বীর প্রতীক সায়ীদ আহমেদ
সায়ীদ আহমেদ, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫০) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫০ সালের ৬ই এপ্রিল কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার সোনাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আমির হোসেন মজুমদার এবং মাতার নাম সাজেদা হোসেন মজুমদার। তিনি ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে ঐ প্রতিষ্ঠান থেকেই এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে বিএ অনার্সে ভর্তি হন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে সায়ীদ আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। উল্লেখ্য যে, সে-সময় তাঁর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তিনি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ‘৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর দিক-নির্দেশনামূলক সাতই মার্চের ভাষণ সহ তখনকার প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এ-সকল ঘটনার পরে ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে ঢাকাসহ সারা দেশে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করে। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য তিনি এপ্রিল মাসের শেষদিকে ভারতের আগরতলা গমন করেন। পরে সেখান থেকে তাঁকে প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সে ক্যাডেট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২৫শে জুন থেকে ৯ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার মূর্তিতে অবস্থিত তৎকালীন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর তিনি কমিশন প্রাপ্ত হন।
সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত সায়ীদ আহমেদের পোস্টিং হয় ৩ নম্বর সেক্টরের ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। তাঁর ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন মঈনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ও ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ব্রিগেড আকারে ‘এস’ ফোর্স গঠিত হলে মঈনুল হোসেন তাঁকে ৩ নম্বর সেক্টরের কলকলিয়া/বামুটিয়া সাব- সেক্টর অপারেশন পরিচালনা করার দায়িত্ব প্রদান করেন। সায়ীদ আহমেদ অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার সঙ্গে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন। সে-সবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মুকুন্দপুর যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের মে মাস থেকেই এখানে ছিল পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। সায়ীদ আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ১৯শে নভেম্বর পাকসেনাদের ঐ অবস্থানে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। পাকঘাঁটির অবস্থান ভালোভাবে জানার জন্য তিনি রেকি করে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। ১৯শে নভেম্বর সীমান্ত অতিক্রম করে এসে মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে পরিকল্পনা মোতাবেক নিজ-নিজ স্থানে অবস্থান নেন। এক পর্যায়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৮ রাজপুত রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়। নির্ধারিত সময়ে আক্রমণ শুরু হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর পাল্টা আক্রমণের ফলে ১৮ রাজপুত কোম্পানিটি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় সায়ীদ আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে ভারতীয় বাহিনী অবরুদ্ধ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। এ-যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয় এবং ২৯ জন পাকিস্তানি সেনা ও কয়েকজন ইপিসিএএফ বন্দি হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার সায়ীদ আহমেদকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ২৭৬, খেতাবের সনদ নং ২৬)। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি তাঁর কর্মক্ষেত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং পদোন্নতি পেয়ে ১৯৯৬ সালে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি একবছর কুয়েত এবং দুবছর কেনিয়াতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। ব্যক্তিজীবনে সায়ীদ আহমেদ ২ কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম নাসরিন আহমেদ। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড