বীর উত্তম সাহাবুদ্দিন আহমেদ
সাহাবুদ্দিন আহমেদ, বীর উত্তম (জন্ম ১৯৪৮) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৮ সালের ৩রা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার সদর উপজেলার চর কমলাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম
গিয়াসউদ্দিন আহমেদ এবং মাতার নাম লাইলী রশিদ। তিনি ১৯৬৩ সালে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ঐ বছরই ঢাকা ফ্লাইং ক্লাবে ভর্তি হয়ে বৈমানিক হবার প্রশিক্ষণ শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকার সিটি নাইট কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি পাইলট হিসেবে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইনস (পিআইএ)-এ যোগ দেন। ১৯৭১ সালের উত্তাল গণআন্দোলনের সময় পিআইএ-তে কর্মরত বাঙালি পাইলটগণ এ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। ফলে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার বিমানবন্দর এলাকায় বাঙালি পাইলটদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এ-সময় সাহাবুদ্দিন অন্যান্য বাঙালি পাইলটদের নিয়ে ইস্ট পাকিস্তান এয়ারলাইনস পাইলট এসোসিয়েশন গঠন করেন। ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাকিস্তানি সেনারা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। এ-সময় চারজন বাঙালি ক্যাপ্টেনকেও তারা হত্যা করে। পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ ও বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনে সাহাবুদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে ৭ই এপ্রিল ভারতে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজ করতে থাকেন।
২৮শে সেপ্টেম্বর এ কে খন্দকার, বীর উত্তমএর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে বিমান উইং (বাংলাদেশ বিমানবাহিনী) গঠিত হলে তিনি তাতে যোগ দেন। ভারতের দেয়া একটি ডিসি-৩ ডাকোটা বিমান (যোধপুর মহারাজার নিকট থেকে উপহার হিসেবে প্রাপ্ত), একটি অটার বিমান ও একটি এলুয়েট হেলিকপ্টার নিয়ে ভারতের নাগল্যান্ডের ডিমাপুর বিমান ঘাঁটিতে এ বাহিনীর কার্যক্রম শুরু হয়। ১লা অক্টোবর থেকে এ বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ, অনুশীলন ও মহড়া শুরু হয়। সাহাবুদ্দিন ও তাঁর সহযোদ্ধারা জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে অনেক নিচু দিয়ে রাতের বেলা শুধু কম্পাসের ওপর নির্ভর করে বিমান চালিয়ে আলোবিহীন রানওয়েতে অবতরণের মতো কঠিন প্রশিক্ষণ আয়ত্ত করেন। প্রথম দিকে সাহাবুদ্দিন জঙ্গি বিমান চালনার প্রশিক্ষণ নেন। পরে লোকবল সংকটের কারণে তিনি হেলিকপ্টার বিভাগে কাজ শুরু করেন।
প্রশিক্ষণ শেষে সাহাবুদ্দিন আহমেদ পাকিস্তানি সেনাদের তেলের ডিপো, ঘাঁটি ও কনভয়ের ওপর অনেকগুলো সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। সে-সবের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর জ্বালানি তেলের ডিপো আক্রমণ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। ৩রা ডিসেম্বর মধ্যরাতে সাহাবুদ্দিন আহমেদ, সুলতান মাহমুদ, বীর উত্তম ও বদরুল আলম, বীর উত্তম ও দুজন টেকনিশিয়ান এলুয়েট হেলিকপ্টার নিয়ে ডিমাপুর বিমান ঘাঁটি থেকে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল অভিমুখে যাত্রা করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল ১৪টি রকেট ও একটি মেশিনগান। অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে নিচু দিয়ে চালিয়ে শত্রুসৈন্যদের রাডারকে ফাঁকি দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই তাঁরা গোদনাইল তেলের ডিপোতে বোমা নিক্ষেপ শুরু করেন। মুহূর্তের মধ্যে তেলের ডিপোগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে। অত্যন্ত সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে বদরুল আলম ও তাঁর সহযোদ্ধাগণ সবগুলো ডিপো জ্বালিয়ে দেন। উল্লেখ্য, একই দিনে এ বাহিনীর আকরাম আহমেদ, বীর উত্তম ও শামসুল আলম, বীর উত্তম চট্টগ্রামে অবস্থিত ইস্টার্ন রিফাইনারির ওপর বিমান থেকে বোমা ফেলে সব তেলের ডিপো জ্বালিয়ে দেন। এর ফলে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কার্যক্রম দু-এক দিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়।
সাহাবুদ্দিন আহমেদ ১১ই ডিসেম্বর নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলায় আরো একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন পরিচালনা করেন। ঐদিন হেলিকপ্টার থেকে মিত্রবাহিনীর ছত্রীসেনা অবতরণের সময় তাদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আক্রমণ চালায়। এক পর্যায়ে মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাহায্য কামনা করে। খবর পেয়েই সাহাবুদ্দিন আহমেদ হেলিকপ্টারে এ বাহিনীর একটি ইউনিট নিয়ে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রায়পুরা যাত্রা করেন। অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে শত্রুর ফায়ারিং রেঞ্জের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর সফল আক্রমণ পরিচালনা করেন। তাঁদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২০ জন সদস্য নিহত এবং ৪৫ জন আহত হয়। অপারেশন শেষে তাঁরা নিরাপদে তাঁদের ডিমাপুর ঘাঁটিতে ফিরে যান।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার সাহাবুদ্দিন আহমেদকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৭১, খেতাবের সনদ নং ৬৪)। এছাড়াও এ বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে ঢাকা শহরের গুলশান এলাকার ৩৫ নং সড়কটির নামকরণ করা হয় বীর উত্তম সাহাবুদ্দিন আহমেদ সড়ক।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে সাহাবুদ্দিন আহমেদ তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ বিমানে যোগদান করেন এবং ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। ২০০৭ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনি এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম নার্গিস আহমেদ। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড