You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে সিংগাইর উপজেলা (মানিকগঞ্জ)

সিংগাইর উপজেলা (মানিকগঞ্জ) রাজধানী ঢাকা থেকে ৪০ কিমি পশ্চিমে এবং মানিকগঞ্জ জেলা শহর থেকে ১৫ কিমি পূর্বে অবস্থিত। এগারটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ উপজেলার মধ্য দিয়ে মানিকগঞ্জ-হেমায়েতপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক চলে গেছে। রাজধানী ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধে এ উপজেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধের সময় যে-সকল উপজেলায় গেরিলা বাহিনী গড়ে উঠেছিল, সিংগাইর সেগুলোর একটি। এ উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় নির্বিচার গণহত্যা। ফলে ঢাকা থেকে হাজার-হাজার মানুষ সিংগাইরে এসে আশ্রয় নেয়। স্থানীয় মানুষ তাদের অনেককে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দেয় এবং বাকিদের জন্য ক্যাম্পের ব্যবস্থা করে। এলাকার যুবকরা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে ছুটিতে থাকা সামরিক, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য এবং এসব বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের দ্বারা বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে ওঠে। স্থানীয় ছাত্র-যুকবরা এসব ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন এবং তাঁদের নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা এতে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামী লীগ- এ-ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করলেও বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপমোজাফ্ফর)-র অবদানও কম ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় সিংগাইরে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপএর নেতৃবৃন্দ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। আর কমান্ডারের ভূমিকা পালন করেন ইঞ্জিনিয়ার তোবারক হোসেন (লুডু) এবং এডভোকেট মো. ফজলুল হক খান। পাকবাাহিনী সিংগাইরে প্রবেশ করার আগে সরকারি পুলিশ বাহিনী যাতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতা চালাতে না পারে, সেজন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন। ৪ঠা মে রাতে সিংগাইর থানার ওপর এরূপ একটি আক্রমণ হয়। এতে নেতৃত্ব দেন পার্শ্ববর্তী ধামরাই থানার কমান্ডার আব্দুল বাতেন। এর ফলে থানার প্রচুর অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্ৰথম প্রকাশ্য অভিযান। ১৭ই জুন চারিগ্রাম ইউনিয়নের চারিগ্রাম বাজার-সংলগ্ন লঞ্চঘাটে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর একটি টহল
কেরানীগঞ্জ দলের ওপর আক্রমণ করে তাদের গতিরোধ করার চেষ্টা করেন। এতে পাকসেনাদের ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং চারিগ্রামের সঙ্গে মানিকগঞ্জের লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
জুলাই মাসে পাকবাহিনী সিংগাইরে প্রবেশ করে সিংগাইর থানা ভবন, সিংগাইর হাইস্কুল ও সিংগাইর দাতব্য হাসপাতালে ক্যাম্প স্থাপন করে। এর আগে তারা মানিকগঞ্জ শহর থেকে এসে সিংগাইরে আক্রমণ চালাত।
সিংগাইরে মুসলিম লীগ ও এর ছাত্র সংগঠন এনএসএফ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিল। এর নেতা-কর্মীরা পাকবাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। পাকবাহিনী এলাকার তরুণ ও আনসার সদস্যদের রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে উৎসাহিত করে। এর ফলে সিংগাইরে অনেকেই রাজাকার বাহিনীতে নাম লেখায়। রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ছিল— মোহাম্মদ আলী খান (চর আজিমপুর), মোহাম্মদ আলী ফকির (চর আজিমপুর), দুদু খান (চর আজিমপুর), দেল খান (চর আজিমপুর), লাল মিয়া (আজিমপুর খাড়াপাড়া), খৈইমুদ্দিন (আজিমপুর কসাইপাড়া), আওলাদ হোসেন (আজিমপুর), আব্দুর রশিদ (আজিমপুর), রফিক উদ্দিন দেওয়ান (আজিমপুর), পান্নু মিয়া (আজিমপুর), এরশাদ আলী (আজিমপুর), আব্দুল জলিল মোল্লা (ছোট কালিয়াকৈর), আব্দুল খালেক (ছোট কালিয়াকৈর), হাশেম আলী (বড় কালিয়াকৈর), মোস্তফা জামাল (বড় কালিয়াকৈর), বাহারউদ্দিন বাহার (বড় কালিয়াকৈর), মো. সিদ্দিক (বড় কালিয়াকৈর), আব্দুল মাজেদ (বড় কালিয়াকৈর), এ কে এম দবির উদ্দিন (বড় কালিয়াকৈর), চান মিয়া (বিনোদপুর), আজিজ মিয়া (উত্তর চারিগ্রাম), আব্দুল লতিফ (দাশের হাটি), আব্দুল লতিফ (উত্তর জাইল্যা), আব্দুর রশিদ (চারিগ্রাম), রহমত উল্লাহ (চারিগ্রাম), দলিল উদ্দিন (দক্ষিণ চারিগ্রাম), জাফর মেম্বার (পশ্চিম বরাইটে), মো. চাঁন মিয়া (গোবিন্দল), মো. বাহাদুর (গোবিন্দল), দেওয়ান মনিরুদ্দিন মুন্সী (গোবিন্দল), ফজলুল হক (গোবিন্দল), নূর ইসলাম দেওয়ান (গোবিন্দল), সোহরাব আলী (গোবিন্দল), ইউসুফ কমান্ডার (ভাকুম), দেওয়ান মো. আজিজুল মাস্টার (লক্ষ্মীপুর), মো. আনছার দেওয়ান (লক্ষ্মীপুর), নাসির দেওয়ান (লক্ষ্মীপুর), মো. জয়নাল দেওয়ান (লক্ষ্মীপুর), মো. রেজ্জাক দেওয়ান (লক্ষ্মীপুর), মো. জয়নাল উদ্দিন চৌকিদার (নীলটেক), মো. সুলতান বেপারী (নীলটেক), নূর মোহাম্মদ বেপারী (নীলটেক), আমের উদ্দিন (নীলটেক), সুলতান ফকির (নীলটেক), ইসলাম দেওয়ান (নীলটেক), হাফেজ শাহজাহান (মাধবপুর), নায়েব আলী (গাড়াদিয়া), মাসুদ আলী (পাঁচপাড়া), বীর চাঁন (পাঁচপাড়া), দাগু (বায়রা), হোসেন আলী (জামালপুর), ফেরদৌস মাস্টার (পাঁচপাড়া), হাসু (পাঁচপাড়া), হায়াত আলী (জামালপুর), পাশু ফকির (দক্ষিণ বাইমাইল) প্রমুখ।
সিংগাইরে শান্তি কমিটির হয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে, তারা হলো— আব্দুল আলী দেওয়ান (পিতা মোহাম্মদ দেওয়ান, গোবিন্দল; শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), হারান উদ্দিন বেপারী (বড় কালিয়াকৈর), কফিল উদ্দিন মাস্টার (বড় কালিয়াকৈর), দাগু বেপারী (বড় কালিয়াকৈর), ডেঙ্গু মিয়া (ঘোনাপাড়া), আব্দুর রব (ঘোনাপাড়া), আব্দুল মান্নান (কাংশা), বাদশা ফকির (কাংশা), আমিরুদ্দিন মুন্সী (নয়াডাঙ্গী), মাইনুদ্দিন কাজী (আজিমপুর), ছোতন মাদবর (আজিমপুর), আমু (সিংগাইর), লুৎফর রহমান দেওয়ান (চর লক্ষ্মীপুর), মুছা কাজীম মৃধা (সাহরাইল), মো. কফিল উদ্দিন (কালিন্দী), সীকিম মৃধা (সাহরাইল), আনসার দেওয়ান (চর লক্ষ্মীপুর), তালেব আলী (খাসের চর), আজিজ কেরানী (খাসের চর), আজিমুদ্দিন মেম্বার (ধল্লা), মোকছেদ আলী মেম্বার (দক্ষিণ ধল্লা), বশির মাস্টার (দাশের হাটি), আমিন কোম্পানী (চারিগ্রাম), মৌলভী রফিকুল ইসলাম (বেগুনটিউরি), মকবুল হোসেন খান (সাহরাইল), জালাল উদ্দিন (জামালপুর) প্রমুখ।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা সিংগাইরে ব্যাপক হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালায়। বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলোতে তাদের তাণ্ডব বেশি চলে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হানাদারদের হাতে ৮৯ জন সাধারণ গ্রামবাসী শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে ৫৮ জন হলেন— আব্দুস সাত্তার (পিতা বকশী মোল্লা, জায়গীর), আবু বক্কর (পিতা আব্দুস সাত্তার, জায়গীর), বিশার মা (স্বামী ঝুমুর আলী, জায়গীর), আতাউর রহমান (পিতা ঝুমুর আলী, মেদুলিয়া), বোরহান মোল্লা (পিতা শাহা মোল্লা, জায়গীর), মদন মিয়া (পিতা চরণ ঠাকুর, জায়গীর), আব্দুস সামাদ (পিতা সোনা উল্লা, বাস্তা), নোয়াব আলী (গাজিন্দা), আব্দুল বাসেত (গাজিন্দা), আব্দুস সালাম মুন্সী (পিতা আজিমুদ্দিন মুন্সী, কাংশা, তালেবপুর), গৌরাঙ্গ মণ্ডল (পিতা সরিন্দ্র মণ্ডল, রামনগর), নিতাই মণ্ডল (পিতা সরিন্দ্র মণ্ডল, রামনগর), রাজেশ মণ্ডল (পিতা সরিন্দ্র মণ্ডল, রামনগর), কানাই মণ্ডল (পিতা বিজয় মণ্ডল, রামনগর), লাল মালু (পিতা গবরধন মণ্ডল, রামনগর), শাসি মালু (পিতা মহেশ মালু, রামনগর), নেপাল মালু (পিতা চিন্তাহরণ মালু, রামনগর), মো. আনছার আলী (পিতা বছর উদ্দিন, রামনগর), শেখ জরু মণ্ডল (পিতা তাজেল মণ্ডল, রামনগর), কাদের মণ্ডল (পিতা তাজেল মণ্ডল, রামনগর), আলম (পিতা শেখ হাছাই, রামনগর), শুকুমদ্দিন (পিতা বছর উদ্দিন, রামনগর), যোগেশ শীল (পিতা সুরেশ শীল, রামনগর), কালু সাহা (পিতা বিপুন সাহা, রামনগর), কালাচান মালু (পিতা ঘোপেশ্বর মালু, রামনগর), শুকুমার মালু (পিতা নারায়ণ মালু, রামনগর), কমল মাঝি (পিতা কালু মাঝি, রামনগর), শামু মণ্ডল (পিতা জ্ঞানাই মণ্ডল, রামনগর), আয়নাল হক (পিতা সাহাজুদ্দিন মুন্সী, রামনগর), বলাই শীল (পিতা শঝা শীল, রামনগর), জিতেন রায় (পিতা জগদীশ রায়, রামনগর), অজিত কর্মকার (পিতা গংগা কর্মকার, রামনগর), নীহার রঞ্জন রায় (পিতা মোহিনী মোহন রায়, সিংগাইর), কেশব লাল বসাক (পিতা রজনী বসাক, সিংগাইর), ধীরেন্দ্রনাথ বসাক (পিতা অবনী বসাক, সিংগাইর), পরেশ চন্দ্র বসাক (পিতা কাঙ্গালী বসাক, সিংগাইর), ক্ষেত্রমোহন মালো (পিতা রাখাল চন্দ্র মালো, সিংগাইর), চুনীলাল সাহা মণ্ডল (পিতা পূর্ণচন্দ্র সাহা মণ্ডল, সিংগাইর), রবীন্দ্র কুমার সাহা টেন্ডল (পিতা ফণীভূষণ সাহা, সিংগাইর), ইন্তাজ আলী (পিতা কানু কারিগর, সিংগাইর), করম আলী (পিতা মজর আলী, সিংগাইর), কান্দনী সরকার (পিতা গঙ্গাধর মণ্ডল, সিংগাইর), ডা. নরেন্দ্র মোহন মণ্ডল (পিতা যুধিষ্ঠির মণ্ডল, সিংগাইর), নিতাই চান বসাক (পিতা বিপিন চন্দ্র বসাক, সিংগাইর), নয়ন তারা বসাক (পিতা নিতাই চান মাস্টার, সিংগাইর), আব্দুর রহিম মীর (পিতা একরাম আলী মীর, সিংগাইর), বিমান বিহারী সাহা (পিতা বিপিন বিহারী সাহা, সিংগাইর), রাজেশ্বরী মালো (স্বামী দয়াল হালদার, সিংগাইর), ডা. হরিপদ সাহা (পিতা জ্ঞানমোহন, জামিৰ্ত্তা), আব্দুল আজিজ (পিতা কলিম উদ্দিন, জামিৰ্ত্তা), আফসার উদ্দিন (পিতা মফিজ উদ্দিন, জামিৰ্ত্তা), আব্দুল লতিফ (পিতা চান্দু ফকির, জামির্ত্তা), ভাবন চন্দ্ৰ দে (পিতা মতিলাল দে, জয়মন্টপ), কল্পনা সাহা (পিতা শরৎ চন্দ্র সাহা, জয়মন্টপ), রমেশ সাহা (পিতা শরৎ চন্দ্র সাহা, জয়মন্টপ), মাধব চন্দ্র শীল (পিতা সদানন্দ, মাটিকাকাট) এবং পিয়ার আলী (সারারিয়া; ইপিআর সদস্য)। এছাড়া গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধে ১৪ জন ও ধল্লা যুদ্ধে ২২ জন গ্রামবাসী এবং ধল্লা যুদ্ধে ৪ জন ও চাপড়াইল যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সিংগাইরে পাকবাহিনী যাঁদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়, তাঁরা হলেন— শামেলাল সাহা মণ্ডল (পিতা হীরালাল সাহা মণ্ডল, সিংগাইর), আজিজুর রহমান চৌধুরী (পিতা হাবিবুর রহমান চৌধুরী, রায়দক্ষিণ), মুসা মাদবর (পিতা লাল মাহমুদ, বাস্তা), জহুর উদ্দিন (পিতা লাল মাহমুদ, বাস্তা), জয়নাল (পিতা বাবুর শেখ, গাজিন্দা), কাবিল মাদবর (পিতা সেখ বুদাই, বাস্তা), যাদু ফকির (পিতা চেরাগ আলী, বাস্তা), হাফেজ উদ্দিন (পিতা লেহাজ উদ্দিন, বাস্তা), আকিমুদ্দিন (পিতা লেহাজ উদ্দিন, বাস্তা), নছর উদ্দিন (পিতা লেহাজ উদ্দিন, বিন্নাডাঙ্গী), অতুশী (পিতা নিমাই নিয়ামত, দক্ষিণ ধল্লা), রহিমদ্দিন (পিতা ইয়াকুব আলী, দক্ষিণ ধল্লা), খৈইমুদ্দিন (পিতা বাদানী, দক্ষিণ ধল্লা), ডা. মতিয়ার রহমান (পিতা আজমত আলী মুন্সী, পশ্চিম বাস্তা), নোয়াব আলী (পিতা মরুপদ্দি, বাস্তা), আলেপ মিয়া (পিতা আফেজ উদ্দিন, বাস্তা), সত্তার মোল্লা (পিতা বক্কার, বাস্তা), ইলাহী বক্স (পিতা আব্দুল মোল্লা, মেদুলিয়া), চরন মোল্লা (মেদুলিয়া), বুরহান মোল্লা (জায়গীর) ও মধু মিয়া (ধল্লা ইউনিয়ন)।
সিংগাইর উচ্চ বিদ্যালয় ভবন, থানা ভবন এবং থানা হাসপাতাল ভবনকে পাকবাহিনী নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করত।
সিংগাইর হাইস্কুলের পূর্বপাশে কলেজ-সংলগ্ন ডোবায় অনেককে হত্যা করে ডোবার পাশে কবর দেয়া হয়। তাই এ স্থানটি সিংগাইর কলেজ বধ্যভূমি ও গণকবর নামে পরিচিত এছাড়া আরেকটি গণকবর আছে— গোলাইডাঙ্গা গণকবর। ২৯শে অক্টোবর গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধে নিহতদের এখানে গণকবর দেয়া হয়। পাকবাহিনী অনেক শহীদের লাশ নদীতেও ভাসিয়ে দেয়। কোথাও-কোথাও হত্যার পর লাশগুলো উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখে।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে সিংগাইরে ইঞ্জিনিয়ার তোবারক হোসেন লুডুর নেতৃত্বে লুডু বাহিনী নামে একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠে। পরে এ বাহিনী ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিমের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মূল বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয়। সিংগাইর উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি যুদ্ধ হয়- বায়রা যুদ্ধ, গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধ, চাপড়াইল যুদ্ধ ও ধল্লা যুদ্ধ। বায়রা যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৫ই অক্টোবর সুবেদার মো. সোনামুদ্দিনের নেতৃত্বে। এ-যুদ্ধে ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন ধলা গুরুতর আহত হন। গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২৯শে অক্টোবর কমান্ডার তোবারক হোসেন লুডুর নেতৃত্বে। মানিকগঞ্জ জেলার সর্ববৃহৎ এ-যুদ্ধে ৮১ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ১৪ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। চাপড়াইল যুদ্ধ সংঘটিত হয় ডিসেম্বর মাসে। এ-যুদ্ধে একজন পাকসেনা নিহত হয়। পক্ষান্তরে একজন ইপিআর সদস্য শহীদ এবং দুজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ধল্লা যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৫ই ডিসেম্বর। উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকার দিকে পলায়নরত পাকসেনাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত এ-যুদ্ধে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ও বিভিন্ন গ্রামের ২২ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। এর আগে ১৩ই নভেম্বর সিংগাইর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
সিংগাইর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আনিসুর রহমান (গাজিন্দা; ১৫ই ডিসেম্বর ধল্লা যুদ্ধে শহীদ), মো. রমিজ উদ্দিন (গাজিন্দা; ঐ), শরিফুল ইসলাম (গাজিন্দা; ঐ), মো. আক্কেল আলী (গাজিন্দা; ঐ), মফিজ উদ্দিন (মজলিশপুর), আনসার উদ্দিন (বড় কালিয়াকৈর), মোহাম্মদ আলী (ধল্লা), আবদুস সালাম মোল্লা (শান্তিপুর) এবং ইন্তাজ আলী (ঘোনাপাড়া)।
উপজেলার চারজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- মো. মতিয়ার রহমান খান (বানিয়ারা), দেলোয়ার হোসেন ধলা (গোলড়া), মো. নাজিম উদ্দিন (বাস্তা) এবং ইদ্রিস আলী বিশ্বাস (কালিয়াকৈর )।
উপজেলার ধল্লা ইউনিয়ন হাইস্কুল ক্যাম্পাসে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আনিসুর রহমান, মো. রমিজ উদ্দিন ও মো. আক্কেল আলীর সমাধি বাঁধাই করা হয়েছে। বিজয় দিবসে এ সমাধিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। [মিজানুর রহমান হযরত]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!