সানিকদিয়ার চর যুদ্ধ (পাবনা সদর)
সানিকদিয়ার চর যুদ্ধ (পাবনা সদর) ২৭শে নভেম্বর সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি সৈন্য ও নকশালদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের এ-যুদ্ধে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
পাবনার নকশালরা ছিল খুবই দুর্ধর্ষ। তাদের সদস্য- সমর্থকদের মাথায় মাওবাদ ছাড়া অন্য কোনো আদর্শ যাতে ঢুকতে না পারে, সেজন্য তাদের অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার একমাত্র উৎস’ একথা তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত। মানুষ হত্যা, অস্ত্র চালনা, বোমা তৈরি, গেরিলা যুদ্ধের কৌশলসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তাদের অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। তারা ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত। অক্টোবর মাসে নকশালরা আত্মকলহে লিপ্ত হয় এবং অনেকেই পাবনার জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বকুলের দলে যোগ দেয়। নকশালদের দমন করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা সানিকদিয়ার চরে সমবেত হন। সুজানগর থেকে জহুরুল ইসলাম বিশু ১৬টি নৌকা নিয়ে প্রায় ২০০ মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৯শে নভেম্বর শুক্রবার ঈদুল ফিতরের দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হন। বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতি টের পেয়ে নকশালরা অনেকটা আত্মগোপনে থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা নাজিরপুরের নজরুল ইসলাম হাবুর বাড়িতে বসে যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করেন। সে অনুযায়ী পূর্ব-উত্তর দিকে মুন্না ও তাঁর সহযোদ্ধারা, পশ্চিমে আবুল কালাম আজাদ বাবু, উত্তরে সেলিম নশু ও দক্ষিণ-পশ্চিমে সামসুল আলম কমান্ডার তাঁদের বাহিনী নিয়ে আক্রমণে থাকবে বলে পরিকল্পনা করা হয়। ২৭শে নভেম্বর শনিবার যুদ্ধ শুরু হয়। ভোর ৪টা থেকে শুরু হয়ে ১১টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা মুন্না প্রথমে ট্রেসার বুলেট ফায়ারের মাধ্যমে যুদ্ধের সূচনা করেন। দুপক্ষের প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সানিকদিয়ার চরের প্রাইমারি স্কুল ছিল নকশাল ও পাকসেনাদের ঘাঁটি। এখানে তারা বাঙ্কার তৈরি করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা সেলিম মাথায় গামছা বেঁধে দাঁড়িয়ে এসএমজি দিয়ে ফায়ার করতে থাকেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল স্কুলের বাঙ্কার ভাঙ্গা। সহযোদ্ধা জাহিদুল ইসলাম বাবু সেলিমকে দাঁড়িয়ে গুলি করতে নিষেধ করছিলেন। কিন্তু সেলিম তখন বাঙ্কার ভাঙ্গতে মরিয়া। তিনি এক ব্যাগ গ্রেনেড নিয়ে বাঙ্কারের প্রায় ১৫০ গজের মধ্যে চলেও গিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ নকশালদের একটি বুলেট তাঁর মাথা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে-সঙ্গে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। পাকিস্তানি সৈন্য ও নকশালদের সম্মিলিত আক্রমণের বিরুদ্ধে এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযুদ্ধের জেলা কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বকুল। তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন জাহাঙ্গীর আলম সেলিম, ইকবাল হোসেন, ফজলুল হক মন্টু, আবুল কালাম আজাদ, ইসরাইল হোসেন মেছের ও শামসুল আলমসহ আরো অনেকে। এ-যুদ্ধে জাহাঙ্গীর আলম সেলিম, আব্দুল হামিদ, আকতার, হালিম, আব্দুল জব্বার, আব্দুল মতিন, আব্দুল লতিফ, জামাল উদ্দিন, দিলু ও শাহজাহানসহ বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। প্রায় ৬-৭ ঘণ্টার এ-যুদ্ধের খবর পাবনা শহরে পাকসেনাদের নিকট পৌঁছে যায়। মেন্টাল রোড ধরে তিন শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য সানিকদিয়ার চরের দিকে আসতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এ খবর আসামাত্র তাঁরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ তখন প্রায় শেষ। তাই তাঁরা পজিশন গুটিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যান। [মো. ছবেদ আলী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড