সাতই মার্চের ভাষণ
সাতই মার্চের ভাষণ ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাঙালির অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- কর্তৃক জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণ। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ পাকিস্তানের শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের পতনের পর নতুন সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে নিয়ে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে সাধারণ নির্বাচন দেন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ- ৬-দফার ভিত্তিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এরূপ ফলাফলের জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না। তাদের শঙ্কা হয়, ৬-দফার ভিত্তিতে দেশে নতুন শাসনতন্ত্র রচিত হলে পূর্ব পাকিস্তান কার্যত আলাদা হয়ে যাবে। তাছাড়া, বাঙালিরা পাকিস্তানের শাসক হোক এটা তারা কখনো চায়নি। তাই তারা গভীর ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এ ষড়যন্ত্রে যোগ দেন। এ ষড়যন্ত্রেরই অংশ হিসেবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১লা মার্চ একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে ২রা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ও সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন- শুরু হয়, যা ২৫শে মার্চ রাতে পাকসেনাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এ আন্দোলনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সবকিছু অচল হয়ে যায়। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে সংগ্রামী ছাত্রসমাজ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। ৩রা মার্চ তাদের উদ্যোগে পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। এদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী প্রতিদিন নির্বিচারে গুলি চালিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র জনগণকে হতাহত করে চলে। এর প্রতিবাদে রাস্তায়-রাস্তায় গড়ে ওঠে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ। দেশবাসী বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বড় ধরনের কোনো রাজনৈতিক ঘোষণার অপেক্ষায় থাকে। এমনি এক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে ৭ই মার্চের ভাষণের ঘোষণা আসে। ভাষণে বঙ্গবন্ধু কী বলবেন সে ব্যাপারে ইতঃপূর্বে নানাজন লিখিত-অলিখিত নানা পরামর্শ দেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একটানা ৩৬ ঘণ্টা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌছাতে না পারায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যা বলা আবশ্যক তা-ই বলবেন- এ কথা বলে বঙ্গবন্ধু নিজের ওপর সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে নেন। অতঃপর ৭ই মার্চ অপরাহ্নে তিনি রেসকোর্স ময়দানের উত্তাল জনসমুদ্রের সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন এবং মাত্র ১৮ মিনিটের এক ভাষণ দেন। তাঁর পূর্ণ ভাষণটি এরূপ:
ভায়েরা আমার,
আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।
কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এ দেশকে আমরা গড়ে তুলব। এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস – বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস, মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস, এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।
১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে দশ বৎসর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফার আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, ‘দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন’, আমরা মেনে নিলাম।
তার পরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলা নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাঁকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে, মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসব। আমি বললাম, অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব, এমনকি আমি এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন, বলে গেলেন যে আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরও আলোচনা হবে। তার পরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করলাম। আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে অ্যাসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হবে। যদি কেউ অ্যাসেম্বলিতে আসে, তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, অ্যাসেম্বলি চলবে। তার পরে হঠাৎ ১ তারিখে অ্যাসেম্বলি বন্ধ করে দেয়া হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসাবে অ্যাসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে আমি যাব। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না।
৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তার পরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেওয়ার পরে এ দেশের
মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল। আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কল-কারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন; জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।
কী পেলাম আমরা? যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য; আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে। তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু, আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম, জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট; দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপরে গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। উনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি যে, ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি তো অনেক আগেই বলেছি, কিসের আরটিসি? কার সঙ্গে বসব? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসব? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে, পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন। বাংলার মানুষের উপরে দিয়েছেন।
ভায়েরা আমার,
পঁচিশ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি যে, ঐ শহীদের রক্তের উপর দিয়ে পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে প্রথম। সামরিক আইন মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তার পরে বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কী পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। আমি, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশের কোর্ট- কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেই জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেইগুলোর হরতাল, কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাই . কোর্ট, জজ কোর্ট, সেমি-গভার্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা, কোনো কিছু চলবে না।
২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের উপর হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর/কাছে আমার অনুরোধ রইল; প্রত্যেক ঘরে-ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু – আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি – তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব। আমরা পানিতে মারব। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপরে গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না। আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব। যারা পারেন, আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌছাইয়া দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো। কেউ দেবে না।
শোনেন, মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে। নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে, তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোনো বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না।
দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নেবার পারে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন-টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এদেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা-আল্লাহ।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
জয় বাংলা!
বঙ্গবন্ধু তাঁর সংক্ষিপ্ত এ ভাষণে পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস ও বাঙালিদের অবস্থা, পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালি-অবাঙালি দ্বন্দ্বের স্বরূপ, অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি ও কর্মসূচি, সমগ্র বাংলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা, অবশেষে, প্রতিরোধ সংগ্রামের মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়ার ইঙ্গিত, শত্রুর মোকাবেলায় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন, যে- কোনো প্ররোচনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করার পর ঘোষণা করেন: ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে … এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে কেন্দ্র করে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মহলের ধারণা ছিল, তিনি হয়তো একতরফাভাবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। বিদেশী পত্র-পত্রিকায় এ-মর্মে খবরও প্রকাশিত হয়। এমনি অবস্থায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নতুন কৌশল অবলম্বন করে। ভাষণের একদিন পূর্বে অর্থাৎ ৬ই মার্চ রাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত এক বেতার ভাষণে স্থগিত ঘোষিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ২৫শে মার্চ আহ্বানের ঘোষণা দেন। পাশাপাশি দেশের অখণ্ডত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে যে- কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে তার সরকারের দৃঢ় সংকল্পের কথা ব্যক্ত করে সকলকে সতর্ক করে দেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতারই ঘোষণা। তবে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে কিংবা বহির্বিশ্বে যাতে চিহ্নিত না হন, সে ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক। তা না হলে, স্নায়ুযুদ্ধ চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনই হয়তো অসম্ভব হয়ে পড়ত। তাই তিনি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। বিশেষকরে ভাষণের শেষদিকে তিনি স্বাধীনতার কথা এমনভাবে উচ্চারণ করেন যাতে ঘোষণার কিছু বাকিও থাকেনি, আবার তাঁর বিরুদ্ধে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার অভিযোগ উত্থাপন করাও শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধুর এরূপ কৌশলী অবস্থান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত ও কূটনৈতিক সমর্থন লাভে সহায়ক হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচিত। অনেকে এটিকে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ১৮৬৩ সালের বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতার সঙ্গে তুলনা করেন। এটি যেমন সারগর্ভ, ওজস্বী ও যুক্তিপূর্ণ, তেমনি তির্যক, তীক্ষ্ণ ও দিক-নির্দেশনামূলক। অপূর্ব এর উপস্থাপনা। এটি একান্তই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোনাল্ড রিগান পর্যন্ত ২৫০০ বছরের বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে অধিক প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন সামরিক-বেসামরিক জাতীয় বীরের বিখ্যাত ভাষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Jacob F Field We Shall Fight on The Beaches: The Speeches That Inspired History শিরোনামে সম্প্রতি একখানা গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এতে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, জুলিয়াস সিজার, অলিভার ক্রমওয়েল, জর্জ ওয়াশিংটন, নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, যোসেফ গ্যরিবোল্ডি, আব্রাহাম লিংকন, ভ্লাদিমির লেনিন, উইড্রো উইলসন, উনস্টন চার্চিল, ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, চার্লস দ্য গল, মাওসেতুং, হো চি মিন প্রমুখের ভাষণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
যে-সব কারণে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণের মর্যাদায় অভিষিক্ত, সেগুলো হলো: এক. যে- কোনো শ্রেষ্ঠ ভাষণের মতোই এটি প্রচণ্ড উদ্দীপনীয় (Inspiring); মুহূর্তে মানুষকে নব চেতনায় জাগিয়ে তুলে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত করতে পারঙ্গম। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ সমগ্র জাতির পাশাপাশি রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে। দুই. শ্রেষ্ঠ ভাষণের অনুরূপ ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য ও তা অর্জনে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা অভিব্যক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি তথা স্বাধীনতা – ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ শুধু লক্ষ্য ঘোষণা করেই বঙ্গবন্ধু নিবৃত্ত থাকেননি, তা অর্জনে আসন্ন যুদ্ধের, বিশেষকরে গেরিলা যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণে বাঙালিদের দিকনির্দেশনাও দান করেন – ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু – আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি
তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ তিন. শ্রেষ্ঠ ভাষণের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সময়ের পরিসীমায় গণ্ডিবদ্ধ না থেকে তা হয়ে ওঠে কালোত্তীর্ণ ও অনন্ত প্রেরণাদায়ী। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না।’ এ ভাষণ কখনো পুরানো হওয়ার নয়; চার দশকের অধিক সময় পরেও মনে হয় এই প্রথমবারের মতো শোনা হলো। চার ইতিহাসখ্যাত শ্রেষ্ঠ ভাষণের মতো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর কাব্যিকতা। এর শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাস অসাধারণ। এ-কারণে বঙ্গবন্ধু আখ্যাত হয়েছেন ‘Poet of Politics’ নামে (Newsweek)। পাঁচ. যে-কোনো শ্রেষ্ঠ ভাষণই যেমন বিদ্যমান পরিস্থিতি- উত্থিত এবং সে-কারণে তাৎক্ষণিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও হৃদয়- উৎসারিত, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিও ঠিক তাই – অলিখিত এবং কোনোরূপ প্রস্তুতিহীন। ছয়. শ্রেষ্ঠ ভাষণের অপর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নাতিদীর্ঘতা। আব্রাহাম লিংকনের Gettysburg Address-এর শব্দসংখ্যা ২৭২, সময় ৩ মিনিটেরও কম। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের সময় ১৮ মিনিট, শব্দ ১১০৫ (এক হাজার একশ পাঁচ)। মার্টিন লুথার কিং-এর ‘I have a dream’ Address-এর সময় ১৭ মিনিট, শব্দ ১৬৬৭। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ উপনিবেশবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, জাতি-নিপীড়ন ইত্যাদি থেকে পৃথিবীর সর্বত্র জাতি- জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি গৃহীত ও স্বীকৃত জাতিসংঘের ‘বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণাপত্র’ (Universal Declaration of Human Rights, 10 December 1948)- এর সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। বাঙালির জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে তিনি দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম করেন। এক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি সর্বদিক বিবেচনায় রেখে অত্যন্ত ধীর-স্থির অথচ তেজোদীপ্ত কণ্ঠে এমনিভাবে ভাষণ রাখলেন, যার নজির ইতিহাসে বিরল। ভাষণে একদিকে যেমন ছিল শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান, অপরদিকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ ও সম্প্রীতি, দায়িত্ববোধ ইত্যাদি ছিল দৃষ্টি কাড়ার মতো। বস্তুত তাঁর ভাষণে একটি জাতি- রাষ্ট্রের (বাংলাদেশ) সৃষ্টি, তাও মাত্র ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, যা বিশ্ব-ইতিহাসে নজিরবিহীন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ জাতি-নিপীড়নের কবল থেকে মানবতার মুক্তির সংগ্রামে যুগে-যুগে, দেশে-দেশে মানব জাতিকে পথ দেখাবে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ ভাষণ থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। এসব বিবেচনা করে জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য-সম্পদ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তা সংস্থাটির ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে।
৭ই মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধুর অমর রচনা, বাঙালির মহাকাব্য। এ মহাকাব্য বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামের ধারা ও স্বাধীনতার লালিত স্বপ্ন থেকে রচিত। এমমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই এ মহাকাব্য রচনা করা সম্ভব ছিল, কেননা তিনিই এ ধারার সার্থক প্রবর্তক ও প্রতিনিধি। [হারুন-অর-রশিদ]
সহায়ক গ্রন্থ: হারুন-অর-রশিদ, ৭ই মার্চের ভাষণ কেন বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ : বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ, ঢাকা, অন্যপ্রকাশ ২০১৮; আবদুল ওয়াহাব (সম্পাদিত), বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইতিহাস ও তত্ত্ব, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা ২০১৪; শেখ হাসিনা, ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ : কিছু স্মৃতি’, আবদুল ওয়াহাব (সম্পাদিত), বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইতিহাস ও তত্ত্ব; Jacob F Field, We Shall Fight on The Beaches : The Speeches That Inspired History, London, Michael O’ Mara Books Limited 2013
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড