You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খান - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খান

সিরাজুল আলম খান (জন্ম ১৯৪১) মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান ও স্বাধীনতাউত্তর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতিষ্ঠাতা। ষাটের দশকে তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীনে গড়ে ওঠা স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪১ সালের ৬ই জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলাধীন আলীপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতার নাম খোরশেদ আলম এবং মাতা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন। তিনি নোয়াখালীর মিডল ইংলিশ (এম ই) স্কুল থেকে প্রাইমারি পাস করেন। এরপর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ হাইস্কুলে দুবছর লেখাপড়া করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি খুলনা জেলা স্কুল থেকে বিজ্ঞান শাখায় ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে বিএসসি (অনার্স)-এ ভর্তি হন এবং ১৯৬২ সালে এ বিষয়ে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। রাজনীতিতে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করায় তাঁর পক্ষে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করা সম্ভব হয়নি।
ছাত্রজীবন থেকেই সিরাজুল আলম খান সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগ-এর রফিকউল্লাহ চৌধুরী ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের কমিটিতে তিনি কার্যনির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ছাত্রলীগের সভাপতি ও শেখ ফজলুল হক মনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলে সিরাজুল আলম খান ঐ কমিটির সহ- সম্পাদক হন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তখন সভাপতি ছিলেন। কে এম ওবায়দুর রহমান। সে-সময়ে দেশে জেনারেল আইয়ুব খানের শাসন চলছিল। ১৯৬২ সালের জানুয়ারির শেষে আওয়ামী লীগ-এর কেন্দ্রীয় নেতা ও বর্ষিয়ান জনপ্রিয় রাজনীতিক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তার, একই বছর মার্চ মাসে আইয়ুবের কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির শাসনতন্ত্র ঘোষণা, তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের নামে ওপর থেকে নিয়ন্ত্রিত সেনা-আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিদ্বেষী প্রতিক্রিয়াশীল শরীফ শিক্ষা কমিশন (১৯৬২) রিপোর্ট ইত্যাদির বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলায় যে দুর্বার ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে, সিরাজুল আলম খান ছিলেন তার অন্যতম সংগঠক। আইয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার কারণে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও প্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৩-৬৫ সময়ে প্রায় দুবছর তাঁর কারাগারে কাটে। ১৯৬৬ সালে বাঙালির ‘মুক্তির সনদ’ খ্যাত বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা এবং ছাত্রদের ১১-দফাভিত্তিক (১৯৬৯) আন্দোলন ও আইয়ুব সরকারের বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আগরতলা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার বিরুদ্ধে সংঘটিত ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সিরাজুল আলম খান ভারতে চলে যান। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে নানা প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও তাঁর উদ্যোগে ছাত্রলীগের নেতা- কর্মী ও যুবকদের নিয়ে মুক্তিবাহিনীর বাইরে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) নামে একটি স্বতন্ত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ‘মুজিব বাহিনী’ নামে সুপরিচিত। মুজিব বাহিনীর সদস্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হয়। স্বাধীনতার পরপর তিনি আওয়ামী ধারার রাজনীতির বলয় থেকে বের হয়ে ১৯৭২ সালের ৩১শে অক্টোবর ‘সামাজিক বিপ্লব’, ‘শ্রেণি সংগ্রাম’ ও ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ নামে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) প্রতিষ্ঠা করেন। সদ্যস্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে তরুণ সম্প্রদায়ের একটি অংশকে আকৃষ্ট করে তাঁর প্রতিষ্ঠিত এ দল বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে দেশে চরম অস্থিতিশীল ও সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। হঠকারী রাজনৈতিক লাইন অনুসরণ করায় এ দলের সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার তরুণকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়। দলটি আজ বহুধা বিভক্ত এবং রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রায় গুরুত্বহীন। [হারুন-অর-রশিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড