You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাটুরিয়া থানা যুদ্ধ (মানিকগঞ্জ)

সাটুরিয়া থানা যুদ্ধ (মানিকগঞ্জ) সংঘটিত হয় দুবার ১৪ই আগস্ট ও ২১শে নভেম্বর। ১৪ই আগস্ট ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। এ উপলক্ষে মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া সেনাক্যাম্প থেকে পূর্বেই মাইকিং করে সাটুরিয়ায় নৌকাবাইচসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হয়। এ বিষয়টি বাতেন বাহিনীর গোচরে এলে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন ঐদিনই সাটুরিয়া থানা আক্রমণ করবেন। এ উদ্দেশ্যে বাতেন বাহিনীর প্রধান খন্দকার আব্দুল বাতেন – ১১ই আগস্ট নাগরপুরের পাকুটিয়ায় আসেন এবং পাকসেনাদের অবস্থান জানার জন্য ইয়াকুব আলী নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে তরকারিওয়ালা সাজিয়ে সাটুরিয়ায় পাঠান। ১২ই আগস্ট দেলোয়ার হোসেন হারিজ নামে অপর একজন মুক্তিযোদ্ধা সাটুরিয়ায় আসেন এবং পাকসেনাদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওয়্যারলেস অফিসে অপারেটর আব্দুল হাকিম খান (কহেলা, টাঙ্গাইল) ও সাটুরিয়া থানার পুলিশ কনস্টেবল মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৪ই আগস্ট সন্ধ্যার পর বাতেন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকুটিয়া কলেজ এবং এর আশপাশে জড়ো হতে থাকেন। সেখান থেকে তাঁরা নৌকায় করে বালিয়াটি হয়ে পূর্ব কুষ্টিয়া গ্রামে নৌকা ভিড়িয়ে পায়ে হেঁটে এগিয়ে গিয়ে তিন দিক থেকে সাটুরিয়া থানা ঘিরে ফেলেন। এরপর ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি দিয়ে আব্দুল বাতেন একটি চাইনিজ স্টেনগান থেকে প্রথম গুলি করেন। বাতেন বাহিনীর তিনটি কোম্পানি (৭, ১১, ১৭) এ-যুদ্ধে অংশ নেয়। কাভারিং কোম্পানির দায়িত্বে ছিলেন অসীম সাহসী যোদ্ধা মীর কায়সার। এ-যুদ্ধে সাটুরিয়া থানার পতন হয়। মুক্তিযোদ্ধারা থানা থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন। সেগুলোসহ কয়েকজন বন্দিকে নিয়ে তাঁরা বালিয়াটি আসেন। যুদ্ধে মোহাম্মদ আলী নামে একজন পুলিশ কনস্টেবল নিহত হয়।
১৪ই আগস্টের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা সাটুরিয়া থানা দখল করলেও এর কিছুদিন পরে পাকসেনারা তা পুনর্দখল করে নেয়। তাই থানাকে হানাদারমুক্ত করার জন্য বাতেন বাহিনী ২০শে নভেম্বর মানিকগঞ্জের দৌলতপুর থানার কলিয়া প্রাইমারি স্কুলসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেয়। এদিন বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সেখানে পৌঁছান বাতেন বাহিনীর মানিকগঞ্জের সিকিউরিটি প্রধান কমর উদ্দিন আহমেদ। তিনি জানান, পাকসেনারা ২১শে নভেম্বর সাটুরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যার পরিকল্পনা নিয়েছে। বাতেন বাহিনীর প্রধান খন্দকার আব্দুল বাতেন তখন বাহিনীর প্রয়োজনে ভারতে। তাই এ বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আকবর খান ডলার, দেলোয়ার হোসেন হারিজ, সুবেদার মেজর আবু তাহের, মীর শামছুল আলম শাহজাদা ও খন্দকার আব্দুস সালাম তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেন ২১শে নভেম্বরই সাটুরিয়া থানা আক্রমণ করা হবে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা ২০শে নভেম্বর সন্ধ্যায় কলিয়া থেকে সাটুরিয়ার দিকে অগ্রসর হন। রাত সাড়ে আটটার দিকে তাঁরা ঘিওর কুড়িকাহুনিয়ায় একদল পাকসেনার মুখোমুখি হন। সেখানে তাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ শুরু হয়। পরদিন সকাল আটটা পর্যন্ত এ-যুদ্ধ চলে। পাকিস্তানি আর্টিলারি বাহিনী গোলড়ায় অবস্থান নিয়ে সাটুরিয়ার দিকে শেলিং করতে থাকে এবং পদাতিক বাহিনীর অতিরিক্ত সৈন্যরা বেলা ১২টার দিকে সাটুরিয়া আসে। মুক্তিযোদ্ধারা তখন ডিফেন্স প্রত্যাহার করে দুপুরের আহার গ্রহণ করেন। বাতেন বাহিনীর কমান্ডাররা সিদ্ধান্ত নেন যে, বড় ধরনের রক্তপাত না ঘটিয়ে পাকিস্তান আর্মি যদি এমনিতেই সাটুরিয়া ত্যাগ করে, তাহলে সকলের জন্যই মঙ্গল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে দক্ষিণ দিক ছাড়া অপর তিন দিকে অবস্থান নেন।
দুপুর দুটার দিকে পাকসেনারা সাটুরিয়া থেকে গোলড়া হয়ে ঢাকা চলে যায়। এরপর সাটুরিয়ার সর্বস্তরের জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলে সাটুরিয়া পাইলট হাইস্কুল মাঠে বিজয়োল্লাসে মেতে ওঠে। শত্রুমুক্ত সাটুরিয়ায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেন কমান্ডার আলী আকবর খান ডলার। তিনি এ-যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জিয়ারত আলী (শশিনারা, মির্জাপুর, টাঙ্গাইল)-র নামে সাটুরিয়ার নতুন নামকরণ করেন জিয়ারত নগর। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নতুন এ নামকরণ মুছে যায়। [সমরেন্দু সাহা লাহোর]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!