You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.03 | সাটিয়াচড়া-গোড়ান গণহত্যা (মির্জাপুর, টাঙ্গাইল) - সংগ্রামের নোটবুক

সাটিয়াচড়া-গোড়ান গণহত্যা (মির্জাপুর, টাঙ্গাইল)

সাটিয়াচড়া-গোড়ান গণহত্যা (মির্জাপুর, টাঙ্গাইল) সংঘটিত হয় ৩রা এপ্রিল। টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে পাকুল্লা বাসস্ট্যান্ড থেকে দুশগজ দূরে ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের দুপাশে সাটিয়াচড়া গ্রাম অবস্থিত। এর উত্তর-পূর্ব পাশের গ্রাম গোড়ান। দুটি গ্রামই মির্জাপুর উপজেলার অন্তর্গত। ৩রা এপ্রিল সাটিয়াচড়ায় পাকবাহিনী ও ইপিআর যোদ্ধাদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। উভয় পক্ষে প্রায় সাত ঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পর ইপিআর যোদ্ধারা পিছু হটলে পাক হানাদাররা সাটিয়াচড়া-গোড়ান গ্রামে প্রবেশ করে বর্বরোচিত গণহত্যা চালায়। সাটিয়াচড়া গ্রামে গণহত্যার শিকার হন জাহাঙ্গীর হোসেন মানিক, লেবু শিকদার, জিয়াউর রহমান দুলাল, সুফিয়া বেগম (লাল বানু), নূর বখশ, শামসুল আলম (দুদু মিঞা), জয়গুন নেসা, আবু রায়হান, হাবিবুর রহমান (মধু মিঞা), ইবরাহীম মিঞা, আবদুল হক, নাছিরন বেগম, নূরজাহান বেগম, মৌলভী আবদুল হাকিম, সৈয়দ নূরুর রহমান, রংপুরের সেনপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান চৌধুরী (ভিখু), মিলি রহমান এবং অজ্ঞাতনামা একজন ড্রাইভার। গোড়ান গ্রামে নিহত হন জিলুর রহমান (টেনু মিঞা), মেহেরুন নেসা, নূরজাহান বেগম, পুলক, জাহাঙ্গীর হোসেন, নূরুল ইসলাম (লেবু মিঞা), শামসুল আলম, মজিবর রহমান, আবুল হোসেন মাস্টার, মজিরন বেগম, আমেনা বেগম, কোহিনূর খাতুন, আজমত আলী, আবুল কাশেম (হাসি মিঞা), নূর উদ্দিন, পান্না শিকদার, কছিরন বেগম, তোফাজ্জল হোসেন, কাজিম উদ্দিন কেরানি, আফজাল হোসেন (চেনু মিঞা), আবদুল মান্নান, দারোগ আলী, শরীফ উদ্দিন, নাজমুল আলম, মুনতানজিদুল হক শাহীন এবং পাকুল্লা গ্রামের বশির হোসেন চৌধুরী (সেলিম চৌধুরী) ও সৌরভ মিঞা। ঐদিন হানাদারদের গুলিতে = আহত হয়ে সাটিয়াচড়ার ইনতাজ আলী, শাহ আলম, ফুলমতি বেগম এবং গোড়ানের দুলাল ও হালিমন বেগম কয়েকদিন পরে মৃত্যুবরণ করেন। [শফিউদ্দিন তালুকদার] সাটিয়াচড়া-গোড়ান প্রতিরোধযুদ্ধ (মির্জাপুর, টাঙ্গাইল) সংঘটিত হয় ৩রা এপ্রিল। টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং মির্জাপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে পাকুল্লা বাসস্ট্যান্ড থেকে দুশগজ দূরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের দুপাশে সাটিয়াচড়া গ্রাম অবস্থিত। এর উত্তর-পূর্ব পাশের গ্রামটির নাম গোড়ান। দুটি গ্রামই মির্জাপুর উপজেলার অন্তর্গত। এখানেই পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধটি হয়। টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদের অনুরোধে ৩১শে মার্চ ময়মনসিংহ থেকে আগত শতাধিক ইপিআর সদস্যও এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন।
২৬শে মার্চের পর থেকেই জুমারত আলী দেওয়ানের নেতৃত্বে সাটিয়াচড়া-গোড়ানের ছাত্র-যুবকরা দেওয়ান জয়নাল আবেদিন (শামসুল), এখলাস উদ্দিন (তারা খলিফা), এস এম আমান উল্লাহ (শুকুর), হাবিবুর রহমান (মধু), সাদেক হোসেন তালুকদার, আবদুল হামিদ চৌধুরী, চাঁন মিঞা প্রমুখের লাইসেন্সধারী বন্দুক সংগ্রহ করে রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আগমন প্রতিহত করার জন্য রাস্তা পাহারা দিত। সাটিয়াচড়া-গোড়ান থেকে মির্জাপুরের গোড়াই পর্যন্ত ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের বিভিন্ন স্থানে গাছ ফেলে এবং অনেক স্থানে সড়কের মাটি সরিয়ে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়। ১লা এপ্রিল বিকেল ৪টার দিকে ইপিআর সদস্যরা সাটিয়াচড়ায় ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের দুপাশে অবস্থান নেয়। তারা সড়কের দুপাশে বাংকার খুঁড়ে হানাদারদের আগমন প্রতিহত করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। সাটিয়াচড়ার জুমারত আলী দেওয়ান, জাহাঙ্গীর হোসেন মানিক, গোড়ানের নূর উদ্দিন, হাসি মিঞাসহ ত্রিশ-চল্লিশজন ছাত্র-যুবক এবং টাঙ্গাইল জেলা হাই কমান্ডের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে বদিউজ্জামান খান, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, খন্দকার আসাদুজ্জামান, ফজলুর রহমান খান ফারুক প্রমুখ ইপিআর বাহিনীর এ প্রতিরোধ অভিযানে সর্বাত্মক সহযোগিতা দান করেন।
৩রা এপ্রিল ইপিআর বাহিনীর সৈন্যরা পাঁচটি ট্রেঞ্চ কেটে তার মধ্যে পজিশন নেয়। সড়কের দুপাশে ঝোপঝাড়ের আড়ালে রাইফেলধারী ছাত্র ও যুবকরা পজিশন নেয়। কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম এর নেতৃত্বে তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে নাটিয়াপাড়া নামক স্থানে অবস্থান নেন। এদিন ভোরে পাকবাহিনীর একটি শক্তিশালী দল ঢাকা থেকে এসে সাটিয়াচড়া অতিক্রম করার সময় ইপিআর যোদ্ধারা তাদের কনভয় আক্রমণ করে। পাকসেনারাও পাল্টা আক্রমণ চালায়। প্রায় সাত ঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পর ইপিআর যোদ্ধারা টিকতে না পেরে পিছু হটে। সেদিনের যুদ্ধে ফরিদপুরের ইপিআর সদস্য আবদুল গফুর, বগুড়ার ইপিআর আবদুল আজিজ, হাবিলদার আবদুল খালেক, সাটিয়াচড়ার ছাত্রনেতা জুমারত আলী দেওয়ানসহ ৩৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। ইপিআর যোদ্ধারা পিছু হটলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সাটিয়াচড়া-গোড়ান গ্রামে প্রবেশ করে বর্বরোচিত গণহত্যা চালায়। প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধ স্থল সাটিয়াচড়া-গোড়ানে একটি স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া সাটিয়াচড়ায় শহীদ জুমারত আলী দেওয়ানের সমাধি রয়েছে। [শফিউদ্দিন তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড