You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে সাঁথিয়া উপজেলা (পাবনা)

সাঁথিয়া উপজেলা (পাবনা) ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান- ও তা থেকে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার বাঙালিদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে নিয়ে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের মতো এ নির্বাচনেও বাঙালিরা সর্বোচ্চ দেশাত্মবোধের পরিচয় দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ- নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ইয়াহিয়া খান নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো তার সঙ্গে হাত মেলান। এর ফলে বাঙালিদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। রাকসু (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ)-র সাবেক ভিপি, আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত এমএনএ এবং স্বাধীনতা- পরবর্তীকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু ৮৯°২৪ পৃ সাঁথিয়া সাইয়িদ তখন প্রায়ই নিজ জন্মস্থান-সংলগ্ন সাঁথিয়ায় এসে আন্দোলন-সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে এলাকার জনসাধারণকে নিয়ে সভা-সমাবেশ শুরু করেন। তাঁর অনুপ্রেরণা ও প্রচেষ্টার ফলে সাঁথিয়ার জনগণ ইয়াহিয়ার সরকার ও পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে থাকে। এভাবেই প্রথমদিকে পরোক্ষভাবে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার পর সাঁথিয়ার সচেতন জনগণ বুঝতে পারে যে, মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য। তাই সেই যুদ্ধের জন্য তারা প্রস্তুতি নিতে থাকে। অধ্যাপক আবু সাইয়িদের নেতৃত্বে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় ৮ই মার্চ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয় এবং প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন ইপিআর সদস্য মো. জামাত আলী (দয়রামপুর)। মোজাম্মেল হক (পারগোপালপুর), মসলেম উদ্দিন কাজী (সাঁথিয়া বাজার; অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক), মো. আফতাব উদ্দিন (শশদিয়া; আনসার কমান্ডার), মো. মজিবুর রহমান (কোনাবাড়িয়া; আনসার), নূর মোহাম্মদ মিয়া ভানু (দৌলতপুর; সাঁথিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) প্রমুখ প্রশিক্ষণরত যুবকদের রাইফেল ও গোলাবারুদ সরবরাহ করতেন। রাইফেলের পাশাপাশি কাঠের ডামি রাইফেল ও বাঁশের লাঠি নিয়েও যুবকরা ট্রেনিং নিত। ছাত্র- যুবকদের সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করতেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার ও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবদুল ওয়াহাব মিঞা (দৌলতপুর), সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক রোস্তম আলী মিঞা (বোয়াইলমারী), কাশীনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আয়েজ উদ্দিন প্রমুখ। ১৫ই মার্চ থেকে উপজেলার বিভিন্ন পাড়া ও মহল্লায় প্রশিক্ষণ শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে স্থানীয় যেসব নেতা প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে সফল করে তোলেন, তাঁরা হলেন- মো. আবদুল ওয়াহাব মিঞা, ছাত্রনেতা মো. ফজলুল হক (তেঁতুলিয়া; পরে শহীদ), মো. নিজাম উদ্দিন (সাঁথিয়া বাজার), মো. মজিবুর রহমান (বোয়াইলমারী; সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান), মো. আবদুল জব্বার কেরানি (তেঁতুলিয়া), ডা. মো. মোজাফ্ফর হোসেন (পোরাট), মো. আ. গফুর গাজি মাস্টার (সাঁথিয়া; রিলিফ চেয়ারম্যান), মো. মসলেম উদ্দীন (সাঁথিয়া; আওয়ামী লীগ নেতা ও সহকারী রিলিফ চেয়ারম্যান), মো. আয়েজ উদ্দীন, অসিত কুমার দাস (সাঁথিয়া বাজার), মো. রোস্তম আলী মিঞা, মো. তোফাজ্জল হোসেন মাস্টার (কোনাবাড়িয়া) প্রমুখ। ২১শে মার্চ মো. আলতাব হোসেন, মো. লোকমান হোসেন ও মো. রেজাউল করিমসহ সাঁথিয়া বাজারের বিভিন্ন দোকান মালিক নিজ-নিজ দায়িত্বে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এঁদের বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন মো. সিরাজুল হক প্রামাণিক, মো. সৈয়দ আলী খান, অসিত কুমার দাসসহ আরো অনেকে। ২৪শে মার্চ বোয়াইলমারী বাজারে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও এলাকার কৃষক-শ্রমিক-জনতার উপস্থিতিতে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়।
২৫শে মার্চ বাঙালি জাতির ইতিহাসে করুণ ও ভয়াবহ ট্র্যাজেডিপূর্ণ একটি দিন। এদিন রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকবাহিনী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগের সূচনা করে। এ খবর শুনে সাঁথিয়া থানার কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা বেড়া থানায় গিয়ে অধ্যাপক আবু সাইয়িদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি সাঁথিয়া থানার ওসিকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা থানায় গেলে ২৭শে মার্চ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ আনুমানিক ৩০ জন প্রতিরোধযোদ্ধার নামে অস্ত্র বরাদ্দ দেয়ার নির্দেশ দেন। অস্ত্রপ্রাপ্তরা হলেন- মো. ফজলুল হক (তেঁতুলিয়া), মো. নিজাম উদ্দিন, মো. মোসলেম উদ্দিন কাজী, মকবুল হোসেন মুকুল ও শেখ মজিবর রহমান পাগলা (সাঁথিয়া বাজার), মো. আফতাব উদ্দিন ও মো. আবু হানিফ মল্লিক (শশদিয়া), মো. রেজাউল করিম, মো. লোকমান হোসেন, মো. হারুনার রশিদ, মো. আবু সাত্তার ও মো. আবদুস সামাদ প্রামাণিক (সর্বগ্রাম বোয়াইলমারী), মো. আলতাব হোসেন ও মো. কামরুল আলম বাদশা (দৌলতপুর), মো. হাফিজুর রহমান টেনা, মো. আ. সাত্তার ফটকা, মো. মজিবর রহমান ও মো. কোবাদ আলী মিঞা (সর্বগ্রাম কোনাবাড়িয়া), মো. গোলাম মোর্শেদ (চরপাকুরীয়া), খোকন চন্দ্র হালদার (সাঁথিয়া থানা; সাবেক রিলিফ অফিসার), মো. নজরুল ইসলাম নান্নু (মন্দিরপুর, পাবনা), মো. নবীর উদ্দিন (নোয়ানী) প্রমুখ। এঁরা শুধু সাঁথিয়ায় নয়, পাবনা জেলার বিভিন্ন স্থানে দুঃস্থ ও অসহায় মানুষদের মধ্যে দুধ, রুটি, গুড়, ঔষধ ইত্যাদি পণ্যসামগ্রী বিতরণ করেন। ১৫ই এপ্রিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদের নির্দেশে প্রতিরোধযোদ্ধারা অস্ত্রগুলো থানায় ফেরত দেন।
মে মাসের প্রথমার্ধে অধ্যাপক আবু সাইয়িদের পরামর্শে সাঁথিয়া থানার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রতিরোধযোদ্ধা উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে গমন করেন। তাঁরা ভারতের কেঁচুয়াডাঙ্গা, বালুরঘাট, তরঙ্গপুর, শিলিগুঁড়ি প্রভৃতি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন বাহিনীর কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডারগণ। কমান্ডাররা হলেন- মো. নিজাম উদ্দিন (পারগোপালপুর), মো. লোকমান হোসেন, মো. আব্দুর রাজ্জাক (মুকুল), মো. আবদুল লতিফ মিঞা, মো. আফতাব উদ্দিন (মুজিব বাহিনীর কমান্ডার); এফএফ-বাহিনীর মো. হাবিবুল্লাহ বাহার, মো. আনোয়ারুল ইসলাম (মিন্টু), মো. আব্দুল কাদের ও মো. আক্তার আলম, মন্তাজ আলী (চতুর), মো. জহুরুল হক (ভারপ্রাপ্ত)। ডেপুটি কমান্ডাররা হলেন- মো. মোফাজ্জল হোসেন (মানু), মো. মতিউর রহমান, মো. আফছার আলী, মো. মজিবর রহমান ও মো. রেজাউল করিম। এসব মুক্তিযোদ্ধা ভারত থেকে উন্নত প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং ২৫শে আগস্ট থেকে সাঁথিয়ার মাটিতে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
১৯শে এপ্রিল পাকবাহিনী সাঁথিয়া থানায় অনুপ্রবেশ করতে সচেষ্ট হলে পাইকরহাটি গ্রামের ডাববাগানে (বর্তমান শহীদ নগর) মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিরোধ করেন। ফলে উভয় পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এতে ৫০ জন পাকসেনা নিহত ও ৩০- ৪০ জন আহত হয়। অপরপক্ষে ১২৬ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এরপর রাতের বেলা পাকসেনারা এক বিশাল বাহিনী নিয়ে এসে এলাকায় তাণ্ডব চালায়।
সাঁথিয়া উপজেলায় পাকবাহিনীর কোনো স্থায়ী ক্যাম্প ছিল না। তবে থানা, সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এবং ছন্দহে রাজাকার ও মিলিশিয়াদের তিনটি ক্যাম্প ছিল। পাকবাহিনী পাবনা থেকে মাঝে-মধ্যে এখানে আসত। সাঁথিয়া উপজেলায় মুসলিম লীগ ও ইসলামী-র নেতা-কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। তাদের সহায়তায় শান্তি কমিটি রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠিত হয় এবং তারা পাকবাহিনীকে নিয়ে হত্যা, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড চালায়। উপজেলার স্বাধীনতাবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হলো— মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী মনমথপুর; আলবদর কমান্ডার; ২০০২-২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী; যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৬ সালে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর), মো. আনসার আলী (গোপীনাথপুর, আলবদর বাহিনীর সদস্য), ফয়েজ উদ্দিন সরকার (নাগডেমরা, শান্তি কমিটির সভাপতি), ডা. আলী আহম্মদ (ছন্দহ, শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক), মাওলানা হাবিবুর রহমান (ছন্দহ, শান্তি কমিটির সদস্য), মো. ঠান্টু মিয়া (বরাট, শান্তি কমিটির সদস্য)। এছাড়া রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মো. আব্দুল গফুর মৃধা (বরাট), মো. আব্দুল বাছেদ, মো. গোলাম মোস্তফা (ছন্দহ), মো. লুৎফর রহমান, মো. ফারুক হোসেন (সাঁথিয়া বাজার), মো. আব্দুল কাদের, মো. চাঁদু (আর-আতাইকুলা), মো. নুরুল ইসলাম, মো. মকছেদ বিশ্বাস, মো. মসলেম উদ্দিন, মো. কফিল মুন্সি (বড়গ্রাম), মো. নওশের আলী (সাটিয়াকোলা), ডা. মো. ফজলুল হক (কুশিয়ারা) প্রমুখ।
১৯শে এপ্রিল রাতে সাঁথিয়ায় অনুপ্রবেশের পর পাকসেনারা মো. নওশের আলী (সাটিয়াকোলা), মো. নফর আলী খান (দত্তপাড়া), মো. কফিল মুন্সি (বড়গ্রাম), মো. আব্দুল গফুর মৃধা, মো. ঠান্টু মিয়া ও মো. আব্দুল বাছেদ (সর্বগ্রাম বরাট), মো. আব্দুল লতিফ মুন্সি (জাতসাকিনী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান), ডা. মো. ফজলুল হক (কুশিয়ারা, বর্তমান ঠিকানা কাশীনাথপুর বাজার)-সহ স্থানীয় আরো অনেক পাকিস্তানি দালালের সহযোগিতায় গ্রামবাসীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। ডাববাগানসহ পার্শ্ববর্তী রামভদ্রবাটি, করিয়াল, বড়গ্রাম, সাটিয়াকোলা প্রভৃতি গ্রাম একে-একে পুড়িয়ে দেয়। বাড়ি-বাড়ি গিয়ে লোকজনদের ধরে এনে বর্তমান শহীদ নগরের একটি আমগাছের নিচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে প্রায় দুশ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এ ঘটনা ডাববাগান গণহত্যা বা শহীদ নগর গণহত্যা নামে পরিচিত। তারা শুধু গ্রামবাসীদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি – নারীধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ নানাবিধ পৈশাচিক কর্মকাণ্ড ঘটায়। এসব কর্মকাণ্ডে করমজা গ্রামের আফাজ ডাক্তার, আ. লতিফ, শেখ কাজেম আলী, খোরাজ শেখ, পিয়ার মণ্ডল, জাকের আলী শেখ, সৈয়দ আলী মোল্লা, জগনারায়ণ বিশ্বাস প্রমুখ বিশেষভাবে লিপ্ত ছিল। শহীদ নগরের যে-আম গাছটির নিচে গ্রামবাসীদের হত্যা করা হয়, সে-গাছটি এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডাববাগানের যুদ্ধে শহীদ ইপিআর সদস্যদের শহীদ নগরে গণকবর দেয়া হয়, যা ডাববাগান গণকবর বা শহীদ নগর গণকবর- নামে পরিচিত।
৮ই মে করমজা গ্রামে একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়, যা করমজা গণহত্যা নামে পরিচিত। এখানে ১১ জনকে হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়। কবরের স্থানটি করমজা গণকবর হিসেবে পরিচিত। ১৪ই মে রাতে সাঁথিয়া উপজেলার নাগডেমরা ইউনিয়নের বাউশগাড়ি ও রূপসী এবং পার্শ্ববর্তী ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা গ্রামে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা হামলা চালায়। ঘুমন্ত মানুষ হঠাৎ গুলির শব্দে জেগে উঠে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকে। বাউশগাড়ি ও রূপসী গ্রামের পাঁচ শতাধিক নারী-পুরুষ প্রাণের ভয়ে বাউশগাড়ি গ্রামের পশ্চিম পাশের বিশাল বাঁশঝাড়ের এক গভীর গর্তে লুকিয়ে ছিল। হানাদার বাহিনী সেখানে গিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। এতে মো. খলিলুর রহমান, মো. মুজিবুর রহমান, মো. আব্দুল গফুর ও মোকছেদ আলী এ ৪ জন ব্যতীত আর সকলে শহীদ হয়। এ ঘটনা বাউশগাড়ি-রূপশি গণহত্যা নামে পরিচিত। এদিন হানাদাররা নারীনির্যাতন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটায়। ১০ই জুন মাধপুরে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী পাবনা জেলা স্কুলে জনপ্রিয় শিক্ষক মওলানা কসিমউদ্দিন আহমেদ ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যাকে করে মাটিচাপা দেয়, যা মাধপুর গণহত্যা নামে পরিচিত।
১২ই নভেম্বর পাবনা জেলা রাজাকার কমান্ডার মাওলানা ইসহাক আলীর নেতৃত্বে লাহিড়ী-সোনাতলা গ্রামে পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনী যৌথভাবে আক্রমণ করে ২৭ জন সাধারণ মানুষকে আটক করে। তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। পরে এদের মধ্য থেকে ২১ জনকে ছেড়ে দিয়ে বাকি ৬ জনকে নিয়ে সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্পের উদ্দেশে তারা রওনা দেয়। পথে সলঙ্গী ও পোরাটের মাঝখানে অবস্থিত নীলকুঠির কাছে এসে মো. গহের উদ্দিন সরকার (চোমরপুর) ও মো. আবু জাফর সরকার (সোনাতলা)-কে বেদম প্রহার করে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। মোরশেদ আলী মুসুল্লি ও রজব আলী মল্লিক (সোনাতলা) নামে দুজনকে দৌলতপুর গ্রামের আব্দুল হান্নান কাজীর বাড়ি-সংলগ্ন রাস্তার ওপর গুলি করে হত্যা করে পার্শ্ববর্তী খালে লাশ ফেলে দেয়। অপর দুজন যথা রমজান আলী প্রামাণিক ও জহির উদ্দিন মোল্লা (সোনাতলা)- কে একসঙ্গে বেঁধে দৌলতপুর এলুরমার বাড়ি-সংলগ্ন রাস্তার ওপর গুলি করে হত্যা করে। রাজাকারদের এরূপ নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড বন্ধের উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান গ্রহণ করেন।
২৬শে নভেম্বর দিবাগত রাত ৩টায় অর্থাৎ ২৭শে নভেম্বর দালালদের সহায়তায় প্রায় পাঁচশত পাকসেনা অতর্কিতে ধুলাউড়ি গ্রামটি ঘিরে ফেলে। এ গ্রামে তখন মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করছিলেন। এর পার্শ্ববর্তী রামকান্তপুর, বিলসলঙ্গী, পাইকশা ও নাড়িয়াগদাই গ্রামেও মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন। মো. রেজাউল করিম, আনোয়ারুল ইসলাম ও মকবুল হোসেন মুকুল তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। হঠাৎ গভীর রাতে গুলির শব্দ শুনে গ্রামের মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। পাহারারত মুক্তিযোদ্ধারা সময়মতো তাঁদের সহযোদ্ধা ও গ্রামবাসীকে সতর্ক করার সুযোগ পর্যন্ত পাননি। পাকসেনারা এক নাগারে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ চালাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা ও বহু গ্রামবাসীকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারে। যুবতী মেয়েদের ধরে এনে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। রশি দিয়ে বেঁধে ইছামতি নদীর পাড়ে ব্রাশ ফায়ারে অসহায় মানুষদের হত্যা করে। এদিন ধুলাউড়িতে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ২৭ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। এ ঘটনা ধুলাউড়ি গণহত্যা নামে পরিচিত। শহীদদের ধুলাউড়ি ফকিরপাড়া প্রাইমারি স্কুলের সামনে কবর দেয়া হয়। এ স্থানটি এখন ধুলাউড়ি গণকবর হিসেবে চিহ্নিত। ১৪ই মে বাউশগাড়ি-রূপশি গণহত্যার শিকার প্রায় ৬০০ মানুষকে বাউশগাড়ি-রূপশি গণকবর এ সমাহিত করা হয়।
হত্যাকাণ্ড শেষে পাকবাহিনী বেলা ১টার দিকে সাঁথিয়া ফেরার পথে নাড়িয়াগদাই, নূরদহ, ধোপাদহ ও হলুদঘর গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। রুদ্রগাতি গ্রামের আব্দুস সামাদকে ধরে নিয়ে এসে সাঁথিয়া থানার সামনে বেলগাছে পা ওপরে মাথা নিচে ঝুলিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে সারা শরীরে লবণ লাগিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। আহত মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহানকে সাঁথিয়া উপজেলার রাজাকার কমান্ডার আব্দুস সাত্তার বেয়নেট দিয়ে গলা কেটে নদীর ধারে ফেলে যায়। তিনি অবশ্য চিকিৎসায় শেষ পর্যন্ত বেঁচে যান। এ ঘটনার পর ২৮শে নভেম্বর কমান্ডার মো. নিজাম উদ্দিনের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে বন্দিরাম, সাঁথিয়া, দৌলতপুর, ধোপাদহ, কালাইচরা, পূর্বভবানীপুর, নওয়ানী, কাশীনাথপুর ও বোয়াইলমারীসহ বিভিন্ন গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করেন।
সাঁথিয়া উপজেলায় রাজাকার ও মিলিশিয়াদের থানা ক্যাম্প, সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্প ও ছন্দহ ক্যাম্প ছিল হানাদারদের নির্যাতনকেন্দ্র। আর বড়ভিটা, সোনাতলা, নাগডেমরা, ছোট মঙ্গলগ্রাম (জঙ্গলবাড়ি), ভুলবাড়িয়া, আড়িয়াডাঙ্গি, কাজীপুর, আর-আতাইকুলা ও ধোপাদহ ফুটবল মাঠ ছিল বন্দিশিবির। এসব জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরে এনে নির্যাতন ও বন্দি করে রাখা হতো।
সাঁথিয়া উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয়, যথা- ডাববাগান যুদ্ধ ও সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় হানাদার ক্যাম্প অপারেশন। ডাববাগান যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৯শে এপ্রিল ইপিআর সুবেদার গাজী আলী আকবর (শান্তিডাঙ্গা, কুষ্টিয়া)- এর নেতৃত্বে। এটি ছিল খুবই ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এ- যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদস্য। সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় হানাদার ক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয় দুবার ১১ই অক্টোবর ও ২রা নভেম্বর। প্রথমবার অপারেশনে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার লোকমান হোসেন। এতে রাজাকার, মিলিশিয়া, আলবদর ও পাকবাহিনীর ২১ জন সদস্য নিহত হয়। দ্বিতীয়বার অপারেশন পরিচালিত হয় কমান্ডার লোকমান হোসেন, কমান্ডার আব্দুল লতিফ, কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক মুকুল ও আফতাব উদ্দিনের নেতৃত্বে। এতে বেশ কয়েকজন রাজাকার নিহত ও কয়েকজন আহত হয়।
২রা নভেম্বর সাঁথিয়া হানাদার ক্যাম্প অপারেশনের খবর পেয়ে শাহজাদপুরের নুকালী গ্রাম থেকে কমান্ডার মো. নিজাম উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ সাঁথিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। এ গ্রুপের সঙ্গে নগরবাড়ি-বগুড়া সড়কে বাঘাবাড়ির অদূরে একটি ব্রিজের নিকট পাকবাহিনী, রাজাকার ও মিলিশিয়াদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। কিন্তু পাকসেনাদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় কমান্ডার মো. নিজাম উদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেন এবং তাঁরা বড় ডেমরায় এসে রাত্রি যাপন করেন।
৭ই ডিসেম্বর সাঁথিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বৈঠক হয়। এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমান্ডার মো. নিজাম উদ্দিন, মো. লোকমান হোসেন, মো. আয়েজ উদ্দিন, মো. তোফাজ্জল হোসেন (মাস্টার), আবু মুছা আল-আসারী ও আলতাব হোসেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অর্ধশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা এবং ২০-২৫ জন পুলিশ, সেনা, ইপিআর ও আনসার সদস্য বিকেল ৫টা থেকে থানা ঘেরাও করে রাখেন। ৮ই ডিসেম্বর দুশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সাঁথিয়া থানা দখল করে নেন। এ সময় থানায় যেসব রাজাকার ছিল তারা কোনোরূপ প্রতিরোধ না করে পালিয়ে যায়। সাঁথিয়ার জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা কমান্ডার মো. নিজাম উদ্দিন ও আয়েজ উদ্দিনকে গার্ড অফ অনার প্রদান করেন। এ-সময় জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
এদিকে পাকসেনারা থানা দখলের খবর পেয়ে সাঁথিয়া অভিমুখে অগ্রসর হয়। মুক্তিযোদ্ধারাও তাদের প্রতিরোধ করার জন্য এগিয়ে যান। থানা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পশ্চিমে নন্দনপুর-কোনাবাড়িয়া ব্রিজের কাছে উভয় পক্ষে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। কমান্ডার মো. নিজাম উদ্দিন, মো. লোকমান হোসেন, মো. আলতাব হোসেন, রনজিত কুমার ও মো. জামাত আলী এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। প্রায় ১০ ঘণ্টাব্যাপী এ- যুদ্ধে পাকবাহিনীর একটি ট্রাক ধ্বংস হয় এবং একটি জিপগাড়ি ফেলে তারা পালিয়ে যায়। যুদ্ধশেষে মুক্তিযোদ্ধারা থানায় ফিরে যান।
৯ই ডিসেম্বর সাঁথিয়া থানা সদর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে নন্দনপুর ও জোড়াগাছা গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি যুদ্ধ হয়। এদিন বিকেল ৩টার দিকে পাবনা জেলার রাজাকার কমান্ডার মাওলানা ইসহাক আলী ও সাঁথিয়ার কয়েকজন রাজাকার মাওলানা হাবিবুর রহমান, গোলাম মোস্তফা ও লুৎফর রহমান (সর্বগ্রাম ছন্দহ), আব্দুস সাত্তার, ফারুক হোসেন ও আব্দুল কাদের (সাঁথিয়া) এবং নূরুল ইসলাম, মো. চাঁদু ও মো. আনসার আলী (আর-আতাইকুলা) পাকিস্তানি মিলিশিয়াদের নিয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে পাবনা থেকে সাঁথিয়ার দিকে আসছিল। নন্দনপুর-জোড়গাছা ব্রিজ-সংলগ্ন স্বরূপ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মো. আনছার আলী (নাগডেমরা), আলতাব হোসেন (দৌলতপুর), মো. আব্দুর রউফ, মতিউর রহমান মতি ও আব্দুল লতিফ (নন্দনপুর)-এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন। এ-যুদ্ধে বীর নারীমুক্তিযোদ্ধা ভানুনেছা সাঁথিয়া থানা থেকে বস্তাভর্তি গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেন। যুদ্ধে রাজাকার ও মিলিশিয়ারা পরাজিত হয়ে মাইক্রোবাসটি ফেলে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় জনগণ নন্দনপুর থেকে ছন্দহ পর্যন্ত আনন্দ মিছিল করে। রাজাকারদের পরিত্যক্ত মাইক্রোবাসটি সাঁথিয়া থানায় নিয়ে আসা হয়। এদিনই সাঁথিয়া থানা হানাদারমুক্ত হয়।
পাকসেনারা যাতে আর সাঁথিয়ায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য ১০ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে সাঁথিয়ার চতুর্দিকে অবস্থান নেন। ১৫ই ডিসেম্বর কতিপয় রাজাকার ও পাকসেনা সিরাজগঞ্জ থেকে শাহজাদপুর, তারাবাড়িয়া ও কাশীনাথপুর হয়ে পাবনার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। জানা যায়, তারা আত্মসমর্পণ করার উদ্দেশ্যে পাবনা যাচ্ছিল। যাওয়ার পথে তারা সামনে যাকে পায় তাকেই গুলি করে হত্যা করছিল। এ খবর পেয়ে বেড়া থানার কমান্ডার এস এম আমির আলীর নেতৃত্বে শাহজাদপুর থানার ধিতপুর নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষে কয়েক ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধ হয়। বেলা ৩টার দিকে পাকসেনারা পিছু হটে। এ-যুদ্ধে আব্দুল খালেক (বৃশালিকা, বেড়া উপজেলা) ও আমজাদ হোসেন (ছেঁচানিয়া) নামে দুজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আফতাব নগর উচ্চ বিদ্যালয়ে এঁদের লাশ নিয়ে আসা হলে এক করুণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়, কারণ বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। ১৬ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর পাওয়ামাত্র সাঁথিয়ার মুক্তিযোদ্ধা ও ছাত্র-জনতা তাৎক্ষণিক এক বিজয় মিছিল বের করে। মিছিলে পাবনার সাবেক এমপি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হোসেন, রফিকুল ইসলাম বকুল, আওরঙ্গজীব বাবলু, বেবী ইসলাম, আব্দুল বাতেন ও নজরুল ইসলাম নান্নু এবং সাঁথিয়ার বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ, সর্বস্তরের জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা যোগদান করেন। এর কিছুদিন পর এফএফ বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা পাবনা মিলিশিয়া ক্যাম্পে এবং মুজিব বাহিনীর সদস্যরা ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর নিকট অস্ত্র জমা দেন।
সাঁথিয়া উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- শাহজাহান আলী (পিতা আব্দুল লতিফ মাস্টার, বোয়াইলমারী; ১৫ই মার্চ ঢাকার পিলখানায় শহীদ), ফজলুল হক (পিতা বেলাল হোসেন, তেঁতুলিয়া; ১৫ই আগস্ট কুষ্টিয়ায় শহীদ), শাহজাহান আলী (পিতা জফের আলী মোল্লা, হাড়িয়াকাহন; ঐ), আনোয়ারুল ইসলাম মিন্টু (পিতা মো. আব্দুল হামিদ, পাটগাড়ি; ৯ই নভেম্বর কালিয়ান যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল আওয়াল (পিতা জমির উদ্দিন প্রামাণিক, এন মনোহারগাতি; ঐ), জয়গুরু হালদার (পিতা খেপা হালদার, বেড়া, বনগ্রাম; ঐ), গোলাম মোস্তফা খান লোদী (পিতা রোস্তম আলী খান লোদী, নাগডেমরা; ঐ), আব্দুস সবুর (পিতা আব্দুল রাজ্জাক, নাগডেমরা; ঐ), মজিবর রহমান (পিতা অভির উদ্দিন ফকির, বানিয়াবহুল; ঐ), নজরুল ইসলাম চাঁদু (পিতা মো. খোরশেদ আলম, কাশিয়াবাড়ি; ঐ), খবির উদ্দিন বিশ্বাস (পিতা ঝবু বিশ্বাস, পদ্মবিলা; ২৬শে নভেম্বর ধুলাউড়ি যুদ্ধে শহীদ), আক্তার হোসেন (পিতা আলিমুদ্দিন, ইসলামপুর; ঐ), চাঁদ আলী বিশ্বাস (পিতা রিয়াজ উদ্দিন বিশ্বাস, রঘুনাথপুর; ঐ), দারা মিয়া (পিতা আবুল হোসেন, রঘুনাথপুর; ঐ), মহসিন ওরফে মধু (পিতা মো. আব্দুল গফুর শেখ, কাজীপুর; ঐ), সামছুর রহমান (পিতা মোহাম্মদ আলী শেখ, রঘুনাথপুর; ঐ), মোকছেদ আলী (পিতা দারোগ আলী, বামনডাঙ্গা; ঐ), শিহাব উদ্দিন (পিতা হাজী এছের উদ্দিন শেখ, চরপাড়া; ঐ), আব্দুস সামাদ (পিতা সুখিয়া প্রামাণিক, রুদ্রগাঁতি; ঐ) এবং আমজাদ হোসেন (পিতা ছকির উদ্দিন প্রামাণিক, ছেঁচানিয়া; ১৫ই ডিসেম্বর ধিতপুর যুদ্ধে শহীদ)। এছাড়া ধিতপুর যুদ্ধে বেড়া উপজেলার বৃশালিকা গ্রামের আব্দুল খালেক (পিতা জুরান উদ্দিন সরকার) নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
সাঁথিয়া উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১০ই জুন পাকহানাদাররা পাবনা জেলা স্কুলের জনপ্রিয় শিক্ষক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মাওলানা কসিম উদ্দিন আহমেদসহ দুজন অজ্ঞাত মুক্তিযোদ্ধাকে মাধপুরের কাছে ইছামতি নদীর ধারে বাঁশঝাড়ের মধ্যে হত্যা করে সেখানে মাটিচাপা দেয়। ১৯৭২ সালে সেখানে প্রাথমিকভাবে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে এর বর্তমান রূপ দেয়া হয়। সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদের উদ্যোগে উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে উপজেলা নির্বাহী অফিসের সামনে স্থপতি জুলির ডিজাইনে নির্মাণ করা হয় ‘বিজয় স্মৃতিস্তম্ভ’। ১৯৭১ সালের ১৯শে এপ্রিল শহীদ নগর গণহত্যায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯৯৭ সালে তাঁর প্রচেষ্টায় বীর বাঙালি নামে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। ১৪ই মে বাউশগাড়ি ও রূপসী গ্রামের গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে ২০১০ সালে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট শামসুল হক টুকুর উদ্যোগে বাউশগাড়িতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। একইদিন ডেমরা গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে ডেমরা বাজারে ২০১১ সালে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। ২৭শে নভেম্বর ধুলাউড়ি গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে ধুলাউড়ি ফকিরপাড়া প্রাইমারি স্কুলের সামনে তাঁদের গণকবরে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া মাওলানা কসিম উদ্দিন আহমেদের নামে সাঁথিয়া-মাধবপুর সংযোগ সড়ক ও শহীদ শিহাব উদ্দিননের নামে মাধবপুর- চরপাড়া সড়কের নামকরণ করা হয়। [মো. আবদুল মজিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!