বীর উত্তম সালাহ উদ্দিন আহমেদ
সালাহ উদ্দিন আহমেদ, বীর উত্তম (১৯৪৯-১৯৯৫) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৯ সালের ১৪ই মে চাঁদপুর সদর উপজেলার দাশাদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সাঈদ উদ্দিন আহমেদ এবং
মাতার নাম আলপুমান নেছা৷ সালাহ উদ্দিন আহমেদ দাশাদী প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে চাঁদপুর সফরমালী হাইস্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৬৭ সালে তিনি এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬৯ সালে চাঁদপুর কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এ যোগদান করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে সালাহ উদ্দিন আহমেদ ইপিআর-এর চট্টগ্রাম সেক্টরের অধীন হালিশহরে সিপাহি পদে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্বিচার গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বাঙালি সামরিক, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা বিদ্রোহ করেন। সালাহ উদ্দিন আহমেদ ও তাঁর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তমএর নেতৃত্বে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে তিনি চট্টগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে চাঁদপুর জেলায় তাঁর নিজ গ্রামে পৌঁছান। সেখানে তিনি স্থানীয় সংগ্রাম কমিটিতে যোগ দিয়ে এলাকার ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এপ্রিল মাসের শেষদিকে তিনি আগরতলার হাতিমারা ক্যাম্পে উপস্থিত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখান। এ ক্যাম্পে তিনি প্রায় একমাস মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। এরপর তাঁকে মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডো দলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উচ্চতর আত্মঘাতী নৌ-কমান্ডো প্রশিক্ষণের জন্য তিনি মেলাঘর থেকে মুর্শিদাবাদ জেলার পলাশী নৌ-প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে যান। সেখান থেকে নৌযুদ্ধে বিস্ফোরক ব্যবহারে উচ্চতর প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর তিনি সাবমেরিনার বদিউল আলম, বীর উত্তমএর নেতৃত্বে অপারেশন জ্যাকপট-এ অংশগ্রহণ করার জন্য চাঁদপুর আসেন। ১৫ই আগস্ট নৌ- কমান্ডোদল চাঁদপুর নৌ-বন্দরের মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় নোঙর করা ছয়টি জাহাজ লিমপেট মাইনের সাহায্যে ডুবিয়ে দিয়ে বন্দরকে অচল করে দেন। পরবর্তীতে অক্টোবর মাসে সাবমেরিনার শেখ আমানউল্লার নেতৃত্বে বিশজন নৌ-কমান্ডোসহ অপারেশন পরিচালনার জন্য পুনরায় চাঁদপুর আসেন। সালাহ উদ্দিন ও তাঁর সহ-নৌ-কমান্ডোরা চাঁদপুর বন্দর এলাকায় বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। সে-সবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এখলাসপুরের নিকট জাহাজ এম ভি সামি অপারেশন। ৪ঠা নভেম্বর সালাহ উদ্দিন জানতে পারেন যে, চাঁদপুর বন্দরের অদূরে এখলাসপুরের কাছে মেঘনা নদীতে এম ভি সামি ও আরো একটি জাহাজ নোঙর করে আছে। তিনি, মো. শাহজাহান কবির, বীর প্রতীক এবং আরো একজন নৌ-কমান্ডো পাকিস্তানি সৈন্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সাঁতরে জাহাজ এম ভি সামির নিকট যান এবং এর গায়ে লিমপেট মাইন সেট করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাইন বিস্ফোরিত হয়ে জাহাজটি ডুবে যায়। তবে এ অপারেশনে তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন এবং নির্মমভাবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অতি কৌশলে তিনি শত্রুসেনাদের হাত থেকে মুক্ত হতে সক্ষম হন।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার সালাহ উদ্দিন আহমেদকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে তিনি তাঁর কর্মস্থল বিডিআর-এ যোগদান করেন এবং ১৯৯১ সালে ডেপুটি এসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর (সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদের সমমান) পদে উন্নীত হন। উল্লেখ্য যে, বিডিআর-এ কর্মরত অবস্থায় তিনি ১৯৭২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৮০ সালে বিএ এবং ১৯৮৪ সালে এলএলবি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৯৫ সালের ৩রা জুলাই লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন দুই কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম সালমা আহমেদ। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড