You dont have javascript enabled! Please enable it!

সিরাজদিখান থানা যুদ্ধ (সিরাজদিখান, মুন্সীগঞ্জ)

সিরাজদিখান থানা যুদ্ধ (সিরাজদিখান, মুন্সীগঞ্জ) সংঘটিত হয় ৮ ও ১৯শে নভেম্বর দুদিন। ৮ই নভেম্বর পাকসেনাদের নিক্ষিপ্ত শেলে কুসুমপুর গ্রামের মমতাজ বেগম রেণু শহীদ হন এবং ১৯শে নভেম্বর পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে।
সিরাজদিখানের মুক্তিযোদ্ধারা ৮ই নভেম্বর পাকবাহিনী কর্তৃক দখলকৃত থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। কমান্ডার আ. লতিফ মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর মোঘল, মো. শাহজাহান মিয়া ও ওয়াসেকসহ কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শক্রমে আক্রমণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। তখন কুসুমপুরের আবদুল কুদ্দুস ধীরন ও ছাত্রনেতা জামাল চৌধুরীর নেতৃত্বে মজিদপুর দয়াহাটা ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ ও তাদের ভারতে পাঠানোর কাজ চলছিল। তাঁরা এলাকার মুক্তিযোদ্ধা আলী ইমামের মাধ্যমে জানতে পারেন যে, থানার রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করতে চায়। এ অবস্থায় তাঁরা ৮ই নভেম্বর থানা আক্রমণের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হন। সে-সময় থানার নিকটবর্তী ইছামতি নদীতে ভারী অস্ত্রভর্তি পাকসেনাদের একটি গানবোট মোতায়েন ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের থানা আক্রমণের বিষয়টি জানতে পেরে পাকসেনারা গানবোট থেকে মর্টার, শেল ও ট্রেসার বুলেট নিক্ষেপ করতে থাকে। মর্টার ও শেলের রেঞ্জ এত বেশি ছিল যে, তা ইছাপুরা, মালখানগর, মধ্যপাড়া, মালপদিয়া, কুসুমপুর, ফেগুনাসার, জৈনসার, দক্ষিণ চারিগাঁও ও নওপাড়া হয়ে লৌহজং-এর পদ্মার তীর পর্যন্ত আঘাত হানে। শেলের আঘাতে দক্ষিণ কুসুমপুর গ্রামের ভূঁইয়া বাড়ির ডা. ফজলুল হক ভূঁইয়ার বোন মমতাজ বেগম রেণু শহীদ হন। তাঁর স্ত্রী রাজিয়া আক্তার মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পরে মারা যান। হানাদার বাহিনীর গানবোট থেকে নিক্ষিপ্ত একটি শেল এসে পশ্চিম দিকে চর কমলাপুর গ্রামের গয়াতলার জিন্নত আলীর বাড়িতে পড়ে। এ অবস্থায় পাল্টা আক্রমণ চালালে সাধারণ মানুষের ব্যাপক প্রাণহানি হবে ভেবে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেন। সিরাজদিখানের বিভিন্ন গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় ১৯শে নভেম্বর রাতে থানা আক্রমণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আ. লতিফ, দেলোয়ার হোসেন মোল্লা, জাহাঙ্গীর আলম, মো. শাহজাহান মিয়া, এম এ করিম বিদ্যুৎ চৌধুরী, মুহাম্মদ জহুরুল আলম বিমল, আলী আহাম্মদ বাচ্চু, হাবিলদার নাজিম উদ্দিন, হাবিবুর রহমান হাবিব, সামসুদ্দিন আহমেদ খয়ের প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা থানায় অবস্থানরত পাকসেনাদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়ে তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার কৌশল গ্রহণ করেন। তাঁরা পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে থানার উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে অবস্থান নেন। কমান্ডার লতিফ প্রায় ২০০ সহযোদ্ধা নিয়ে থানার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থান গ্রহণ করেন। ছাত্রনেতা জামাল চৌধুরী মজিদপুর দয়াহাটা ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অল্পদূরে অবস্থান নেন। সকলের অবস্থান নেয়ার পর সংকেত দেয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তিনদিক থেকে একযোগে গুলি শুরু হয়। এ তীব্র আক্রমণে দিশেহারা হয়ে থানায় অবস্থানরত পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করার জন্য তাদের সুবেদার মেজরকে উচ্চস্বরে তাগিদ দিতে থাকে। ২০শে নভেম্বর কুখ্যাত রাজাকার মজিদ মুন্সি আত্মসমর্পণে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে হাবিলদার কবির তাকে গুলি করে হত্যা করে। তখন থানার পাকবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার সুবেদার মেজর আ. রউফ হ্যান্ড মাইকে সকলের জীবন ভিক্ষা চাইতে থাকে এবং নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। ঘোষণায় আস্থা আনতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা থানার সম্মুখে খোলা স্থানে তাদের সকল অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিলে সঙ্গে-সঙ্গে পাকবাহিনী তা পালন করে। তখন ছাত্রনেতা জামাল চৌধুরী আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এগিয়ে যান। এভাবে ৩৪ জন পাকিস্তানি পুলিশ ও ইপিআর এবং ২০ জন রাজাকার নিয়ে সুবেদার মেজর আ. রউফ আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর ৭০টি রাইফেল, ৪টি এলএমজি, ১টি দুই ইঞ্চি মর্টার ও ৭ পেটি রাইফেলের গুলি উদ্ধার করেন। ২০শে নভেম্বর সিরাজদিখান থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আহাম্মদ বাচ্চু। [মো. শাহ্জাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!