You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে সালথা উপজেলা (ফরিদপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে সালথা উপজেলা (ফরিদপুর)

সালথা উপজেলা (ফরিদপুর) ফরিদপুর জেলার বর্তমান সালথা উপজেলা মুক্তিযুদ্ধের সময় নগরকান্দা থানার একটি এলাকা ছিল। ২০০৬ সালে সালথা উপজেলা গঠিত হয়। ৬টি ইউনিয়ন (আটঘর, রামকান্তপুর, গট্টি, ভাওয়াল, সোনাপুর ও যদুনন্দী) নিয়ে সালথা উপজেলা গঠিত।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে সালথা এলাকা থেকে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ-এর কে এম ওবায়দুর রহমান (কেন্দ্রীয় কমিটির সমাজসেবা সম্পাদক) এবং প্রাদেশিক পরিষদে একই দলের এ ওয়াই আমিনউদ্দিন আহমেদ বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে সালথা এলাকায়ও তার প্রভাব পড়ে। এখানে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ছাত্র- জনতা রাস্তায় নেমে আসে। এতে নেতৃত্ব দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মুকুল মিয়া, বদিউজ্জামান, মওলানা ফয়জুর রহমান, ছাত্রলীগ নেতা আবু সাঈদ খান প্রমুখ। ২৫শে মার্চের পর মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন গড়ার লক্ষ্যে আবু সাঈদ খান, বদিউজ্জামান মোল্যা, মওলানা ফয়জুর রহমান, চৌধুরী ইউনুছ আলীসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা একাধিক সভায় মিলিত হন। ২০শে এপ্রিল গৌড়দিয়ায় কয়েকটি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের সভায় সালথায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু ২১শে এপ্রিল ফরিদপুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রবেশের পর প্রক্ষিণ প্রদান করা সম্ভব হয়নি।
জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক নেতা অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ ও ফরিদপুর ইয়াসিন কলেজের ছাত্র কাজী সালাউদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা আটিঘর ইউনিয়নের বিভাগদী গ্রামের স্কুল শিক্ষক আবদুর রশিদ খানের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এক পর্যায়ে আবদুর রশীদ খানের তত্ত্বাবধানে তাঁর বাড়িতে স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পার্শ্ববর্তী বোয়ালমারী থানার নতুবদিয়া বাজারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন, করা হয়৷ তবে মুক্তিযোদ্ধাদের বৈঠক বা পরামর্শ সভা বিভাগদীতেই হতো। সালাউদ্দিন গ্রুপ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এ ক্যাম্পে ফরিদপুর মুজিব বাহিনীর প্রধান শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর ও বোয়ালমারী মুজিব বাহিনীর প্রধান নবাবউদ্দিন টোকনের পরিচালিত গ্রুপ, আলফাডাঙ্গার হেমায়েত উদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল ও মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে নৌকমান্ডো দল বিভাগদী-নতুবদীয়া ক্যাম্পে অবস্থান করত। ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভাঙ্গার ছাত্রনেতা আবু নাসের ইয়ার মোহাম্মদের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ সালথা এবং বোয়ালমারীর মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়ার নেতৃত্বে অপর একটি গ্রুপ সাডুকদিয়ায় আটঘর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করে।
সালথা তথা নগরকান্দায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন কে এম ওবায়দুর রহমান, এ ওয়াই আমিনউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, আবু সাঈদ খান, মওলানা ফয়জুর রহমান, বদিউজ্জামান মিয়া, মুকুল মিয়া, আবদুর রশীদ খান প্রমুখ।
পরবর্তীতে কে এম ওবায়দুর রহমান কোলকাতায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের মটিভেশনসহ মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি কোলকাতাস্থ আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয়েরও দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। এ ওয়াই আমিনউদ্দিন আহমেদ কল্যাণী যুবশিবির পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। ছাত্রনেতা আবু সাঈদ খানও কল্যাণী যুবশিবির পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। তাঁর সম্পাদনায় মুজিবনগর থেকে সাপ্তাহিক উত্তাল পদ্মা প্রকাশিত হতো।
৩০শে এপ্রিল পাকবাহিনী কোনোরূপ প্রতিরোধ ছাড়া সালথা থানায় অনুপ্রবেশ করে। এ এলাকায় পাকবাহিনী বা রাজাকার দের কোনো ক্যাম্প না-থাকলেও খারদিয়ার আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারএর বাড়িতে রাজাকারদের একটি ঘাঁটি ছিল।
সালথা থানায় পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষে রাজাকার ও শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল। রাজাকারদের মধ্যে খারদিয়া গ্রামের আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার সবচেয়ে কুখ্যাত ছিল। তার নেতৃত্বে এলাকায় রাজাকার বাহিনী গঠি হয়। বাচ্চু রাজাকার পরে ফরিদপুর জেলা আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। সে অন্যদের নিয়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে হত্যা, লুটপাট, নারীধর্ষণসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়। সালথার কুখ্যাত অন্য রাজাকারদের মধ্যে ছিল বিভাগদীর আবদুল কাসেম মুন্সী, নটখোলার আবু মোল্লা, খারদিয়ার ইছাহাক মিয়া, আব্দুস সাত্তার মিয়া, মোহাম্মদ কাজী, মো. লাল মিয়া, মানিক বিশ্বাস, আমজেদ মোল্লা, আজাহার কারিকর, হারুনুর রশীদ, লিয়াকত খলিফা, গোলাম জাকারিয়া, আবদুল আজিজ খলিফা, বাবু খান, চাঁদপুরের বাকা মিয়া, আবদুর রাজ্জাক কাজী, মাঝারদিয়ার আবদুস সোবহান মোল্লা বকুল, গোবিন্দপুরের শের আলী খান, হায়দার আলী খান, বাহিরদিয়ার লাল খাঁ, মীরকান্দির আফজাল, হরিনার আব্দুল হামিদ মিয়া, তুগোলদীয়ার সৈয়দ মোহাম্মদ আলী, সিংহপ্রতাপের ইমামুল হোসেন ওরফে তারা মিয়া ও মনছুর মৃধা, নিধিপট্টীর মো. সামসুদ্দীন মোল্যা ও আলাউদ্দীন খান ওরফে চান খা, গোবিন্দপুরের রাজ্জাক খা, গোয়ালপাড়ার গোলাম আলী খান, জগন্নাথদীর গনি কাজী প্রমুখ। এদের অনেকের বিরুদ্ধে লুটপাট, নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যাসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। শান্তি কমিটির সদস্যদের রধ্যে রামকান্তপুরের মোতাহার হোসেন তালুকদার, বিভাগদীর মজিবর রহমান, ভাওয়ালের নাজিম মুন্সী, খারদিয়ার চাঁদ কাজী ও নটখোলার আবু জাফরের নাম উল্লেখযোগ্য।
আবুল কালাম আজাদ বাচ্চুর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী ১৬ই মে পুরুরা গ্রামের মাধবচন্দ্র বিশ্বাসকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৮ই মে বাচ্চু রাজাকারের বাহিনী উজিরপুর বাজারপাড়া গ্রামের ১৮ বছরের এক হিন্দু মেয়েকে অপহরণ এবং নির্যাতন করে। ৩রা জুন বাচ্চু সশস্ত্র রাজাকারদের নিয়ে ফুলবাড়িয়া গ্রামে লুটপাট চালায়। লুটপাটের পর চিত্তরঞ্জন দাসকে গুলি করে হত্যা করে। বাচ্চু আটঘর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা এন্তাজ মোল্লা (বোয়ালিয়া) ও হাজি বছিরউদ্দিন (জয়কালী)-সহ বিভিন্ন আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে চড়াও হয়ে তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। অনেকের কাছ থেকে অর্থও আদায় করে। রাজাকাররা সোনাতন্দী, বল্লভদী, পুরুরা, ফুলবাড়ীয়া, সালথা, গৌড়দিয়া ও সাডুকদিয়া গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করে।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ভাটিয়াপাড়া থেকে লঞ্চযোগে পাকবাহিনীর একটি দল বল্লভদী ইউনিয়নের ফুলবাড়িয়া, আলমপুর, কেশারদিয়া ও কুমারকান্দা গ্রামে অতর্কিতে আক্রমণ করে ১৯ জন গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনা ফুলবাড়িয়া গণহত্যা নামে পরিচিত।
বাচ্চু রাজাকার জেলার নানা স্থানেও হত্যাকাণ্ড ও লুটপাট চালায়। স্বাধীনতার পর দালাল আইনে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধে পলাতক অবস্থায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। কুমারকান্দা ও আলমপুর গ্রামে পাকবাহিনীর গুলিতে নিহতদের কবর রয়েছে। বিভাগদী-নতুবদীয়া ক্যাম্প থেকে আগস্টে হেমায়েত উদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ফরিদপুর শহরে গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে অংশ নেন। অক্টোবরে মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে নৌকমান্ড দল ফরিদপুর-বরিশাল সড়কের বাখুন্ডা ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। এ দল গোয়ালন্দ ঘাটের অদূরে পাকবাহিনীর একটি তেলবাহী ফেরি উড়িয়ে দেয়। এ দুটি অপারেশনে বিভাগদীর আবদুর রশীদ খান ও তার কিশোরী কন্যা হাসনা খান রানী সহযোগিতা করেন। কাজী সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বোয়ালমারী থানার চাঁদপুর ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক মিয়া ও তার সহযোগী আবেদ হাজীকে হত্যা করেন। ৯ই আগস্ট বিভাগদী-নতুবদীয়া ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা কাজী সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে করিমপুরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এ-যুদ্ধে সালাউদ্দিনসহ ৭ জন শহীদ হন।
সালথায় পাকবাহিনীর কোনো ক্যাম্প ছিল না। আগস্টে শান্তি কমিটির লোকজন ও রাজাকাররা এলাকা ত্যাগ করলেও ৭ই নভেম্বর সালথা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। সালথা থানার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- কাজী সালাউদ্দিন আহমেদ, মেজবাউদ্দিন নৌফেল, আবদুল ওহাব, শামসুদ্দীন আহমেদ মোল্লা, মইনউদ্দিন, আবদুল হামিদ ও মজিবুর রহমান। [মো. মজিবুল হক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড