বীর উত্তম সালাহউদ্দিন মমতাজ
সালাহউদ্দিন মমতাজ, বীর উত্তম (১৯৪৫-১৯৭১) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৪৫ সালে ফেনী জেলার নর্থ চারিপুর গ্রামের মুক্তারবাড়িতে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম এডভোকেট শামসুদ্দিন আহমেদ এবং মাতার নাম খায়রুন নাহার। তিনি ছিলেন অবিবাহিত।
সালাহউদ্দিন মমতাজের পিতা কলকাতায় আইন পেশা শুরু করেন এবং সেই সূত্রে তাঁর শৈশব কাটে কলকাতা শহরে। সেখানে তাঁর বাল্যশিক্ষার শুরু।
তবে দেশভাগের পর পিতামাতার সঙ্গে তিনি ফেনী চলে আসেন। তিনি ফেনী পাইলট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ফেনী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ঐ কলেজেই বিএসসি ক্লাসে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি বিমান বাহিনী ছেড়ে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে (কাকুল) ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। সফলভাবে কোর্স সমাপ্তির পর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন প্রাপ্ত হন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সালাহউদ্দিন পাকিস্তানের কোয়েটা সেনানিবাসে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি কোয়েটা থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং ‘জেড’ ফোর্সের অধীনে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কামালপুরে ছিল পাকিস্তান বাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি। জুলাই মাসে ‘জেড’ ফোর্সের প্রধান মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম পাকসেনাদের ঘাঁটি আক্রমণের জন্য মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীকে নির্দেশ দেন। এ অপারেশনের প্রথম এসল্ট কোম্পানির দায়িত্ব পান ডেল্টা কোম্পানির ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ। পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণের আগে ২৮শে জুলাই রাতে তিনি কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে আক্রমণের জায়গাটি রেকি করতে যান। অন্ধকারের মধ্যে তিনি একটি পাকিস্তানি পর্যবেক্ষণ চৌকির মধ্যে ঢুকে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে দুজন পাকসেনাকে হত্যা করে তাদের রাইফেল দুটি হস্তগত করেন। এ ঘটনায় পাকিস্তানি সেনারা অনেকটা হতভম্ব হয়ে পড়ে। ২৯শে জুলাই পাকিস্তানি বাহিনী পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজী কামালপুর পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করার নির্দেশ দেয়।
মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে কামালপুর বিওপি আক্রমণের তারিখ নির্ধারিত করা হয় ৩০শে জুলাই। পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজের নেতৃত্বে ডেল্টা কোম্পানি বাম দিক থেকে এবং ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে ব্রাভো কোম্পানি ডান দিক থেকে আক্রমণ করবে।
৩০শে জুলাই গভীর রাতে সালাহউদ্দিন মমতাজ কামালপুর পাকিস্তানি বিওপি আক্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। তবে প্রচণ্ড বৃষ্টি ও ঘোর অন্ধকারে এফইউপিতে তাঁর বাহিনীর পৌছাতে কিছু বিলম্ব হয়। এমতাবস্থায় নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ পরিকল্পনা ও নির্দেশনার বিষয় যথার্থভাবে সমন্বিত না হওয়ার কারণে এসল্ট ফরমেশনের পূর্বেই তাদের শত্রুবাহিনীর আক্রমণের শিকার হতে হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে সেইমসাইড ঘটনাও ঘটে। ফলে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন। এমনি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যেও অদম্য সাহসিকতার সঙ্গে সালাহউদ্দিন মমতাজ ও তাঁর বাহিনী প্রচণ্ড শক্তিতে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায় বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধা শত্রুক্যাম্পে ঢুকে পড়েন এবং কমিউনিটি সেন্টারের সামনে হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হন। এরই মধ্যে শত্রুর গোলার আঘাতে ব্রাভো কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হাফিজ আহত হয়ে পিছিয়ে এলে কোম্পানির এসল্ট ফোর্স প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এ কোম্পানির অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ- সময় সেকেন্ড লাইন থেকে শত্রুদের কাউন্টার আক্রমণ মোকাবেলা করতে সালাহউদ্দিন মমতাজ ব্রাভো কোম্পানিকে নির্দেশ দেন। এমনি সময় শত্রুদের ছোড়া দুটি কামানের গোলা ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনকে আঘাত করে এবং তিনি সঙ্গে-সঙ্গে শহীদ হন। বকশীগঞ্জের কামালপুরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ ও মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শহীদ ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজকে সরকার কর্তৃক ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। এ বীর -মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য বকশীগঞ্জ উপজেলার কামালপুর বাজার সংলগ্ন বিজিবি ক্যাম্পের মাঠে “শহীদ ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম স্মৃতি কমপ্লেক্স’ স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও টাঙ্গাইলের ঘাটাইল সেনানিবাসের নামকরণ করা হয় ‘শহীদ সালাহউদ্দিন সেনানিবাস’। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড