সাচনা বাজার ক্যাম্প ও বাংকার অপারেশন (জামালগঞ্জ, সুনামগঞ্জ)
সাচনা বাজার ক্যাম্প ও বাংকার অপারেশন (জামালগঞ্জ, সুনামগঞ্জ) পরিচালিত হয় ২৯শে জুলাই সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলীর পরিকল্পনায়। সাচনা বাজার সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র। উপজেলার কেন্দ্রস্থল দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদীর এক পাড়ে উপজেলা সদর, অপর পাড়ে সাচনা বাজার। অত্র এলকার সমগ্র ভাটি অঞ্চলের সঙ্গে নৌপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এটি সংযোগস্থল। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় এর কৌশলগত গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
পাকবাহিনী সাচনায় প্রবেশ করে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে। এরপর তারা জামালগঞ্জ থানা সদর ও সাচনা বাজারে ১০টি বাংকার নির্মাণ করে। বাংকারের নিকটবর্তী স্থাপনায় পাঞ্জাবি আব্দুর গফুর ওরফে লাল বান্দর এবং আব্দুর রেজ্জাক ওরফে কিলার গুল মুহাম্মদের নেতৃত্বে দু-শতাধিক রাজাকার মোতায়েন ছিল। তাদের হাত থেকে জামালগঞ্জকে মুক্ত করার জন্য ৫নং সেক্টরের কমান্ডার মীর শওকত আলী অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। এ লক্ষ্যে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে একটি দুর্ধর্ষ বাহিনী গঠন করা হয়। মুক্তিসেনারা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে ৬টি নৌকায় অবস্থান নেন। প্রতিটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন একজন কমান্ডার ও একজন সহকারী কমান্ডার। প্রথম দলের কমান্ডার ও সহকারী কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে ইপিআর আবদুল হাই ও আতাউর রহমান। এঁদের পরিকল্পনা ছিল উত্তরপাশ দিয়ে সাচনা বাজার আক্রমণ করা। দ্বিতীয় দলের কমান্ডার ছিলেন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস, বীর বিক্রম। তাঁর সহকারী ছিলেন আলী আমজাদ বড়ভাই। এ-দলের দায়িত্ব ছিল জামালগঞ্জের সিও অফিস ও হাইস্কুলের পেছন দিক থেকে শত্রুর ওপর আক্রমণ করা। তৃতীয় দলের কমান্ডার ছিলেন মোজাহিদ মিয়া এবং তাঁর সহকারী ছিলেন ইব্রাহিম খলিল। এঁদের ওপর দায়িত্ব ছিল তেলিয়া-শাহপুরের দিক থেকে জামালগঞ্জে অবস্থানরত পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ করা এবং সুরমা নদী দিয়ে আগত পাকবাহিনীর যাতায়াত প্রতিহত করা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের ৬টি নৌকা গোলাবারুদ ও অস্ত্র নিয়ে ২৯শে জুলাই বিকেলে টেকেরঘাট থেকে সাচনার উদ্দেশে রওনা হয়। সাচনা বাজারে পৌঁছার পর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সেরে প্রথম দল বাজারে অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করে। প্রচণ্ড আক্রমণের শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সাচনা বাজার ও আশপাশের এলাকা। পাকসেনারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং সারারাত ধরে তা চলে। সাচনা বাজার গরুহাটার বাংকার থেকে পাকসেনাদের নিক্ষিপ্ত বুলেটে শহীদ হন কিশোরগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম, বীর বিক্রম। অপরদিকে, জগৎজ্যোতি দাসের দলের প্রচণ্ড আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পাকসেনারা জামালগঞ্জ বাংকার থেকে পলায়ন করে। দক্ষিণ দিক থেকে নদীপথে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করে মোজাহিদ বাহিনী। এতে পাকসেনারা দিশেহারা হয়ে সুরমা নদী দিয়ে দুর্লভপুরের দিকে পালিয়ে যায়। সফল এ অপারেশনে সাচনা বাজারকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করে সহমুক্তিযোদ্ধারা মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামের লাশ নিয়ে টেকেরঘাটে চলে যান।
সাচনা বাজারসহ হাওর এলাকার বিভিন্ন অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার উৎস ছিলেন শহীদ সিরাজুল ইসলাম, বীর বিক্রম এবং মৃত্যুর পূর্বে পিতাকে লেখা সিরাজুল ইসলামের চিঠি (৩০শে জুলাই ১৯৭১)। চিঠিতে তিনি মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার কথা লিখেছিলেন। এ চিঠি পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল বৃদ্ধি পেত। সাচনা বাজার অপারেশনের সময়ও মুক্তিযোদ্ধাদের এ চিঠি পড়ে শোনানো হয়। স্বাধীনতার পর সিরাজুল ইসলামের রক্তরঞ্জিত স্থানে জামালগঞ্জের একমাত্র শহীদ মিনারটি নির্মিত হয়। তাঁর নামে কালীগঞ্জ বাজারের নামকরণ করা হয় ‘সিরাজনগর’। কিন্তু ‘৭৫-পরবর্তী পরিস্থিতিতে পুনরায় এ বাজারের নাম রাখা হয় ‘সাচনা বাজার’। [আকবর হোসেন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড