You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং

সাইমন ড্রিং (জন্ম ১৯৪৫) ব্রিটিশ সাংবাদিক, টেলিভিশন উপস্থাপক ও পরিচালক এবং ২৫শে মার্চ বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী বিদেশী সংবাদদাতা। ১৯৪৫ সালের ১১ই জানুয়ারি ইংল্যান্ডে তাঁর জন্ম। তাঁর পুরো নাম সাইমন জন ড্রিং। তিনি ইংল্যান্ডের কিংস লাইন টেকনিক্যাল কলেজে লেখাপড়া করেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি গৃহ ত্যাগ করেন। গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে প্রথম চাকরিলাভ ১৯৬৩ সালে। তখন থেকে মিডিয়া জগতে তাঁর এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের শুরু। তিনি লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ, ডেইলি মেইল, দ্য সানডে টাইমস, নিউজউইক, বিবিসি টেলিভিশন রেডিও নিউজ, রয়টার প্রভৃতি গণমাধ্যমে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে চালুকৃত প্রথম বেসরকারি চ্যানেল একুশে টেলিভিশন-এর তিনি যুগ্ম ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। সাংবাদিক জীবনে তিনি ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের সংঘাত-সংঘর্ষ, যুদ্ধবিগ্রহ ও অন্যান্য বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন রচনা করেন। এর স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি একাধিক সম্মাননা ও এওয়ার্ড লাভ করেন। এর মধ্যে ইউকে রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার, ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার এবং এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এওয়ার্ড উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সাইমন ড্রিং-এর নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে যুদ্ধের পূর্বেই তাঁর ঢাকায় আগমন। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর বাংলাদেশের দক্ষিণে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বিশ্ব গণমাধ্যমের নজর কাড়ে। তাতে কমপক্ষে অর্ধমিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারায়, ব্যাপক ধ্বংসলীলা সংঘটিত হয়। একই বছর ছিল পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে মুখোমুখি অবস্থানের এক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে ঐ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে ছয়দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ-এর বিজয় বনাম ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার অবস্থান পাকিস্তানের সংকটকে ঘনীভূত করে। উল্লিখিত এসব কারণে ঢাকায় তখন বিশ্বের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম ও সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধিবর্গ বেশ কিছুদিন ধরে অবস্থান করছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ১লা মার্চ স্থগিত ঘোষণা, প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর পূর্ব বাংলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক, ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার লক্ষ্যে বাঙালিদের ‘ঘরে ঘরে দুর্গ’ গড়ে তোলা এবং ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’ করার প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান, ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট নামে বাঙালিদের ওপরে সশস্ত্র আক্রমণ ও গণহত্যা, ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার বরণের পূর্বে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ইত্যাদি পটভূমিতে শুরু হয় ৯ মাসব্যাপী বাঙালিদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, যাতে ৩০ লক্ষ বাঙালিকে জীবনদান ও কয়েক লক্ষ মা-বোনকে সম্ভ্রম বিসর্জন দিতে হয়।
২৫শে মার্চ রাতে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পূর্বে শাহবাগস্থ তখনকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ২শর মতো বিদেশী সাংবাদিককে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কঠোর প্রহরায় বিশেষ কক্ষে আবদ্ধ করে রাখে। তাঁদের মধ্যে লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার প্রতিনিধি সাইমন ড্রিংও ছিলেন। সকলকে পরের দিন প্লেনে তুলে পাকিস্তানের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হলেও সাইমন ড্রিং ও এসোসিয়েটেড প্রেসের ফটোগ্রাফার মাইকেল লরেন্ট হোটেল লবি, কিচেন ও সর্বশেষে ছাদে লুকিয়ে থেকে নিজেদের সাময়িকভাবে রক্ষা করতে সক্ষম হন। ২৭শে মার্চ কিছু সময়ের জন্য কারফিউ তুলে নেয়া হলে তাঁরা দুজন ঢাকা শহরে বেড়িয়ে পড়েন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমান জহুরুল হক হল), জগন্নাথ হল, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধুর ৩২নং ধানমন্ডির বাস ভবন, রেসকোর্সের কালীবাড়ি মন্দির, পুরনো ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাসহ ২৫শে মার্চ রাত থেকে শুরু করে পাকহানাদারদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত ঢাকা নগরীর বিভিন্ন স্থান সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে সাইমন ড্রিং একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন, যা ৩০শে মার্চ লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ‘Tanks Crush Revolt in Pakistan 7,000 slaughtered : Homes burned’ শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠায় তিন কলামে সাইমন ড্রিং (তখন বয়স ২৭)-এর ছবিসহ সবিস্তার ছাপা হয়। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২৫শে মার্চের হত্যাকাণ্ডের কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বিদেশী সাংবাদিকের এটিই ছিল প্রথম প্রতিবেদন। এটি প্রকাশিত হওয়ার পর ঢাকায় সে রাতে ও পরবর্তী দুদিন পাকবাহিনী কী নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল, সে সম্বন্ধে বিশ্ববাসী জানতে পারে।
২৮শে মার্চ পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ সাইমন ড্রিং ও মাইকেল লরেন্টকে প্লেনে তুলে থাইল্যান্ড পাঠিয়ে দেয়। তাঁদের নিরাপত্তা তল্লাশির সময় লরেন্টের কাছ থেকে ছবির ফিল্মসহ অন্যান্য তথ্য নিয়ে যাওয়া হলেও সাইমন ড্রিং তাঁর সঙ্গে থাকা নোট সুকৌশলে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। এরপর থাইল্যান্ডে পৌঁছে সেখান থেকে তাঁর প্রতিবেদন ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রেরণ করেন। প্রতিবেদনে ইকবাল হলে কয়েকশ ছাত্রের রক্তাক্ত লাশ, জগন্নাথ হলের ছাত্র ও আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদের হত্যা করে গণকবরে মাটিচাপা দিয়ে বুলডোজার চালানো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ জন শিক্ষককে হত্যা, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ ও তাঁকে গ্রেপ্তার, রেসকোর্সের কালীমন্দির ও পুরান ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা, ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে তা ভস্মীভূত করা ও বুলডোজার চালিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের অধিকাংশ পুলিশ সদস্যকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা, বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের একনিষ্ঠ সমর্থক জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক ইত্তেফাক ও ইংরেজি People পত্রিকা অফিসে আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগ করে তা ভষ্মীভূত করা, ভীত-সন্ত্রস্ত হাজার-হাজার নগরবাসীর ঢাকা শহর ত্যাগ ইত্যাদি ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা তাতে স্থান পায়।
২৫শে মার্চ রাতে বাঙালিদের ওপর পাকহানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ ও গণহত্যার সবিস্তার বিবরণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিক সাইমন ড্রিং বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে অসামান্য অবদান রেখেছেন এবং যুদ্ধের নয় মাস বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহানুভূতি-সমর্থন লাভে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন, তার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০১২ সালে তাঁকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’য় ভূষিত করা হয়। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, ২৭শে মার্চ ২০১২; The Daily Telegraph, 30 March 1971, p. 1

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড