মুক্তিযুদ্ধে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা ১৯৭০ সালের শেষ থেকে ১৯৭১ সালের শুরু পর্যন্ত সাতক্ষীরা সদরে বেশকিছু পোস্টার লাগানো হয়। রাতের আঁধারে গোপনে লাগানো সেসব পোস্টারের মূল বক্তব্য ছিল – ‘স্বাধীনতা পেতে হলে রক্ত ঝরাতে হবে।’ এদিকে সারা দেশের মতো সাতক্ষীরায়ও আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ইয়াহিয়া খান কর্তৃক স্থগিত ঘোষিত হলে এখানে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় এবং ২রা মার্চ সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ৭ই মার্চ বিক্ষোভ দিবস পালন উপলক্ষে সাতক্ষীরা কলেজ চত্বর থেকে একটি মিছিল বের হয়ে পাকাপোলের দিকে অগ্রসর হয়। মিছিলকারীদের ‘আর নয় অধীনতা, এবার চাই স্বাধীনতা, “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ইত্যাদি স্লোগানে শহর প্রকম্পিত হতে থাকে। মিছিলটি পাকাপোল হয়ে চাপড়া লজ-এর নিকট এলে আতিয়ার, মতিয়ার ও লিয়াকত নামে তিনজন পাকিস্তানপন্থী মিছিলে গুলি ছোড়ে। এতে আব্দুর রাজ্জাক, খলিলুল্লাহ ঝড়ু, নিজাম, আব্দুল ওয়াহেদ মিয়া প্রমুখ আহত হয়। মিছিলটি প্রথমে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও অল্প সময়ের মধ্যে আবার সংগঠিত হয় এবং শেখ আবু নাসিম ময়না, লাল্টু প্রমুখ মারাত্মক আহত রাজ্জাককে ধরে ডা. জমসেদ আলমের চেম্বারে নিয়ে যায়। ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা বারী খানের পেট্রোল পাম্প থেকে পেট্রোল নিয়ে চাপড়া লজটি পুড়িয়ে দেয়। মিছিলে গুলির প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে জিন্নাহ পার্কে এক বিশাল প্ৰতিবাদী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ছাত্রনেতা মোস্তাফিজুর রহমানের প্রস্তাব এবং শেখ আবু নাসিম ময়নার সমর্থনে রাজ্জাককে শহীদ আখ্যায়িত করে শহরের পার্কে কবর দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় এবং তার নামে পার্কের নতুন নামকরণ করা হয় ‘শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্ক’। এ ঘটনার পর সাতক্ষীরায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-এর শাখা গঠিত হয়। পরিষদের সভাপতি ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম খান। সদস্য ছিলেন- নাজমুল আবেদীন খোকন, এরশাদ হোসেন খান চৌধুরী হাবলু, আজিবর রহমান, কিসমত হাসান, শেখ আবু নাসিম ময়না, মীর মোস্তাক আহমেদ রবি, রবিউল ইসলাম খান চৌধুরী, মাসুদ খান চৌধুরী, খায়রুজ্জামান-১, খায়রুজ্জামান-২, খায়রুল বাসার, দিদারুল ইসলাম, এনামুল হক, গোলাম সাবদার সিদ্দিকী প্রমুখ। আন্দোলনকে বেগমান করার লক্ষ্যে থানায়-থানায় এর শাখা কমিটি গঠন করা হয়। ৮ই মার্চ এরশাদ হোসেন খান চৌধুরী হাবলুর নেতৃত্বে সাতক্ষীরা কোর্ট থেকে জিন্নাহর ছবি নামানোকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতার পক্ষের ও বিপক্ষের সমর্থকদের মধ্যে প্রচণ্ড বাগবিতণ্ডা হয়। ২৩শে মার্চ পাকাপোলের কাছে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে তার প্রতি আনুষ্ঠানিক সালাম জানানো হয়। এ-সময় অনেকের মধ্যে কয়েকজন জেল পুলিশ সদস্যও উপস্থিত ছিলেন।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যার খবর ওয়ারলেস বার্তার মাধ্যমে সাতক্ষীরা থানায় পৌঁছায়। এ বার্তা মীর এরশাদ আলী (ইসু মিয়া)-র হাতে পৌঁছলে তিনি তা প্রচারের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য জনসাধারণকে সংগঠিত করার ব্যবস্থা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় মোস্তাফিজুর রহমান একটি জিপ নিয়ে সাতক্ষীরার আরপি (রেইঞ্জ পুলিশ) ক্যাম্পগুলো ঘুরে সেখানকার সদস্যদের সংগঠিত করেন। হাসান জাহিদ জজের নেতৃত্বে সাধারণ জনগণ রাস্তায় বেরিকেড দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর আহ্বানে সাতক্ষীরা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সৈয়দ কামাল বখত সাকী এমএনএ সভাপতি এবং এ এফ এম এন্তাজউদ্দিন সাধারণ সম্পাদক। এর নেতৃস্থানীয় সদস্য ছিলেন- এডভোকেট মনসুর আলী, কাজী কামাল ছোট্টু, স ম কাজী আলাউদ্দিন, আজিবর রহমান চান্দু, আনিসুর রহিম, মোড়ল আবদুস সালাম খসরু, কিসমত হাসান, মোস্তাক আহমেদ রবি, দিদারুল ইসলাম, এনামুল হক, গোলাম সাবদার সিদ্দিকী, নাজমুল আবেদিন খোকন প্রমুখ। মার্চের শুরুতে পাইকগাছা- আশাশুনি নির্বাচনি এলাকা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ নেতা এম এ গফুর এমএনএ সাতক্ষীরায় চলে এলে সংগ্রাম পরিষদের পুরো নেতৃত্ব তিনি গ্রহণ করেন। ছাত্র-যুবক ও জনতা তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের শপথ নেয়।
এর কিছুদিন পরে সৈয়দ কামাল বখত সাকী ঢাকায় চলে যান। এর ফলে সংগ্রাম পরিষদের কর্মকাণ্ড কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আওয়ামী লীগ নেতা এ এফ এম এন্তাজ আলী, এডভোকেট মনসুর আলী, কাজী কামাল ছোট্ট, শেখ আবু নাসিম ময়না প্রমুখ পি এন স্কুলে এক বৈঠকে বসেন এবং পরিষদকে গতিশীল করার সিদ্ধান্ত নেন। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পর স ম কাজী আলাউদ্দিনকে সাতক্ষীরার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কোলকাতায় পাঠানো হয়। এদিকে সাতক্ষীরা মহকুমা সংগ্রাম পরিষদ নতুন করে গঠন করা হয়। এবারও সভাপতি হন সৈয়দ কামাল বখত সাকী এবং নতুন সাধারণ সম্পাদক হন এ এফ এম এন্তাজ আলী।
সাতক্ষীরা কলেজের বিএনসিসি ও রোভার স্কাউটের ডামি রাইফেল দিয়ে তৎকালীন জিন্নাহ পার্কে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এতে অনেকেই অংশ নেন, তবে নিয়মিত ছিলেন আকবর, নাছির উদ্দিন, কচি, গজনফর কবীর, আনিসুর রহমান খান বাবুল, আলী আশরাফ, কামরুল ইসলাম, শাহনেওয়াজ খোকা, খলিলুল্লাহ ঝড়ু, মাহবুবুর রহমান কন্ট্রাক্টর প্রমুখ। এরা পরবর্তীকালে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
এম এ গফুর এমএনএ ছাত্র, যুবক, রাজনৈতিক কর্মী সকলকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত করেন। এক পর্যায়ে তাঁরা উপলব্ধি করেন যে, সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য অস্ত্র আবশ্যক। তাই সাতক্ষীরা ট্রেজারি থেকে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য এম এ গফুর এমএনএ সুবেদার আয়ুবের মাধ্যমে সাতক্ষীরার এসডিপিও-র সঙ্গে আলাপ করেন। তখন খুলনা জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন এ আর খন্দকার। মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহে তাঁর সমর্থন ছিল। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেজারি থেকে ৩৫০টি ৩০৩ রাইফেল ও ৩০-৪০ বক্স গুলি সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে এ অস্ত্র ও গুলি গ্রহণ করেন মোস্তাফিজুর রহমান, কামরুল ইসলাম খান, মাসুদ, এনামুল, হাবলু, তিনু প্রমুখ।
আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতৃস্থানীয় কর্মী এবং তাদের সঙ্গে ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভোমরা, তকিপুর, হিঙ্গলগঞ্জ, শমশেরনগর ইত্যাদি অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প গড়ে ওঠে। গোটা সাতক্ষীরা এলাকায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাই যুদ্ধ করেন। স্থানীয় বাহিনী হিসেবে বিদ্রোহী ইপিআর বাহিনীর সদস্য, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য এবং সাতক্ষীরার স্কুল-কলেজের ছাত্ররা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে।
১৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী অতর্কিতে সাতক্ষীরা শহরে অনুপ্রবেশ করে এবং সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুল মাঠে ক্যাম্প স্থাপন করে। এর আগেই এখানে বহু শরণার্থী এসে আশ্রয় নিয়েছিল। পাকবাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করলে তারা ভীত হয়ে পড়ে এবং অন্যত্র চলে যেতে চায়। কিন্তু পাকবাহিনী বাধা দেয় এবং ২০শে এপ্রিল রাতে তারা শরণার্থীদের ওপর হামলে পড়ে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী এতে প্রায় সাড়ে চারশ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। এ ঘটনা সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুল গণহত্যা নামে পরিচিত। একই দিন তারা রেজিস্ট্রি অফিসের পেছনে ক্যাপ্টেন কাজী মশিউর রহমানের বাড়িতে জয় বাংলার পতাকা ওড়ানোর অযুহাতে তাকে ও তার শ্যালককে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা তার বাড়িসহ কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেয়।
মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ- ইত্যাদি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সাতক্ষীরায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। অবাঙালি মনু কসাই পাকবাহিনীর সহকারী হিসেবে কাজ করে এবং বহু নিরীহ বাঙালিকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে হত্যা করায়।
পাকবাহিনী ১৮ই এপ্রিল শহরের নিয়ন্ত্রণ নিলে স্থানীয় মুসলিম লীগপন্থী বাঙালি ও উর্দুভাষী বিহারিরা তাদের সহযোগী হিসেবে মাঠে নামে। মে মাসে জেলা শহর খুলনায় জামায়াত নেতা এ কে এম ইউসুফ ভুতের বাড়ি আনসার ক্যাম্পে রাজাকার বাহিনী গঠন করে। ১লা জুন জেনারেল টিক্কা খান ‘পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স-১৯৭১’ জারির মাধ্যমে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করে। জেলা শহরে রাজাকার বাহিনী গঠিত হওয়ার পর মহকুমা সদর সাতক্ষীরায়ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। পাকিস্তানপন্থী কিছু বাঙালি ও উর্দুভাষী বিহারিরা এ বাহিনীতে যোগ দেয়। বুধহাটার কুখ্যাত ইসহাক ছিল রাজাকার কমান্ডার। শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ডায়মন্ড হোটেল দখল করে সেখানে তারা তাদের সদর দপ্তর স্থাপন করে এবং হোটেলটিকে নির্যাতনকেন্দ্রে পরিণত করে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মুসলিম লীগের নেতারা শান্তি কমিটি গঠন করে স্বাধীনতাকামী সাতক্ষীরাবাসীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালায়।
সাতক্ষীরা শহরে রাজাকার ও পাকবাহিনী মিলিতভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর অত্যাচার চালায়। তারা তাদের ডায়মন্ড হোটেলে ধরে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করে। এতে অনেকে মারা যায় এবং জীবিতরা ঘরবাড়ি ফেলে ভারতে চলে যায়।
২৩শে এপ্রিল পাকবাহিনী ও রাজাকাররা পাটকেলঘাটা ও পুটিখালি এলায় এক গণহত্যা চালায়, যা পাটকেলঘাটা- পুটিখালি গণহত্যা নামে পরিচিত। এতে অনেক লোক নিহত হয়। ২১শে মে রাতে পাকহানাদার বাহিনী রামপাল, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া ও খুলনা এলাকা থেকে সাতক্ষীরার ঝাউডাঙ্গা বাজারে আগত শরণার্থীদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে। তাদের সঙ্গে উর্দুভাষী বিহারিরাও ছিল। এখানে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশত শরণার্থীকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা ঝাউডাঙ্গা বাজার গণহত্যা নামে পরিচিত। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গেরিলা দল সাতক্ষীরা পাওয়ার হাউসটি বোমা মেরে অচল করে দিলে পাকবাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে পাওয়ার হাউসের বাঙালি কর্মচারীদের নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করে।
সাতক্ষীরা শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্রগুলো হলো— ওয়াপদা রেস্ট হাউস, ডায়মন্ড হোটেল, ডাকবাংলো এবং পরিত্যক্ত ইপিআর ক্যাম্প। উর্দুভাষী বিহারিরা পূর্বশত্রুতার জের ধরে নিরীহ বাঙালিদের মুক্তিবাহিনীর সদস্য বলে হানাদারদের দেখিয়ে দিত। হানাদাররা তাদের ধরে এসব ক্যাম্পে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন চালাত। শহর থেকে ১৪ মাইল পশ্চিমে বৈকারী গ্রামে পাকবাহিনীর আরেকটি নির্যাতনকেন্দ্র ছিল। পাকবাহিনী ‘দুষ্কৃতিকারী’ খোঁজ করার নাম করে বিভিন্ন গ্রাম থেকে নিরীহ বাঙালিদের এখানে ধরে এনে নির্যাতন করাত। নির্যাতিতদের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠত। এছাড়া বিনেরপাতা ব্রিজ ও পাটকেলঘাটা ব্রিজের নিচে বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতন শেষে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো।
২০শে এপ্রিল রাতে সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুল গণহত্যায় শহীদদের লাশ হানাদাররা স্কুল কম্পাউন্ডে পুঁতে রাখে। তাই এ স্থানটি সাতক্ষীরা টাউন হাইস্কুল গণকবর নামে পরিচিত। স্বাধীনতার পর শিক্ষার্থীদের আতঙ্কের কারণে মিউনিসিপ্যালিটির তত্ত্বাবধানে কবর খুঁড়ে শহীদদের কঙ্কালগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে মাটিচাপা দেয়া হয়। বিনেরপোতা ব্রিজ ও পাটকেলঘাটা ব্রিজের নিচেও পাকবাহিনী নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করে অনেকের লাশ মাটিচাপা দেয়।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধারা উল্লেখযোগ্য একটি অপারেশন ও তিনটি যুদ্ধে অংশ নেন। সেগুলো হলো— সাতক্ষীরা ন্যাশনাল ব্যাংক অপারেশন, ভোমরা যুদ্ধ কদমতলা ব্রিজ যুদ্ধ ও সাতানী ভাদড়া হাইস্কুল যুদ্ধ। সাতক্ষীরা ন্যাশনাল ব্যাংক অপারেশন পরিচালিত হয় ১৯শে এপ্রিল। এতে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাংক থেকে ১,৭৫,০০,০০০.০০ (এক কোটি পঁচাত্তর লক্ষ) টাকা সংগ্রহ করেন এবং ২০শে এপ্রিল তা বাংলাদেশ সরকার-এর নামে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকে জমা হয়। ভোমরা যুদ্ধ সংঘটিত হয় দুবার ২৯শে এপ্রিল ও ২৯শে মে। প্রথমবারের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন সুবেদার আয়ুব এবং দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন সালাহ্উদ্দিন ও এসডিপিও মাহাবুব উদ্দিন আহমেদ। উভয় যুদ্ধে হানাদাররা পরাজিত হয় এবং তাদের বহু সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। কদমতলা ব্রিজ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২৭শে অক্টাবর ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে। চল্লিশজন মুক্তিযোদ্ধা এ-যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। সাতানী ভাদড়া হাইস্কুল যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৯ই নভেম্বর কমান্ডার জমাদার ওবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলা ভয়াবহ এ-যুদ্ধে জিনজির নামে পাকবাহিনীর এক অফিসার নিহত হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাকসেনারা গোটা এলাকা ঘিরে ফেলে। কিন্তু তার আগেই মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসী নিরাপদ দূরত্বে সরে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা গ্রামটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ৭ই ডিসেম্বর সাতক্ষীরা সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়৷
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- শামসুজ্জোহা খান কাজল, নাজমুল আবেদীন খোকন, সুবেদার আবদুল জব্বার, সিপাহী আবদুল মান্নান, সুবেদার শামসুল হক এবং আবুল কাসেম (মুজাহিদ সদস্য)। এঁদের মধ্যে প্রথম দুজন দেবহাটা উপজেলার টাউন শ্রীপুর যুদ্ধে এবং পরের চারজন ভোমরা যুদ্ধে শহীদ হন। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে শহীদ মুক্তিযুদ্ধাদের স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। [মিজানুর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড