You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে সরাইল উপজেলা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)

সরাইল উপজেলা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত সরাইলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তাহের উদ্দিন ঠাকুর এবং প্রাদেশিক পরিষদে এডভোকেট সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণে ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা বরেন। এর প্রতিবাদে সরাইলের বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ৪ঠা মার্চ সরাইল কলেজের অধ্যক্ষ ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আবু হামেদের নেতৃত্বে সর্বস্তরের জনতার এক মিছিল ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ শুনতে সরাইলের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এর নেতা-কর্মীরা ঢাকায় আসেন। ১৯শে মার্চ জয়দেবপুরে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর পাকবাহিনীর নির্বিচারে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ২০শে মার্চ সারাদেশের মতো সরাইলেও মিছিল ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৩শে মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-এর ডাকে সারাদেশের মতো সরাইলেও ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হয়। ২৪শে মার্চ সরাইলের স্কুল-কলেজ ও দোকানপাটে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়।
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) উদ্যোগে থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম রব্বানীকে আহ্বায়ক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। গ্রাম পর্যায়ে যাঁরা আন্দোলন সংগঠিত করেন তাঁরা হলেন- তাহের উদ্দিন ঠাকুর এমএনএ, এডভোকেট সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম এমপিএ, রবীন্দ্রনাথ নাগ, নেপাল নাগ, হীরালাল নন্দী, ডা. চিন্তাহরণ দেব (কালীকচ্ছ), গোলাম রব্বানী (কুট্টাপাড়া), বন্ধুগোপাল চক্রবর্তী (শাহবাজপুর), আবদুল বাতেন লস্কর (কালীকচ্ছ), এডভোকেট হামিদুর রহমান, এডভোকেট সৈয়দ আকবর হোসেন বকুল মিয়া, এডভোকেট আবদুস সামাদ, জুনায়েদ উদ্দিন ঠাকুর, মজনু ঠাকুর, ডা. হারুন ইসলাম, ন্যাপ নেতা দেওয়ান মাহবুব আলী, কালিদাস সিংহ রায়, সুধীর দাস, ছাত্রনেতা আ. হালিম, আবুবকর মজনু, দিলীপ নাগ, শফিকুল ইসলাম শফি, মদন, বাধন, মন্টু, মো. সাদেক, কাজি মফিজুল ইসলাম দুধ মিয়া প্রমুখ।
সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পরই অবসরপ্রাপ্ত ইপিআর সদস্য ইদন মিয়া (কুট্টাপাড়া) এবং জমশেদ আলীর (তেরকান্দা) নেতৃত্বে সরাইল অন্নদা স্কুল মাঠে এবং কাছারি পুকুরপাড়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন আশরাফ উদ্দিন, নূর আলী, শাহ কুতুব উদ্দিন, মিজান ঠাকুর, আব্দুল মজিদ প্রমুখ। কালীকচ্ছ পাঠশালা মাঠে সেনাবাহিনীর সুবেদার জয়নুল হোসেন লস্কর ও হাবিলদার আবদুল জলিল এলাকার ছাত্র-যুবকদের নিয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। কিছুদিন পর এই কেন্দ্রটি সরাইল গরুর বাজার মাঠে স্থানান্তর করা হয়। পর্যায়ক্রমে এখানে দুশতাধিক ছাত্র-যুবক প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর শাহবাজপুরের ছাত্র-যুবকরা স্থানীয় হাইস্কুলে একটি স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেন। এ দলে ছিলেন— রফিক উদ্দিন (হুমায়ূন), হাবিবুর রহমান, সাব্বির আহমদ, আলী হোসেন, দীলিপ নাগ, তামান্না মিয়া, খসরু মিয়া, দানা মিয়া, ওছমান উদ্দিন খালেদ, যতীন মোহন চৌধুরী প্রমুখ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশ পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রশিক্ষণ ওয়াপদা রেস্ট হাউস মাঠে চলতে থাকে। প্রশিক্ষণের এক পর্যায়ে বিজি প্রেসে কর্মরত হুমায়ুন কবির (পিতা মুতিউদ্দিন আহমেদ, মৌলভীপুকুরপাড়া, শাহবাজপুর) একটি একনালা বন্দুক ও কিছু কার্তুজ নিয়ে এ দলে যোগ দেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা মানিক মিয়া ১৬টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল নিয়ে এসে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেন। তিনি ৫টি রাইফেল প্রশিক্ষণের জন্য দিয়ে যান। তা সহ ৬টি আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে শাহবাজপুরে প্রশিক্ষণ ও পাহারার কাজ চলে।
২৭শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিব উদ্দিনের সহযোগিতায় রবীন্দ্রমোহন নাগের নেতৃত্বে যতীন্দ্র মোহন চৌধুরী (শাহবাজপুর) ও আবদুল আলী মোল্লা (চান্দুরা) ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার বিষয়ে আলোচনা করতে ত্রিপুরা যান। রবীন্দ্র নাগ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্রসহ সর্বাত্মক সহযোগিতার আবেদন জানান। উল্লেখ্য যে, দেশ বিভাগোত্তর কালে তিনি ছিলেন শচীন্দ্রলালের সহ-কারাবন্দি। মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শে তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে তারবার্তা প্রেরণ করেন। তারবার্তার জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীকে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিবৃন্দের ভারত আসার পরামর্শ দেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এমপিএ, এমএনএসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ ত্রিপুরা যান। তারপরই ত্রিপুরা সীমান্ত শরণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সফল আলোচনার পর রবীন্দ্র নাগ দেশে চলে আসেন। তাঁর নির্দেশে যতীন্দ্র মোহন চৌধুরী ১লা এপ্রিল ৭-৮টি অস্ত্র বোঝাই ট্রাক ও ১টি জিপসহ তেলিয়াপাড়া থেকে আগরতলা হয়ে শাহবাজপুর আসেন। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়া অনিরাপদ ভেবে বিএসএফ জোয়ানদের সহযোগিতায় শাহবাজপুর ইউনিয়ন অফিস এবং তৎসংলগ্ন চক্রবর্তী ও নাগবাড়ির আশেপাশে বাংকার তৈরি করে ডিফেন্স নেন। এই অস্ত্র দিয়ে ওয়াপদা রেস্ট হাউসে ঘাঁটি স্থাপন করে সেখানকার মাঠে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। এ প্রশিক্ষণে ছিলেন দীলিপ নাগ, যতীন্দ্র মোহন চৌধুরী, শেখ মাজেদ, বাহাদুর, ইউসুফ আলী, মকসুদ আলী, সাধুচরণ, আবদুস সোবহান প্রমুখ।
১৩ই এপ্রিল সরাইল বড় দেওয়ানপাড়ার তিন ভাই সাদেক ঠাকুর, নাসির উদ্দিন ঠাকুর, জুনায়েদ উদ্দিন ঠাকুর (সাধারণ সম্পাদক, সরাইল থানা আওয়ামী লীগ) ও আবদুল হালিম (সভাপতি, থানা ছাত্রলীগ) ত্রিপুরার উদ্দেশে সরাইল ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে দুই ভাই নাসির উদ্দিন ঠাকুর ও জিয়াউদ্দিন ঠাকুর মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা গ্রুপে যোগ দেন। ১৯শে এপ্রিলের পর সরাইল সদর, কালীকচ্ছ, নোয়াগাঁও, চুন্টা, পানিশ্বর, অরুয়াইল, শাহবাজপুরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের ছাত্র-যুবকরা উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ত্রিপুরা যান। ত্রিপুরায় গ্রুপ কামান্ডার আব্দুল্লাহ ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ৬০ জন, মো. হামিদুর রহমানের নেতৃত্ব সহোদর ৫ ভাই, সেকশন কমান্ডার মোস্ত মিয়ার নেতৃত্বে ১০ জন, হিমাংশু দেব ও কুতুবুল আলমের নেতৃত্বে ৩২ জন ছাড়াও ওছমান উদ্দিন খালেদ, তামান্না মিয়া, আলম মিয়া, ছোট মিয়া, কামরুল, আবু সায়েদ (ইপিআর সদস্য), হারুন মিয়া, মানিক মিয়া, আ. আজিজ, রিয়াজ উদ্দিন, মনসুর, কামাল, কামাল মিয়া (সুহিলপুর), শান্তি (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), মুখলেছ মিয়া (দেওড়া), মো. আবদুস সালাম প্রমুখ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পাকবাহিনীর ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখলের পর মুক্তিযোদ্ধারা মেঘনা তীরবর্তী সরাইলের আজবপুরে অবস্থান নেন। এ সময় ক্যাপ্টেন মতিন একদল ইপিআর পুলিশ ও আর্মি নিয়ে সরাইল ইউপি অফিসে এসে ৩-৪ দিন অবস্থান করেন এবং কয়েকজন সশস্ত্র সেনাসহ আজবপুর থেকে ক্যাপ্টেন গাফফার সরাইল আসেন। তাঁদের সঙ্গে এলাকার কয়েকজন যুবক দুধ মিয়া, রহমত আলী, অমরেশ রায়সহ সীমান্ত পার হয়ে আগরতলা চলে যায়।
সরাইলে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন— তাহের উদ্দিন ঠাকুর এমএনএ, দেওয়ান মাহবুব আলী, সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম, এডভোকেট হামিদুর রহমান, অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ আবু হামেদ, আবদুল হালিম, ড. শাজাহান ঠাকুর, সৈয়দ আকবর হোসেন, ফারুক, রবীন্দ্র মোহন নাগ প্রমুখ।
২৬শে মার্চের পরই শাহবাজপুরের স্বেচ্ছাসেবক দলটি দেশীয় অস্ত্র (গুলতি, বল্লম, দা, লাঠি, সড়কি, কোচ) দিয়ে ঢাকা- সিলেট সড়কে চেকপোস্ট তৈরি করে পাকসেনাদের প্রতিরোধে পাহারার ব্যবস্থা করে। ৬-৮ই এপ্রিল হাবিলদার মকসুদ আলীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তিতাস নদীতে পারাপারের নৌকাগুলোর তলদেশ কেটে দেয়। একাজে দা, কুড়াল, শাবল সংগ্রহে সহযোগিতা করেন মালেকা বেগম নামে এক নারী সেচ্ছাসেবক। ১৩ই এপ্রিল পাকবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখল করলে শত্রুসেনাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা তিতাস নদীর ওপর শাহবাজপুর সেতুটির দক্ষিণ অংশ ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে দেন।
১৩ থেকে ১৭ই এপ্রিলের মধ্যে পাকবাহিনী সরাইল থানার সর্বত্র অবস্থান গ্রহণ করে। তারা সদর হাসপাতাল, কালীকচ্ছ ঘাঁটিবাড়ি ও শাহবাজপুর ওয়াপদা রেস্ট হাউসে ক্যাম্প স্থাপন করে।
সরাইল উপজেলায় পাকবাহিনী অনুপ্রবেশের পর মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও পিডিপি নেতাদের উদ্যোগে শান্তি কমিটি এবং রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠিত হয়। তারা এলাকার যুবকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে এসব বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে। পাকবাহিনীর সহযোগিতা ও পথপ্রদর্শক হিসেবে এসব বাহিনীর সদস্যরা চুন্টা, শাহবাজপুর, কালীকচ্ছ, অরুয়াইল, পানিশ্বর প্রভৃতি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বিশেষত হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় নারীনির্যাতন, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তারা রাস্তাঘাট, ব্রিজ- কালভার্ট, নৌঘাটসহ বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ স্থানে পাহারার কাজ করে পাকসেনাদের রাস্তাঘাট ও মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর চিনিয়ে দেয় এবং খবর ও তথ্য সংগ্রহ করে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়।
সরাইল থানা শান্তি কমিটির উল্লেখযোগ্যরা হলো- মুসলিম লীগ নেতা মন্নাফ ঠাকুর (আহ্বায়ক, সরাইল থানা শান্তি কমিটি), জিয়াউল আমিন নান্নু মিয়া (আহ্বায়ক, শাহবাজপুর ইউনিয়ন শান্তি কমিটি), আবদুল হাকিম (আহ্বায়ক, কালীকচ্ছ ইউনিয়ন শান্তি কমিটি), এমদাদ উল্লাহ (আহ্বায়ক, নোয়াগাঁও ইউনিয়ন শান্তি কমিটি), ফরিদ ঠাকুর (আহ্বায়ক, শাহবাজপুর ইউনিয়ন শান্তি কমিটি), মইধর আলী (আহ্বায়ক, পাকশিমুল ইউনিয়ন শান্তি কমিটি), এমদাদুল হক টেকাবালী (আহ্বায়ক, চুন্টা ইউনিয়ন শান্তি কমিটি), মোবারক মাস্টার (আহ্বায়ক, পানিশ্বর দক্ষিণ শান্তি কমিটি), আবদুল হামিদ (আহ্বায়ক, শাহবাজপুর শান্তি কমিটি), গেদন মিয়া (চেয়ারম্যান, শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ), আবদুল হামিদ (শাহবাজপুর), মোহন মিয়া (শাহবাজপুর), বাবর আলী মেম্বার (ধরন্তী, কালীকচ্ছ), আবদুল হাসিম মেম্বর (সৈয়দটুলা), নান্নু মিয়া সরদার (কুট্টাপাড়া), গনি মিয়া দালাল (রসুলপুর), সুরুজ আলী ওরফে জারু মিয়া সরদার (চুন্টা) প্রমুখ।
পাকবাহিনী থানা দখলের পরই স্থানীয় শান্তি কমিটি ও রাজাকার সদস্যরা নির্যাতন, গণহত্যা ও লুটপাটে মেতে ওঠে। ৭ই আগস্ট তারা অতর্কিতে হামলা করে কালীকচ্ছ গ্রামের দুজন হিন্দু মহিলাসহ ৭ জনকে ধরে নিয়ে কুমিল্লা সেনানীবাসে আটকে রেখে নির্যাতন করে। জ্যোতিষ মাস্টারের বাবা শম্ভু সাহা ও গোপাল মাস্টারকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায়। তাদের আর খোঁজ মেলেনি। তারা আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট সৈয়দ আকবর হোসেন (বকুল মিয়া) ও তার ছোট ভাই আফজাল (ছাত্র)-কে ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে কুরুলিয়া খালে হত্যা করে। ১৮ই অক্টোবর চুন্টা গ্রামে আক্রমণ করে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা পরিমল দত্ত ও মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেনসহ অনেকের বাড়ি লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করে। এ-সময় তারা গ্রামের ৩১ জন সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে যায়, যার মধ্যে ২২ জন গণহত্যার শিকার হন। এটি চুন্টা গণহত্যা নামে পরিচিত। অক্টোবর মাসের শেষদিকে বুধল গ্রামবাসীর হাতে একজন পাকসেনা নিহত হয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে ৩১শে অক্টোবর পাকবাহিনী পার্শ্ববর্তী বিটঘর গ্রামে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে গণহত্যা চালায়। বিটঘর গণহত্যায় ৮০ জন গ্রামবাসী নিহত হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা ৪৭ জন সাধারণ মানুষকে ধরে এনে কালীকচ্ছের উত্তর দিকে ধর্মতীর্থ রাস্তার পাশে হত্যা করে, যা ধর্মতীর্থ গণহত্যা নামে পরিচিত। এছাড়া পাকবাহিনী কর্তৃক কালীকচ্ছ শ্মশান গণহত্যায় ৭ জন, পানিশ্বর বাজার গণহত্যায় ২৫ জন, কুচনিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় গণহত্যায় ৯ জন এবং শাহবাজপুর গণহত্যায় ৯ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। সরাইল থানা, কালীকচ্ছের ঘাঁটিবাড়ি, সদর হাসপাতাল ও শাহবাজপুর ওয়াপদা রেস্ট হউজ ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র।
পানিশ্বর ইউনিয়নের বিটঘর, নোয়াগাঁও ইউনিয়নের কুচনি, শাহবাজপুর ওয়াপদা রেস্ট হাউজ ক্যাম্প বধ্যভূমি ও গণকবর আছে। শাহবাজপুর ক্যাম্প বধ্যভূমিতে কয়েক হাজার লোককে হত্যা করা হয়। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে কালীকচ্ছ মাইন অপারেশন, শাহবাজপুর অপারেশন, সরাইল থানা অপারেশন উল্লেখযোগ্য। এছাড়া পানিশ্বর ও মেঘনার তীরবর্তী অঞ্চলেও কয়েকটি যুদ্ধ হয়। ১৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী শাহবাজপুর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে। অতর্কিত এ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে মাধবপুরে ডিফেন্স নেন। যুদ্ধে রনু নাগ, চান্দালী মিয়া ও মিয়া চান শহীদ হন। পরদিন পাকবাহিনী শাহবাজপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন পাড়ার মনীন্দ্ৰ নাগ, সুশীলা রাণী সাহা, গোলাপ সাহা, হিরা মিয়া, আলী হোসেন, কড়ু মিয়া ও ফুল মিয়াকে হত্যা করে এবং হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুটপাট ও তামান্না মিয়ার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এপ্রিল মাসের শেষদিকে সহোদর ভাই দুলা মিয়া, সোমিন মিয়া এবং মঞ্জুর আলী ও আ. শহীদ পাকবাহিনীর হাতে নিহত হন। ৫ই মে মুক্তিযোদ্ধারা শাহবাজপুর পাকসেনা ক্যাম্প আক্রমণ করলে ৯ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। ২৮শে আগস্ট মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদলের হাতে শান্তি কমিটির সদস্য বাবর আলী চেয়ারম্যান নিহত হয়। ৬ই অক্টোবর কালীকচ্ছ বাজারের উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা দলের মাইন বিস্ফোরণে পাকবাহিনীর দুটি গাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে পাকবাহিনীর কয়েকজন অফিসার ও সরাইল শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মন্নাফ ঠাকুর নিহত হয়। ২৯শে অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি গ্রুপ সরাইল থানা অপারেশন পরিচালনা করে। এ-সময় পাহারারত রাজাকাররা পালিয়ে যায়। ৮ই ডিসেম্বর সরাইল থানা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- আবুল খায়ের চৌধুরী, বীর বিক্রম (পিতা লনি মিয়া, কালীকচ্ছ)।
সরাইল থানার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- বিরাম আলী (পিতা মহরম আলী, নাথপাড়া; বিটঘর যুদ্ধে শহীদ), মেজবাহ উদ্দিন ফারুক (পিতা আবুল খায়ের মাস্টার, আঁখিতারা, নোয়াগাঁও; হবিগঞ্জ জেলার ছাতিয়ানের নোয়াপাড়ায় শহীদ), আবু তাহের মিয়া (পিতা হাজি আবুদল আলী, সোহাগপুর-বাহাদুরপুর, আশুগঞ্জ; বিটঘর যুদ্ধে শহীদ), সিরাজুল ইসলাম (পিতা মো. কালু মিয়া, কুট্টাপাড়া; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বড়হরণ এলাকায় শহীদ), মো. আশফাকুর রহমান খসরু (পিতা মাহমুদুল আমিন, শাহবাজপুর; সিলেটে শহীদ), রংগু মিয়া (পিতা আবদুল জলিল, শাহবাজপুর; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তালশহর রেলব্রিজের কাছে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর নিখোঁজ), জিল্লুর রহমান (পিতা মো. ধন মিয়া, ধামাউড়া, অরুয়াইল; তালশহরের কাছে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর নিখোঁজ), আলী আহমদ (পিতা আবদুল হামিদ, বাহাদুরপুর), মুহম্মদ হামদু মিয়া (পিতা আবদুল মন্নাফ, কুট্টাপাড়া; সিলেটের জয়ন্তা এলাকায় শহীদ), খোকন মিয়া (পিতা শাহাজাদা মিয়া, শাহবাজপুর; ক্ষমতাপুরে শত্রুর ওপর আক্রমণ চালাতে গিয়ে শহীদ), মো. হানিফ মিয়া (পিতা চান মিয়া, আইরল, নোয়াগাঁও; ঢাকার পিলখানায় শহীদ), তাজুল ইসলাম (পিতা গোলাম হোসেন, উচালিয়াপাড়া; বগুড়া সেনানিবাসে শহীদ), মো. ছায়েব আলী (পিতা মন্নর আলী, পাঠানপাড়া; পার্বতীপুরে শহীদ), সৈয়দ আফজাল হোসেন (পিতা সৈয়দ শোয়েব আলী, আলীনগর; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কুরুলিয়া খাল বধ্যভূমিতে শহীদ), আতিকুল হোসাইন ঠাকুর (পিতা তোফা মিয়া, সাগর দিঘি; কসবায় শহীদ), মো. জামাল মিয়া (পিতা নুরুল ইসলাম, অরুয়াইল), মো. রহিম মিয়া (পিতা মো. নুরুল ইসলাম, অরুয়াইল), মো. আহাম্মদ আলী (পিতা হাজি আমিন উদ্দিন, পাকশিমুল), বজলু মিয়া (পিতা আবদুল মন্নাফ, কুট্টাপাড়া) ও ছিদ্দিকুর রহমান (চান্দের পাড়া, নাসিরনগর থানা)।
সরাইল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সম্বলিত একটি বেদী তৈরি করা হয়েছে। সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম এমপিএ-এর নামে সরাইল অডিটরিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে। শহীদ আশরাফুল মতিন ও শহীদ খোকন মিয়ার নামে শাহবাজপুর ইউনিয়নে দুটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। [মানবর্দ্ধন পাল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!