যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক সাইদুর রহমান
সাইদুর রহমান, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪৯) নায়েক সুবেদার ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৯ সালের ১লা এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার জামজামি ইউনিয়নের ঘোষালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খন্দকার আবদুল মজিদ এবং মাতার নাম সাজেদা খাতুন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে সাইদুর রহমান ইপিআর-এ কর্মরত ছিলেন। ইপিআর-এ চাকরিকালীন সময়ে তিনি পাকিস্তানি শাসকদের বাঙালিদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব প্রত্যক্ষ করেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করলে সাইদুর রহমানসহ সেখানকার অন্য বাঙালি সৈনিকরা বিদ্রোহ করে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সাইদুর রহমান ছিলেন ৬ পাউন্ডার গান (ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী অস্ত্র) ইউনিটের সদস্য। ৩০শে মার্চ সন্ধ্যায় ‘পাকিস্তানি সৈন্যরা সাঁজোয়া গাড়িতে যশোরের চাঁচড়ার দিকে আসছিল। সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন। এতে গোলার আঘাতে হানাদারদের ২টি গাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় এবং কয়েকজন সৈন্য নিহত হয়। এর আগে ২৩শে মার্চ যশোর ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলনে সাইদুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। প্রতিরোধযুদ্ধের পর তিনি ভোমরা ডিফেন্সে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ৮নং সেক্টরের অধীন যশোর, চৌগাছা, বেনাপোল ও শার্শায় পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করে সাহসিকতার পরিচয় দেন। জুন মাসের প্রথমদিকে তাঁকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখানে তিনি ডি কোম্পানির ১১ নম্বর প্লাটুনে ছিলেন। এ-সময় তিনি ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে তেলঢালায় যান। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির পর কোম্পানি কমান্ডার সালাহউদ্দিন মমতাজের নেতৃত্বে তিনি জামালপুরের ধানুয়া-কামালপুর যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন। এ-যুদ্ধে অধিনায়ক সালাহউদ্দিন মমতাজ শহীদ এবং সাইদুর রহমান পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। ভারতের গৌহাটি হাসপাতালে এক মাস চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে পুনরায় যুদ্ধের ময়দানে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে তিনি বকশিগঞ্জ, কাজারিয়া, চম্পারায়, পত্রখোলা, তালাই, শ্রীমঙ্গল, রাজঘাট, আটগ্রাম, চারনাম ও গৌরিঘাট যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১১ই নভেম্বর সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা সিলেট জেলার কানাইঘাট এলাকায় অবস্থানকালে হানাদার বাহিনীর আকস্মিক হামলার শিকার হন। এতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। কিন্তু সাইদুর রহমান তাঁর দৃঢ়চেতা মনোভাব নিয়ে চায়না হালকা মেশিনগান দিয়ে হানাদার বাহিনীর ওপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করেন। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং একজনকে মুক্তিযোদ্ধারা জীবিত ধরে ক্যাম্পে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার সাইদুর রহমানকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীনতার পর তিনি বিডিআর (বর্তমান বিজিবি)-এ চাকরি করতেন। ২০০৬ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম নাদিরা পারভীন। এ দম্পতি ২ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জনক-জননী। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড