সাদিপুর যুদ্ধ (ওসমানীনগর, সিলেট)
সাদিপুর যুদ্ধ (ওসমানীনগর, সিলেট) সংঘটিত হয় ৫ ও ২২শে এপ্রিল। এ-যুদ্ধে প্রথমদিকে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা পরাজিত ও বিপর্যস্ত হয়। সাদিপুর থেকে তারা সিলেটে পালিয়ে যায়। পরে বিমান আক্রমণ করে পাকবাহিনী সাদিপুরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সাদিপুর যুদ্ধে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপরদিকে অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। ৫ই এপ্রিলের পর ১২ জন হানাদার সৈন্যের লাশ পাওয়া যায়।
কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে হবিগঞ্জে গঠিত গণবাহিনী নিয়ে ২৭শে মার্চ মানিক চৌধুরী ও মেজর সি আর দত্ত সিলেট অভিযানের উদ্দেশ্যে হবিগঞ্জ থেকে রশিদপুর চা বাগানে গিয়ে প্রথমে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এদিনই স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান, তিন ইঞ্চি ও দুই ইঞ্চি মর্টার ইত্যাদি আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর একটি বড় দল সিলেট থেকে সাদিপুর-শেরপুর হয়ে প্রথমে মৌলভীবাজার ও পরে শ্রীমঙ্গলে ক্যাম্প স্থাপন করে। উল্লেখ্য, তখন ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক শেরপুর থেকে মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল হয়ে পাহাড় ও চা বাগানের মধ্য দিয়ে মীরপুর নামক স্থানে মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। মহাসড়কের শেরপুর ও সাদিপুরে কোনো সেতু ছিল না। ফেরির মাধ্যমে ঢাকা- সিলেট সড়কে যানাবাহন পারাপার হতো। সাদিপুর ও শেরপুর বর্তমান সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলার সাদিপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত।
মানিক চৌধুরী ও সি আর দত্ত পাকবাহিনীর শ্রীমঙ্গল অবস্থানের সংবাদ পেয়ে ৩১শে মার্চ তাদের ওপর আক্রমণ পরিচালনার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলে তারা সেখান থেকে মৌলভীবাজারের দিকে ফিরে যায়। মেজর দত্ত মৌলভীবাজারের দিকে অগ্রসর হলে তারা সেখান থেকেও পশ্চাদপসরণ করে শেরপুরে দুই প্লাটুন ও সাদিপুরে এক প্লাটুন সৈন্য মোতায়েন করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকবাহিনীর গতিবিধি, অস্ত্র ও সৈন্য সমাবেশের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে মেজর সি আর দত্ত ধারণা করেন যে, তারা সেখানে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ করবে না। তবে শেরপুর ও সাদিপুরের দুটি ফেরিঘাট পাকবাহিনীর দখলে থাকায় নদীর ওপর ফেরি, নৌকা বা যাত্রী চলাচল সম্পূর্ণভাবে তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ছিল। এ অবস্থায় তারা স্থানীয় জনগণের ওপর নানারকম হয়রানি ও নির্যাতন শুরু করে। মেজর সি আর দত্ত পাকবাহিনীর অবস্থানগত সকল তথ্য অবগত হয়ে ৫ই এপ্রিল শেরপুর আক্রমণ করেন। তীব্র এ আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনারা ফেরি পার হয়ে সাদিপুর চলে যেতে বাধ্য হয়। মেজর দত্ত তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর সৈন্যদের সাদিপুর আক্রমণের নির্দেশ দিলে সেখানে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ-সময় মেজর দত্ত খবর পান যে, পাকবাহিনীর সহযোগিতায় সিলেট থেকে ৩- ৪ ট্রাক পাকসেনা সাদিপুর আসছে। এ অবস্থায় তিনি তখন কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর কাছে মৌলভীবাজার থেকে দ্রুত এক কোম্পানি সৈন্য সাদিপুরে প্রেরণের অনুরোধ করেন। সন্ধ্যার দিকে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। এক সময় ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পাকসেনারা গুলি ছুড়তে-ছুড়তে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা এলাকা ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় উল্লাসে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকলে এলাকার সাধারণ মানুষও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়। ফেরি ও নৌকায় নদীর এপার থেকেও মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষ সাদিপুরে গিয়ে বিজয়ের আনন্দে শরিক হয়। মেজর দত্ত সাদিপুর গিয়ে মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বিজয়ের সংবাদ প্রেরণ করেন। এ-যুদ্ধে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপরদিকে অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করে সিলেটের দিকে পালিয়ে যায়। গণবাহিনী সিলেট অভিযানের উদ্দেশ্যে তাদের অনুসরণ করে অগ্রসর হয়। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর যেসব সদস্য সিলেট শহরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন, তাঁরা গণবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু সমন্বয়ের অভাব ও পাকবাহিনীর শক্তিশালী আক্রমণে মুক্তিবাহিনী – পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। বিচ্ছিন্ন মুক্তিবাহিনীর কোনো-কোনো অংশ শেরপুর ও সাদিপুর এসে পুনরায় সংগঠিত হয়।
২২শে এপ্রিল হানাদার বাহিনী সিলেট থেকে এসে পুনরায় সাদিপুরে প্রবল আক্রমণ করে। এ-সময় তারা বিমান থেকে তাজপুর, গোয়ালাবাজার, সাদিপুর প্রভৃতি এলাকায় বোমা হামলা করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। প্রবল আক্রমণ সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধারা ২৪ ঘণ্টা প্রতিরোধ বজার রেখে শেষ পর্যন্ত পিছু হঠেন। এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধযুদ্ধ। যুদ্ধের শুরু থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অনেক চাপ ছিল। শেষের দিকে পাকিস্তানি বিমান বাহিনী দিনরাত আক্রমণ চালাতে থাকে। এ প্রবল আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা সাদিপুর ছেড়ে দেন। শেরপুর এসে তাঁরা পরবর্তী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। যুদ্ধের প্রথম দিনে ক্যাপ্টেন আজিজ গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড