৪ঠা মে ফৌজদারহাট এলাকায় এ কে এম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে চট্টগ্রামের কাতালগঞ্জের বাসা থেকে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ধরে নিয়ে কালুরঘাট রেডিও স্টেশনের বিপরীতে গ্রামের এক বাড়িতে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এর পূর্বে ৪ঠা এপ্রিল তাঁর মেঝবোন রৌশনআরা বেগমের স্বামী ইঞ্জিনিয়ার এ বি এম মুছাকে তারা হত্যা করে।
জুন মাসে পাকবাহিনীর দোসররা বারৈয়ারঢালার ধর্মপুরের ডা. ললিত মোহন নাথকে ধরে এনে সীতাকুণ্ডের সীতাবাড়িতে হত্যা করে। একই সময়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান কাজি কবির উদ্দিনের নির্দেশে ফৌজদারহাট এলাকার ছলিমপুরের চেয়ারম্যান এস এম এয়াকুব চৌধুরীকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। ঐ সময় বাড়ির মহিলারাও তাদের নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি। জুন মাসে সদর কলেজ রোডের ঠিকাদারি কাজের পাওনা দিতে এলে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা মিরসরাই এলাকার ঠিকাদার রুহুল আমিন ও তার ছোট ভাইকে ধরে নিয়ে সীতাবাড়িতে হত্যা করে। তারা তাদের ব্রিফকেস ভর্তি লক্ষাধিক টাকা লুট করে নিয়ে যায়। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তারা মুরাদপুরের আফজার বাড়ি, দক্ষিণ মুরাদপুরের মণ্ডল বাড়ি, সদর মুরাদপুরের কেশব মাস্টারের বাড়ি, ভাটেরখিলের কোয়াল বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পঙ্গু অবস্থায় ঘরের মধ্যে অবস্থানরত শরৎচন্দ্র মহাজন আগুনে দগ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি মারা যান। পাকহানাদাররা শরৎচন্দ্র মহাজনের বোন স্নেহলতা ও স্নেহলতার মেয়ে বিধু বালাকে নির্যাতন করে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে তারা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. আখতারুজ্জামানের বাড়িতে (বক্তার পাড়া) হামলা চালিয়ে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। বহরপুরের সৈয়দুর রহমান কেরানীর দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ায় ডিসেম্বরের প্রথম দিকে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী তার বাড়িতে আগুন দেয়। তারা দারোগা বাজার ও সীতাকুণ্ড বাজারে আগুন দিয়ে অর্ধশতাধিক দোকানঘর জ্বালিয়ে দেয়।
এখানে পাকবাহীনির প্রধান নির্যাতন কেন্দ্রটি ছিল গুল আহম্মদ জুট মিলসের ভেতরে। পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনীর ক্যাপ্টেন শাহেদ পারভেজ ছিল এ নির্যাতনকেন্দ্রের কমান্ডিং অফিসার। তার নির্যাতনের ধরন ছিল খুবই ভয়ানক ও নিষ্ঠুর। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনী রাজাকার কমান্ডার আবুল খায়ের হাফেজের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধা মো. সোলায়মান ও তাঁর ভাগ্নে কাজি এম এন মোস্তফাসহ ৮ জন গ্রামবাসীকে ধরে এনে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করে।
সীতাকুণ্ড রেলস্টেশনের আইডব্লিউটি কার্যালয়কেও পাকসেনারা নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করে। এছাড়া চিটাগাং কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, গান্ধারা এস কে এম জুট মিলস, সীতাকুণ্ড বালিকা বিদ্যালয়, সীতাকুণ্ড হাইস্কুল ও বারৈয়ারঢালা স্টেশনে পাকবাহিনী নির্যাতনকেন্দ্র স্থাপন করে। ২৬শে নভেম্বর তারা মুক্তিযোদ্ধা সাবের হোসেনকে আটক করে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিয়ে যায়। সেখানে ১৪ দিন বন্দি রাখার পর ৯ই ডিসেম্বর সকাল ৯টায় তাঁকে গুলি করে। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। এ বন্দিশিবিরে হামিদুর রহমান (ছাত্র)-কে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অবস্থিত সীতাবাড়িতে একটি বধ্যভূমি রয়েছে। সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই এলাকা থেকে শতাধিকেরও বেশি স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনকে এখানে ধরে এনে হত্যা করা হয়। এটি সীতাবাড়ি বধ্যভূমি নামে পরিচিত। এছাড়া সদর রেলস্টেশনের উত্তর পাশে আইডব্লিউটি-র কার্যালয় থেকে অসংখ্য মানুষের হাড় ও কঙ্কাল উত্তোলন করা হয়। এটি আইডব্লিউটি বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। ঘোড়ামারা এলাকায় ইপিআর বাহিনীর সদস্যসহ ১১ জন শহীদের গণকবর রয়েছে, যা ঘোড়ামারা গণকবর নামে পরিচিত।
২৮শে মার্চ ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা মাজার শরীফ এলাকায় পাকসেনাদের প্রতিরোধ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এ প্রতিরোধযুদ্ধে ইপিআর বাহিনীর ৩ জন সদস্য শহীদ হন। এটি মাজার শরীফ প্রতিরোধযুদ্ধ নামে পরিচিত। পাকবাহিনী চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে ফৌজদারহাটের কাছাকাছি পুনরায় ইপিআর-এর প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এখানে উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময়ে ৮জন ইপিআর জওয়ান শহীদ হন। এটি ফৌজদারহাট যুদ্ধ বলে পরিচিত।
২৭শে মার্চ রাতের মধ্যে পাকবাহিনী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে জোড়ামতল এলাকা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে নেয়। ২৮শে মার্চ চট্টগ্রাম অভিমুখে মার্চ করার সময় ঘোড়ামারা, বারআউলিয়া ও ফৌজদারহাট এলাকায় ইপিআর সৈনিকদের সঙ্গে পাকিস্তানি সৈনিকদের খণ্ড-খণ্ড যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে ৩০-এর অধিক ইপিআর সৈনিক শহীদ হন। বেশকিছু পাকসেনাও হতাহত হয়। এটি ঘোড়ামারা, বারআউলিয়া ও ফৌজদারহাট খণ্ডযুদ্ধ নামে পরিচিত।
১৯শে এপ্রিল পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনীর কুমিরা অভিযান- পরিচালিত হয়। এতে বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। মিলিশিয়ারা অনেক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে
৪ঠা সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী ও তাদের দোসর মুজাহিদ বাহিনী মহালংকার হিতু মোহাম্মদ ভূঁইয়ার বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করেন। এটি মহালংকার যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা শামসুল আলম টিপুসহ ৩ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
অক্টোবর মাসে ফৌজদারহাট ও নিউ পতেঙ্গা নেভী গেট এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। ২ ঘণ্টা স্থায়ী এ সংঘর্ষে কমান্ডার মুজাফ্ফর হোসেনসহ ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। এটি ফৌজদারহাট ও নিউ পতেঙ্গা নেভী গেট যুদ্ধ নামে পরিচিত।
অক্টোবর মাসেই হামিদ উল্ল্যাহ হাট এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি যুদ্ধ হয়। এক ঘণ্টা স্থায়ী এ- “যুদ্ধে স্থানীয় একজন কৃষকসহ ৩ জন মানুষ প্রাণ হারায়। এটি হামিদ উল্ল্যাহ হাট যুদ্ধ বলে পরিচিত।
৫ই নভেম্বর বাড়বকুণ্ডে দালাল উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়। এতে স্থানীয় শান্তি কমিটির প্রধান মফিজুর রহমান ভূঁইয়া ও তার ৮ সহযোগীকে হত্যা করা হয়।
কুমিরা যুদ্ধ হয় দুবার – ২৭ ও ২৮শে মার্চ এবং ১৪-১৬ই ডিসেম্বর। প্রথমবারের যুদ্ধে উভয় পক্ষে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে ৮-১০ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ-যুদ্ধের পরেই পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে। ১৬ই ডিসেম্বর সীতাকুণ্ড উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আবু তাহের মো. সালাহউদ্দিন, বীর প্রতীক (পিতা জহুরুল ইসলাম চৌধুরী, মসজিদ্দা) ও মো. রুস্তম আলী, বীর প্রতীক (পিতা মোখলেছুর রহমান, ঘোড়ামারা)।
সীতাকুণ্ড উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- শামসুল আলম টিপু (পিতা শেখ মাহফেল উদ্দিন; যুদ্ধকালে সীতাকুণ্ড সদরের স্টেশন মাস্টার; গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার মধুর নাগরা গ্রামের বাসিন্দা; মহালংকার যুদ্ধে শহীদ), হিতু মোহাম্মদ ভূঁইয়া বাড়ির আবুল হোসেন, আব্দুল মোতালেব ও আব্দুল জলিল, তাহের হোসেন (পিতা সৈয়দুর রহমান, নিজতালুক), হামিদুর রহমান (মসজিদ্দা, চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্র), এ কে এম শামসুদ্দিন চৌধুরী (পিতা আবদুস সোবহান, উত্তর সলিমপুর), অধ্যাপক হারুন আল রশিদ (পিতা মৌলভী আব্দুস ছাত্তার, মহাদেবপুর), বদিউল আলম বাদশা (পিতা সাদাকাত উল্ল্যাহ, মধ্যম মাহামুদাবাদ), আবু বক্কর সিদ্দিকী (পিতা সুবেদার অজিউল্ল্যাহ, হরিণা ক্যাম্পের প্রশিক্ষক; করেরহাট, মিরসরাই), আলী আকবর সিদ্দিকী (পিতা সুবেদার অজিউল্ল্যাহ, করেরহাট), ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা (মৌলভী আমিনুল হক, মুরাদপুর), সুবেদার আজিজুর রহমান (পিতা সিফাত উল্ল্যাহ, সিলেট জেলার কালুশাহী গ্রামের বাসিন্দা; কুমিরার যুদ্ধে শহীদ), নুরুল আলম চৌধুরী (কুমিরা), সালেহ আহম্মদ (কুমিরা কাজিপাড়া), ড্রাইভার লেদু মিয়া (মুরাদপুর ফকিরহাট), নায়েক রুহুল আমিন (ইপিআর সৈনিক), ল্যান্স নায়েক আবুল খায়ের (ইপিআর সৈনিক), আব্দুল ওদুদ (ইপিআর সৈনিক), মোজাম্মেল হক (নৌসেনা), মহিবুল্লা, বীর বিক্রম (নৌসেনা, বারৈয়ারঢালা) ও কামাল (মসজিদ্দা স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র)। এছাড়া আরো ৩৪ জন ইপিআর সৈনিক সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন যুদ্ধে শহীদ হন, যাঁদের নাম ও পরিচয় জানা যায়নি।
১৯৯২ সালে মুক্তিযোদ্ধা টি এম ইসমাইল সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকায় ভাটিয়ারী ও হাটহাজারী সড়কের সম্মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ‘স্মৃতি অম্লান’ নির্মাণ করেন। মাস্টার মুছা আহম্মদ চেয়ারম্যান, ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ শফি, এনায়েত উল্ল্যা, ফরিদুল আলম চৌধুরী, বশত আলী চৌধুরী, নিজাম উদ্দিন প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে ১৯৯২ সালে বিজয় স্মরণি ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। রহিম স্টিলের স্বত্বাধিকারী আলহাজ্ব ইসরাইলের অর্থায়নে ১৯৯৬ সালে বিজয় স্মরণি ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসে মুক্তিযোদ্ধা মেমোরিয়াল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১১ সালে ‘কুমিরা যুদ্ধের ময়দান’ হিসেবে খ্যাত ছোট কুমিরা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। স্থানীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ফুটন্ত গোলাপ ক্লাবের উদ্যোগে ১৯৮৮ সালে বীর শহীদদের স্মরণে কুমিরা রেলস্টেশন থেকে এক হাজার গজ উত্তরে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে সীতাকুণ্ড পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের মধ্যম মহাদেবপুর গ্রামের একটি রাস্তা শহীদ অধ্যাপক হারুন আল রশিদের নামে এবং দক্ষিণ মহাদেবপুর ৬নং ওয়ার্ডের একটি রাস্তা শহীদ শামছুল আলম টিপুর নামে নামকরণ করা হয়। রাস্তা দুটির নামকরণ করেন তৎকালীন পৌর মেয়র মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ। পাকবাহিনীর হাতে গণহত্যায় শহীদ সোবাহান ফকিরের নামে ১৯৯৭ সালে পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের লাঠিয়াল পাড়ার নাম পরিবর্তন করে ‘সোবাহান বাগ’ করা হয়। ১নং সেক্টরের সাব-কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন শামছুল হুদার স্মরণে ১৯৭২ সালে তাঁর নিজ এলাকার মুরাদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় শহীদ ক্যাপ্টেন শামছুল হুদা উচ্চ বিদ্যালয়। সোনাইছড়ি ইউনিয়নের লালবাগ এলাকায় চট্টলা সিএনজি ফিলিং স্টেশনের সম্মুখে এলাকাবাসী মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে। [জামশেদ উদ্দীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড