মুক্তিযুদ্ধে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা ১৯৬৯ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকে ডাকসু-র ভিপি তোফায়েল আহমদকে সভাপতি করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সিরাজগঞ্জে ছাত্রলীগ-এর নেতৃতে সিরাজগঞ্জ মহকুমা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। তারা আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এরপর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। সারা দেশের মতো সিরাজগঞ্জেও আন্দোলনের ঝড় ওঠে। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ছাত্রনেতা আব্দুর রউফ পাতা (সিরাজগঞ্জ বি এ কলেজের ভিপি)-র নেতৃত্বে সিরাজাগঞ্জ বি এ কলেজ মাঠের আমতলায় ছাত্র-জনতার এক সমাবেশে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। অনুষ্ঠানে আব্দুল লতিফ মির্জা, মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর, মোজাফ্ফর হোসেন মোজাম, গোলাম কিবরিয়া, ইসহাক হোসেন, সিরাজুল ইসলাম খান, ইসমাঈল হোসেন, আজিজুল হক বকুল, আব্দুল আজিজ মির্জা, রফিকুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম, আব্দুল আজিজ প্রমুখ নেতা উপস্থিত ছিলেন ঐদিনই মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীরকে সভাপতি করে এখানকার সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত করা হয়। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। সে ডাকে সাড়া দিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য এলাকার মতো সিরাজগঞ্জের ছাত্র-জনতাও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
৯ই মার্চ আওয়ামী লীগের নেতৃতে সিরাজগঞ্জে মোতাহার হোসেন তালুকদার এমএনএ-কে সভাপতি করে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদের সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ হায়দার আলী এমপিএ। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এমএনএ, সৈয়দ হোসেন মনসুর এমএনএ (পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন), আব্দুল মমিন তালুকদার এমএনএ, রওশানুল হক মতি মিয়া এমপিএ, গোলাম হোসেন এমপিএ, কে বি এম আবু হেনা এমপিএ, এ কে এম মাহবুবুল ইসলাম এমপিএ (পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন), মো. আব্দুর রহমান মিয়া এমপিএ, ডা. জসীম উদ্দিন, এডভোকেট দবির উদ্দিন আহমেদ, শহীদুল ইসলাম তালুকদার, আনোয়ার হোসেন রতু, আব্দুর রউফ খান, আব্দুল মোমিন তালুকদার চার্লি, রফিকুল আলম খান ও আমির হোসেন ভুলুর নাম উল্লেখযোগ্য। সংগ্রাম পরিষদকে সার্বিক সহযোগিতা করেন সিরাজগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক এ কে শামসুদ্দিন আহমেদ। পৌর মিলনায়তনে সংগ্রাম পরিষদের অফিস স্থাপন করা হয়।
মার্চের প্রথম থেকেই সিরাজগঞ্জে ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। সিরাজগঞ্জ বি এ কলেজ, ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (আই আই কলেজ) মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। বি এ কলেজ মাঠে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সদস্য লুৎফর রহমান অরুণ, ইপিআর সদস্য নূর মোহাম্মদ ও মহিউদ্দিন, আনসার কমান্ডার আব্দুর রহমান ও রবিউল আলম গেরিলার নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ চলে। একই সঙ্গে আই আই কলেজ মাঠে আনসার এডজুট্যান্ট মোহাম্মদ হোসেন, আনসার কমান্ডার বাহাদুর আলী, পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজমল হক ও দুজন আনসার সদস্য ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেন। বাঁশের লাঠি, ডামি রাইফেল ও গাদা বন্দুক প্রশিক্ষণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসডিও এ কে শামসুদ্দিন সহযোগিতায় থানা থেকে সংগ্রহকৃত টু-টু বোর রাইফেলও প্রশিক্ষণে ব্যবহার করা হয়। বি এ কলেজ মাঠে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী ১৫০ জন ছাত্র-যুবকের সঙ্গে মিনা ও এলিজা সিরাজী (ভদ্রঘাট)-সহ কয়েকজন ছাত্রীও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। আই আই কলেজ মাঠে ৫০-৬০ জন ছাত্র-যুবক মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং নেন। এসডিও শামসুদ্দিনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ প্রশিক্ষণার্থীদের থাকা- খাওয়ার ব্যবস্থা করেন
২৬শে মার্চ সংগ্রাম পরিষদের নেতা- কর্মী ও সাধারণ জনতা পৌর মিলনায়তনে স্থাপিত অফিসে জড়ো
হতে থাকে। সকাল ১১টার দিকে এসডিও শামসুদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ওয়ারলেস মেসেজটি নেতৃবৃন্দের নিকট দেন এবং আনোয়ার হোসেন রতু তা উপস্থিত সবাইকে পাঠ করে শোনান। ২৬শে মার্চ সিরাজগঞ্জে পুলিশ, আনসার, অবসরপ্রাপ্ত এবং ছুটিতে থাকা সেনাসদস্য ও ছাত্র-যুবকদের নিয়ে প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করা হয়। সেদিনই মহকুমা প্রশাসক এ কে শামসুদ্দিনের নির্দেশে থানা ও আনসার ক্যাম্পের সব অস্ত্র প্রতিরোধযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। লাইসেন্স করা ব্যক্তিগত বন্দুকগুলোও বিভিন্ন বাড়ি থেকে সংগ্রহ করে স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এর ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই সিরাজগঞ্জে পুলিশ, আনসার, সেনাসদস্য ও ছাত্র-যুবকদের নিয়ে বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠে। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায় সোহরাব আলী সরকার (পিতা রজব আলী সরকার, কান্দাপাড়া), লুৎফর রহমান অরুণ (পিতা আরফান উদ্দিন খান, মুক্তিযোদ্ধা গলি) ও মোজাফফর হোসেন মোজাম (পিতা লুৎফর রহমান, হোসেনপুর) মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন।
২৭শে মার্চ সিরাজগঞ্জে সংবাদ আসে যে, পাকবাহিনী লঞ্চযোগে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ি হয়ে সিরাজগঞ্জের বয়ড়াঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে। এ সংবাদ শুনে নেতৃবৃন্দ বয়ড়া ও পোড়াবাড়ি ঘাটে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা বয়ড়াঘাটে গিয়ে অবস্থান নেন। শহরের শতশত সাধারণ মানুষ পাকবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য লাঠিসোঁটা, দা, বল্লম, কাস্তে, খুন্তি, হাসুয়া ইত্যাদি নিয়ে বয়ড়াঘাটে জড়ো হয়।
সে-সময় ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জে আসার পথ ছিল দুটি। একটি যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে বয়ড়াঘাট হয়ে, অন্যটি আরিচা- নগরবাড়ি-বাঘাবাড়ি ঘাট হয়ে। এই দুটি পথে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য সিরাজগঞ্জ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ বয়ড়াঘাটে ও আরেকটি গ্রুপ বাঘাবাড়ি ঘাটে পাঠানো হয়। এসডিও এ কে শামসুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ১৭ই এপ্রিল থেকে বাঘাবাড়িতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। লুৎফর রহমান অরুণ, আব্দুল লতিফ মির্জা, মোজাফফর হোসেন মোজাম, সোহরাব হোসেন ও গোলাম কিবরিয়াসহ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা বাঘাবাড়িতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ কে শামসুদ্দিন আহমেদের অনুরোধে মেজর নাজমুল হক ও ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ইপিআর বাহিনীর একটি গ্রুপ সুবেদার খন্দকার মতিউর রহমানের নেতৃত্বে সিরাজগঞ্জে পাঠান। কয়েকদিন পর হাবিলদার আকবরের নেতৃত্বে ইপিআর বাহিনীর আরো একটি গ্রুপ সিরাজগঞ্জে আসে। সালেহা গার্লস স্কুলে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সেখান থেকে একটি গ্রুপকে বাঘাবাড়ি ও আরেকটি গ্রুপকে নগরবাড়ি ঘাটে প্রতিরোধের জন্য পাঠানো হয়। ২৩শে এপ্রিল পাকবাহিনীর সঙ্গে বাঘাবাড়ি ঘাটে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। ভারী অস্ত্র না থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হন। অতঃপর এ কে শামসুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ২৪শে এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা ঘাইটনা (ঘাটিনা রেলওয়ে ব্রিজে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকবাহিনী সেদিন পিছু হটলেও ২৬শে এপ্রিল তারা সিরাজগঞ্জে প্রবেশ করে।
২৬শে এপ্রিল পাকবাহিনী সিরাজগঞ্জে প্রবেশ করে এবং সিরাজগঞ্জ থানা, ওয়াপদা রেস্ট হাউজ, বি এ কলেজ, বি এল স্কুল, কওমী জুট মিলস্, শৈলাবাড়ি হাটবৈড়া হাইস্কুল, ভাটপিয়ারি হাইস্কুল ও মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল মতিনের বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায় পাকবাহিনীর সহযোগী সংগঠন শান্তি কমিটির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রাজাকার বাহিনী গড়ে ওঠে। শান্তি কমিটির সদস্যদের মধ্যে সৈয়দ আসাদ উদ দৌলা সিরাজী (মুসলিম লীগ ও শান্তি কমিটির নেতা, বাণীকুঞ্জ), তরিকুল আলম খাঁ লেবু মিয়া (মুসলিম লীগ নেতা, বাগবাটি), গোলাম আযম মোক্তার (মোক্তারপাড়া), তোফাজ্জল হোসেন (মোক্তারপাড়া), মজিবর রহমান (কুখ্যাত দালাল ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, জগৎগাতী), মুজিব বিহারী (পুরাতন পোস্ট অফিস রোড), আব্দুল মতিন (সিরাজগঞ্জ সদর), রাজাকারদের মধ্যে আবুল হোসেন মুন্সি (কুখ্যাত রাজাকার, রতনকান্দি), রহিম সরদার (দত্তবাড়ী), বুজু সরদার (দত্তবাড়ি), চুনু শেখ (বি এল স্কুল রোড), মোহাম্মদ আলী (গয়লা) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। দালালদের মধ্যে আব্দুর রহমান (মামুদপুর), মোহাম্মদ শফি (মামুদপুর), আব্দুল কাদের (স্টেশন রোড), আশরাফ হোসেন (স্টেশন রোড), মোহাম্মদ আলী (স্টেশন রোড), শেখ রমজান (স্টেশন রোড), শেখ হাসনু (স্টেশন রোড), আব্দুল হামিদ খান (গোপলা), আশরাফ আলী (ধানবান্দি), খোরশেদ আলী (গয়লা), সৈয়দ গফফার (মিরপুর) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। পাকবাহিনী সিরাজগঞ্জ শহরে প্রবেশ করেই বাজার স্টেশন রোড থেকে পুরনো জেলখানা (বর্তমানে যমুনা নদীগর্ভে বিলীন) রোডের উভয় পাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকা পুড়িয়ে দেয়। শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের সহযোগিতায় তারা বাজার, বাড়িঘর লুটপাট, নারীনির্যাতন, গণহত্যা ইত্যাদি অপকর্মে লিপ্ত হয়। তারা ব্রিজ, কালভার্ট ও রাস্তাঘাটে পাহারা বসায়, যাতে মুক্তিবাহিনী তাদের চলার পথে বাধার সৃষ্টি করতে না পারে। কুখ্যাত রাজাকার আবুল হোসেন মুন্সি, তরিকুল আলম খাঁ লেবু মিয়া, তোফাজ্জল হোসেন মোক্তার, আবু ইউসুফ ও ইউনুস তালুকদারের সহযোগিতায় পাকবাহিনী বাহুকা ও চিলগাছা গ্রামের ২৫- ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পিপুলবাড়িয়া, ডলডব, হরিণাগোপাল-বাগবাটী হিন্দু প্রধান এই গ্রামগুলো সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেয়া এবং শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়। পাকবাহিনী সিরাজগঞ্জে প্রবেশ করেই রাজাকারদের সহযোগিতায় ৩৮ জন সাধারণ মানুষকে সিরাজগঞ্জ মহকুমা শান্তি কমিটির নেতা সৈয়দ আসাদ উদ দৌলা সিরাজীর বাসায় ধরে নিয়ে যায়। অতঃপর তাদের রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এটি সিরাজগঞ্জ শহর গণহত্যা নামে পরিচিত। এদিন আবুল হোসেন নামে একজনকে সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মোতাহার হোসেন তালুকদার এমএনএ-এর বাসার সামনে গর্ত করে বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে মাথায় গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
২৭শে এপ্রিল পাকবাহিনী ফুলবাড়ি-বেড়াবাড়ি থেকে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ধীতপুর আলাল, নতুন ভাঙ্গাবাড়ির দিকে এগিয়ে আসে এবং অনেক গ্রামবাসীকে হত্যা করে, যা ধীতপুর-নতুন ভাঙ্গাবাড়ি গণহত্যা নামে পরিচিত এদিন তারা কয়েকজন নারীর ওপর পাশবিক অত্যাচার শেষে তাদের হত্যা করে। নতুন ভাঙ্গাবাড়ির শুকুর আলী নামে একজনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করার পর ঘরে আগুন জ্বালিয়ে তাতে তার লাশ নিক্ষেপ করে। ধীতপুর আলাল গ্রামের স্কুলছাত্র শফিউল আলম, কৃষক সুজাবত আলীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। ক্ষেতে কাজ করা অবস্থায় ইয়াসিন ও সজা শেখকে গুলি করে হত্যা করে।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বাগবাটি ইউনিয়নের হরিণাগোপাল-বাগবাটী পাশাপাশি দুটি গ্রামে পাকবাহিনীর ভয়ে ভীত বগুড়া, শেরপুর, রায়গঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ শহরের দুই শতাধিক নারী-পুরুষ আশ্রয় নেয়। ৩১শে মে পাকবাহিনী সিরাজগঞ্জ থেকে এসে গ্রামদুটিতে গণহত্যা, নারীনির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ করে। হরিণাগোপাল-বাগবাটী গণহত্যায় দুই শতাধিক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। মে মাসের শেষদিকে সিরাজগঞ্জ শহরের রেলওয়ে স্টেশনের পাশে সুইপার কলোনিতে গণহত্যা চালানো হলে ৩৫ জন সুইপার ও আশপাশের গ্রামের ৮ জন গণহত্যার শিকার হয়, যা সিরাজগঞ্জ সুইপার কলোনি গণহত্যা নামে পরিচিত। এছাড়াও সিরাজগঞ্জের আশপাশের গ্রামের আরো ৯ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
জুন মাসের শেষদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা সিরাজগঞ্জ শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে শিয়ালকোল গ্রামের ১০-১৫টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং ৬ জনকে হত্যা করে। সিরাজগঞ্জ উপজেলা সদরের ছোনগাছা ইউনিয়নের একটি গ্রাম ভাটপেয়ারী। এটি সিরাজগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। ১৬ই নভেম্বর পাকবাহিনী ভাটপেয়ারী গ্রামে ঢুকে তাদের দোসরদের সহযোগিতায় নিরীহ-নিরপরাধ ৯ জন মানুষকে হত্যা করে, যা ভাটপেয়ারী গণহত্যা নামে পরিচিত। ভাটপেয়ারী গ্রামটি বর্তমানে যমুনার গর্ভে বিলীন।
সিরাজগঞ্জ পুরাতন পোস্ট অফিস রোডের মুজিব বিহারীর বাড়ি, মহকুমা সাবজেল ও বাণীকুঞ্জ আসাদ উদ দৌলা সিরাজীর বাড়িটি পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বধ্যভূমির মধ্যে লঞ্চঘাট বধ্যভূমি, হরিণাগোপাল বলরাম নমদাসের বাঁশঝাড় বধ্যভূমি ও বাগবাটি খুদু রায়ের কুয়া বধ্যভূমি উল্লেখযোগ্য।
অক্টোবর মাসের শেষদিকে ভাটপেয়ারীতে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ভাটপেয়ারী যুদ্ধএ ৩২ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং তাদের প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পাকাসেনারা ১৬ই নভেম্বর ভাটপেয়ারী গ্রামের ৯ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। ১১ই নভেম্বর মোজাফফর হোসেন মোজামের নেতৃত্বে ভারত থেকে সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে শৈলাবাড়িতে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হয়। ১২ই ডিসেম্বর আমির হোসেন ভুলুর নেতৃত্বে ঘুরকা ওয়াপদা বাঁধে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি খণ্ড যুদ্ধ হয়। ১৪ই ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ সদর হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- শাহ আলী আকন্দ, বীর বিক্রম (পিতা আশরাফ আলী আকন্দ, কুড়ালিয়া), হেলাল মোর্শেদ খান, বীর বিক্রম (পিতা গোলাম আরব আলী খান, জামাল খান রোড), রওশন ইয়াজদানি ভূঁইয়া, বীর প্রতীক (পিতা ফরহাদ হোসেন ভূঁইয়া, একডালা)।
সিরাজগঞ্জে ১১ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন- সুলতান মাহমুদ (পিতা আজাহার আলী শেখ, জুবিলি বাগান লেন), আবুল কালাম আজাদ (পিতা হোসেন আলী, বি এ কলেজ রোড), ছফর আলী (পিতা আফছার আলী, শিমলা), আব্দুস সামাদ সরকার (পিতা ফজলার রহমান সরকার, রঘুরগাতী) আহসান উল হাবীব (পিতা বেলায়েত হোসেন মুন্সি, খাড়ুয়া), শাহেদ আলী (পিতা আজিম উদ্দিন বেপারী, শাহেদ নগর), মকবুল হোসেন (পিতা মেছের মণ্ডল, কুড়ালিয়া), বিমলেন্দু রায় (পিতা কালীপ্রসন্ন রায়, বাগবাটি), আব্দুস সোবহান রতন (পিতা কছিম উদ্দিন আকন্দ, রতনগঞ্জ), আব্দুল আজিজ (পিতা আজাহার আলী বেপারী, ভাটপিয়ারী), শুকুর মাহমুদ (পিতা আফসার আলী, চর চণ্ডিবহুলী)।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায় ১৮ জন বীরাঙ্গনার নাম পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন— মোছা. সূর্য বেগম (নতুন ভাঙ্গাবাড়ি), মোছা. আছিয়া বেগম (কাজিপাড়া), মোছা. হাসনা বেগম (কাজিপাড়া), মোছা. জয়গন (তেঁতুলিয়া), রাজু বালা (চাঁদপুর), মোছা. মাহেলা বেগম (সয়াধানগড়া), মোছা. রাহেলা বেগম (সয়াধানগড়া), মোছা. নূরজাহান বেওয়া (সয়াধানগড়া), মোছা. হামিদা বেগম (সয়াগোবিন্দ), মোছা. হাজেরা খাতুন (আড়িয়ামোহন), মোছা. শামসুন্নাহার বেওয়া (তেলকুপি), মোছা. কমলা বেওয়া (ভিক্টোরিয়া স্কুল রোড), মোছা. ছামেনা খাতুন (আল মাহমুদ এভিনিউ), আয়মনা (জেলি রোড, ধানবান্ধি), মোছা. ছুরাইয়া খাতুন (কোল গয়লা), মোছা. রহিমা বেওয়া (চককোবদাস পাড়া), মোছা. করিমন বেগম (তেঁতুলিয়া) ও মোছা. খোদেজা বেগম (নতুন ভাঙ্গাবাড়ি)।
সিরাজগঞ্জ সদরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে ‘বিজয় সৌধ’, মহকুমা প্রশাসক এ কে শামসুদ্দিন আহমেদ স্মরণে শামসুদ্দিন স্টেডিয়াম, শামসুদ্দিন গেইট, জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষের নাম ‘শামসুদ্দিন সম্মেলন কক্ষ’, শহীদ শাহেদের নামানুসারে রহমতগঞ্জের নাম শাহেদ নগর, পলাশডাঙ্গা যুবশিবির- বা মির্জা বাহিনীর পরিচালক আব্দুল লতিফ মির্জার ম্যুরাল স্থাপনসহ সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশন থেকে রায়পুর পর্যন্ত সড়কের নাম মির্জা সড়ক করা হয়েছে। দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত চত্বরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সম্বলিত একটি স্তম্ভ বা নামফলক নির্মিত হয়েছে। চণ্ডিদাসগাতীতে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে দুর্জয় বাংলা নামে একটি ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। বাজার স্টেশন চৌরাস্তার মোড়ে স্বাধীনতা স্কোয়ার এবং এর সন্নিকটে ‘মুক্তির সোপান’ নামে শহীদ মিনার আকৃতির একটি স্মৃতিস্মারক নির্মিত হয়েছে। এ ছাড়া, সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ মিনার বা স্মারকস্তম্ভ। [মো.হাবিবউল্লাহ বাহার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড