মুক্তিযুদ্ধে সন্দ্বীপ উপজেলা (চট্টগ্রাম)
সন্দ্বীপ উপজেলা (চট্টগ্রাম) ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। এ উপজেলা দেশের মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন। এর উত্তরে নোয়াখালী জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই উপজেলা এবং পশ্চিমে নোয়াখালী সদর উপজেলা ও হাতিয়া দ্বীপ। রাজনৈতিক বিদ্রোহ-সংগ্রাম-অন্দোলনে সন্দ্বীপবাসী ইতিহাসের নানা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এখানে আবু তোরাবের নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়। পরে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সন্দ্বীপে আইন অমান্য আন্দোলন হয়। ষাটের দশকে এখানে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা আন্দোলনের পক্ষে প্রবল জনমত তৈরি হয়।
লপাকিস্তান আমলে সন্দ্বীপে প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী লীগ-এর শাখা কমিটি গঠন করা হয়। এখানে আওয়ামী লীগ গঠন ও বিকাশে যাঁরা অবদান রাখেন, তাঁরা হলেন- রিদওয়ানুল বারী, অধ্যাপক মুজিবুল হক, এস এম নুরুল হুদা মাস্টার, এল বি দোজা, ডা. এস এম ফজলুল হক, শফিকুর রহমান, গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, মো. শফিউল্লাহ, আমিনুর রহমান, হাসান দস্তগীর, সোলায়মান বাদশা, আতিকুল হক, ডা. আজিজউল্লাহ, হাফেজ মাওলানা আবদুল মালেক, হাফেজ আহমদ, ডা. এস এ বাতেন, মোদাচ্ছের আহমদ, দলিলুর রহমান, বজলুস সোবহান মোক্তার, আহমদ ফারুক, ওবায়দুল হক, রফিক মিয়া, এডভোকেট আহমদ মোস্তফা, ডা. সুলতান, জামাল আহমদ, আনোয়ার, আবদুর রহমান, ওয়াজিউল্লাহ, মৌ. সিরাজুল ইসলাম, মাওলানা সিরাজী ও হাজী আবদুল মান্নান। ১৯৭০ সালে থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে মুজিবুল হক ও গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী। কমিটিতে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন- ডাক্তার ফজলুল হক, আবদুর রব খদ্দর, রিদোয়ানুল বারি, আতিক উল্লাহ, মো. শাহ বাঙালি, জয়নাল আবেদীন চৌধুরী, বোরহান মিয়া, দবির চৌধুরী, ডা. জামশেদুর রহমান, সত্তার মাস্টার, নূরছফা সওদাগর, এ কে এম শাহজাহান, মাহবুব উকিল, আবুল খায়ের, মাহবুবুল হক মাধু, এন এম সেলিম, সেকু মিয়া, সেকান্দর হোসেন, এডভোকেট আনোয়ারুল কবির, বাকী মিয়া, আবদুল মান্নান লুঙ্গি, আবদুল মান্নান কন্ট্রাক্টর, মৌলভী ইলিয়াস, নূর হোসেন মাস্টার ও আমিনউল্লাহ। তখন আমিনউল্লাহ সমগ্র সন্দ্বীপ পায়ে হেঁটে রাস্তার মোড়ে মোড়ে চুঙ্গা ফুকিয়ে আওয়ামী লীগের প্রচারকার্য চালাতেন। এজন্য তাঁর সংক্ষিপ্ত নাম ছিল ‘চুঙ্গা আমীন’। সন্দ্বীপে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে এম এন সেলিম, রফিকুল ইসলাম, মো. আলী খসরু, আবুল কাসেম, বাবুল, মাহবুব, ইকবাল, রওশন, রফিক, আবু জাফর মাহমুদ, জগলু প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সন্দ্বীপে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং ন্যাপ (মোজাফ্ফর) এর সংগঠন ও কার্যক্রম ছিল। ন্যাপ (মোজাফ্ফর) এর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে এল বি দোজা ও সফিকুল মাওলা মানিক। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এম আর সিদ্দিকী এমএনএ এবং ওবায়দুল হক এমপিএ নির্বাচিত হন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি বিকেলে চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে ৬-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এটিই ছিল কোনো জনসভায় সর্বপ্রথম ৬-দফা দাবি পেশ। পরদিন ২৬শে ফেব্রুয়ারি তিনি সন্দ্বীপ যান। এ-সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী। সন্দ্বীপ টাউন সিও অফিস সংলগ্ন মাঠে বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬-দফা ঘোষণা ও ব্যাখ্যা করেন।
৭১-এর মার্চের শুরুতে সন্দ্বীপে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি ছিলেন যথাক্রমে মোদাচ্ছের আহমদ ও জাহিদুর রহিম মোক্তার। সদস্য ছিলেন গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, এম এন সেলিম, মো. শাহজাহান বিএ, ডাক্তার জামশেদ, আবদুর রব খদ্দর, মোহাম্মদ শাহ বাঙালি, নসু বাবু, অনাথবন্ধু দত্ত প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মো. শাজাহান (সন্দ্বীপ), গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী (হরিশপুর), দবির উদ্দিন চৌধুরী (কাঠগড়), বোরহান মিয়া (কাঠগড়), আজিজ ডাক্তার (সারিকাইত), আবদুল বাতেন (সারিকাইত), জামশেদ ডাক্তার (মুছাপুর), এম এন সেলিম, মো. আবুল কাসেম, রফিকুল ইসলাম, আবুল কালাম আজাদ, মো. আবু সুফিয়ান, মো. সাহাবউদ্দিন, শফিকুল আলম মানিক, আলী হোসেন প্রমুখ। মার্চে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে সন্দ্বীপের ছাত্র নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে সন্দ্বীপ থানা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সন্দ্বীপে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে। ছাত্রদের সমাবেশে পতাকা উত্তোলন করেন রফিকুল ইসলাম। প্রথমদিকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করতে বাউরিয়ার শাহজাহান বিএ, মগধারার শাহজাহান, সারিকাইতের শফিউল্লাহ, হরিশপুরের সুধাংশু লাল দাশ, মাইটভাঙ্গার আজিজুল্লাহ, হাফেজ, শামসুল আলম, খাদেম, জয়নাল চৌধুরীসহ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও সংগ্রাম পরিষদের নেতারা উদ্যোগ নেন।
এপ্রিল মাস থেকে শহরে অবস্থানরত সন্দ্বীপের যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে বিভিন্ন পথে ভারতে যাওয়া শুরু করেন। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা বিভিন্ন গ্রুপে সন্দ্বীপে ফিরে আসেন।
সন্দ্বীপের মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডাররা হলেন- রফিকুল ইসলাম (থানা কমান্ডার, বিএলএফ, বাটাজোড়া), শফিকুল আলম (থানা কমান্ডার, এফএফ, গাছুয়া), আবুল কাসেম (এফএফ, রহমতপুর), মো. রফিকুল ইসলাম (বাউরিয়া), ফিরোজুল ইসলাম (হারামিয়া), হাফিজ আহমদ (মাইটভাঙ্গা) ও খালেকুল বেলাল (বাউরিয়া)। গ্রুপ কমান্ডারগণ হলেন- এম এন সেলিম (এফএফ, দুবলাপাড়), তরিকুল ইসলাম বাবর (এফএফ, হরিশপুর), মো. ইয়াছিন (এফএফ, সিটি গ্রুপ, সারিকাইত), আলী হায়দার চৌধুরী (এফএফ, কাটগড়), আবু বক্কর সিদ্দিক (এফএফ, গাছুয়া), মইনুর রহমান (এফএফ, সিটি গ্রুপ, মুছাপুর), আবু হেলাল চৌধুরী (এফএফ, সিটি গ্রুপ, হরিশপুর), আবু সুফিয়ান বিএসসি (এফএফ, বাউরিয়া), হুমায়ুন কবির রেনু (এফএফ, গাছুয়া), মো. এস এম এমলাক (এফএফ, আজিমপুর), মো. আমিনুর রসুল (এফএফ, মঘাদীয়া) এবং আবদুল বায়েজ (এফএফ, সিটি গ্রুপ, মাইটভাঙ্গা)। বিএলএফ-এর কমান্ডাররা হলেন- রফিকুল ইসলাম, মাহবুবুল আলম, নাজমুল হোসেন, মৃণাল কান্তি নন্দী, শ্যামল কান্তি দাশ, আলী হায়দার চৌধুরী, কামাল উদ্দিন, মফিজুর রহমান, মো. বোরহান উদ্দিন, এ বি এম ছিদ্দিক আহমদ, মসিউল আলম জগলু এবং ফখরুল ইসলাম রোশর।
সন্দ্বীপের অনেক বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল ছিল। এর মধ্যে কয়েকটি হলো- সন্তোষপুরে মেজর শাহাবুদ্দিনের বাড়ি, মুছাপুরে কমান্ডার মাঈনুদের বাড়ি, কালাপানিয়ায় শশাংক তালুকদারের বাড়ি, সন্তোষপুরে আবদুর রশিদ তালুকদারের বাড়ি, দীঘাপাড়ায় আবদুল হক তালুকদারের বাড়ি, কালাপানিয়ায় অমলদের বাড়ি, ইজ্জতপুরে কমিউনিটি সেন্টার, শহরে বজলুর রহমান মোক্তারের বাড়ি, কন্ট্রাক্টর সেকান্দরের বাড়ি, আমিনুর রসুল, বাকি ও আবুল কাসেমের বাড়ি ইত্যাদি। ইজ্জতপুরের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। রিদওয়ানুল বারী সন্দ্বীপ থেকে ছাত্র-যুবকদের ভারতে পাঠাতেন। এছাড়া জামশেদ মিয়া ও আবদুর রহিম নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেন।
চট্টগ্রামের কালুঘাটে স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-এ সন্দ্বীপের কয়েকজন সাহসী মানুষ বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা হলেন- বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, সামসুল হুদা ও সফিউল্লাহ। বেলাল মোহাম্মদ ছিলেন ২৬শে মার্চ কালুরঘাট থেকে ট্রান্সমিশন কার্যক্রমের অন্যতম উদ্যোক্তা। এদিন দুপুরে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে কালুরঘাটে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের ট্রান্সমিশন সেন্টার প্রথম চালু করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়। সেদিন সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে বেতার কর্মীদের নিয়ে তিনি দ্বিতীয় অধিবেশন প্রচার করেন। সেই থেকে পেশাদার বেতার কর্মীদের দ্বারা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের নামে অধিবেশন প্রচারিত হতে থাকে। স্বল্প সময় স্থায়ী হলেও তখন এ বেতার কেন্দ্রটি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করে। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গৌরবময় ভূমিকা বেলাল মোহাম্মদকে অমর করে রেখেছে।
আবুল কাসেম সন্দ্বীপ ছিলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। তিনি ২৬শে মার্চ বেতার কেন্দ্রের নাম ঘোষণা করেন এভাবে, “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি’। তিনি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার অন্যতম প্রচারক। ২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা ওয়ারলেসের মাধ্যমে দেশের প্রায় সর্বত্র পৌঁছানো হয়। বেলাল মোহাম্মদ ও আবুল কাসেম সন্দ্বীপ উভয়ে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। সন্দ্বীপের আরেক সন্তান সামছুল হুদা রাজশাহী বেতার পরিত্যাগ করে মুর্শিদাবাদ হয়ে কলকাতা পৌঁছেন এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করেন। তিনি এ বেতার কেন্দ্রের প্রোগ্রাম অর্গানাইজার- ইনচার্জ এবং পরে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। সন্দ্বীপের সন্তান সফিউল্লাহ ‘মোহাম্মদ শাহ বাঙ্গালী’ নাম ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পুঁথি পাঠ করতেন। ৬৯ ও ৭০ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফরসঙ্গী হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত জনসভায় স্বরচিত গণসঙ্গীত পরিবেশন করে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রামের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপে পাকিস্তানি বাহিনী দুবার অনুপ্রবেশ করে। এপ্রিল মাসের প্রথমদিকে প্রথমবার তারা জ্বালাও-পোড়াও ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে সন্দ্বীপে ঢোকে। এপ্রিলের শেষের দিকে তারা দ্বিতীয়বার সন্দ্বীপে আসে। তবে পাকহানাদার বাহিনী স্থায়ীভাবে সন্দ্বীপে অবস্থান করেনি। রাজাকাররা উপজেলার হরিশপুর টিএন্ডটি অফিস, মাইটভাঙ্গা, হারামিয়া, গাছুয়া, দীর্ঘাপাড়, বাউরিয়া, বাটাজোড়া, সারিকাইত, কাটগড়, মগধরা, আমানউল্লা ইত্যাদি স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। এসব ক্যাম্প থেকে তারা মানুষের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়।
সন্দ্বীপের কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরোধীরা হলো- রাজাকার কমান্ডার মুন্সিয়া (হরিশপুর), কবির আহমদ (হরিশপুর), রফিকুল মওলা, রাজাকার কমান্ডার আমির খসরু, ওয়াহিদুর রহমান (হরিশপুর), হাফেজ আহমদ (রহমতপুর), আবদুল মান্নান (হরিশপুর), নূর উল্লাহ (হরিশপুর), ওয়াহেদুর রহমান (আজিমপুর), আবদুল বাতিন (রহমতপুর), নূরুল্লাহ (হরিশপুর), মান্নান আহমেদ (হরিশপুর), নুরুল ইসলাম (হরিশপুর), আবুল কাসেম (হরিশপুর), মো. হুমায়ুন (হরিশপুর), ছৈয়দুল হক (রহমতপুর), নূরুস সাফা (রহমতপুর), মোজাফ্ফর আহমদ (রহমতপুর), শফিকুল মোল্লা (রহমতপুর), আসাদুল হক (রহমতপুর), মোবাশ্বের আহমদ (বোরপুর), আবদুল মান্নান (আজিমপুর), মোহাম্মদ মোস্তফা (হরিশপুর), আবদুর রহিম (হরিশপুর), মো. সোলাইমান (হরিশপুর), আবদুল হাই (হরিশপুর), রফিকুল মওলা (রহমতপুর), মো. শাহজাহান (হরিশপুর), কবির আহমদ (হরিশপুর), রেজাউল করিম (রহমতপুর), আবদুল বাতেন (হরিশপুর), আফলাতুন (রহমতপুর), আবুল কালাম (রহমতপুর), আবদুল খায়ের ইসলাম (আজিমপুর), মঞ্জু আহমদ (হরিশপুর), আবুল কালাম আজাদ (রহমতপুর), সফিকুল আলম (রহমতপুর), আবুল কালাম (হরিশপুর), আবদুল বারেক (রহমতপুর), হাশমত মিয়া (রহমতপুর), ওজিরুল মিয়া (রহমতপুর), মোহাম্মদ ইদ্রিস (রহমতপুর), কামাল উদ্দিন (রহমতপুর), সাইদুল হক (সন্তোষপুর), রবিউল হক, আতিক উল্লা (সারিকাইত), সুফিয়ান (রহমতপুর), আবদুল হক (হরিশপুর), রফিকুল মওলা (রহমতপুর), শাহজাহান (হরিশপুর), কবির আহমদ (হরিশপুর), লিয়াকত আলী খান (রহমতপুর), ওয়াহিদুর রহমান (আজিমপুর), আবুল কালাম (রহমতপুর), আবুল কালাম আজাদ (রহমতপুর), শফিকুল ইসলাম (রহমতপুর), আবদুল বসাক (রহমতপুর), আবুল কালাম (হরিশপুর), হাসমত মিয়া (রহমতপুর), আজিমুল মিয়া (হরিশপুর), মোহাম্মদ ইদ্রিস (হরিশপুর), কামাল উদ্দিন (রহমতপুর), সাইদুল হক (সন্তোষপুর), রফিকুল হক (বাউরিয়া), আতিক উল্লাহ, মো. সুফিয়ান (রহমতপুর), আবদুল খালেক (আমানউল্লাহ), মোহাম্মদ সিদ্দিক (আজিমপুর), নূরুল ইসলাম (হরিশপুর), ওহিদুর রহমান (হরিশপুর), হুমায়ুন (হরিশপুর), সাইদুল হক (রহমতপুর), নুরুছ সাফা (রহমতপুর), মুজাফ্ফর আহমদ (রহমতপুর), শফিকুল মওলা (রহমতপুর), আসাদুল হক (রহমতপুর), মোবাশ্বের আহমদ. (বগুনা), আবদুল মান্নান (আজিমপুর), মোহাম্মদ মোস্তফা (হরিশপুর), আবদুর রহমান (হরিশপুর), আবদুল মান্নান (হরিশপুর), মোহাম্মদ সোলাইমান (হরিশপুর) প্ৰমুখ। উপর্যুক্ত স্বাধীনতাবিরোধীদের অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সন্দ্বীপে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এসে এক রাত অবস্থান করে। এ-সময় তারা চন্দ্র কুমার, আজিজুর রহমান মিয়া, জন পাল্কিবাহক ও ১ জন মহিলাকে হত্যা করে। তারা আওয়ামী লীগের নেতা ও সংগ্রাম কমিটির সেক্রেটারি জাহিদুর রহিম মোক্তারকে গুলি করে হত্যা করে কার্গিল সেতুর নিচে ফেলে দেয়। হানাদাররা সন্দ্বীপ থানা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিস জ্বালিয়ে দেয়। এপ্রিলের শেষের দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এক হিন্দু বাড়িতে হানা দিয়ে মেঘা ধোপা নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। এদিন তারা অনেক লোককে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে।
সন্দ্বীপের আরো যারা পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে প্রাণ হারান, তারা হলেন- মেজর ডা. আসাদুল হক, ওমর ফারুক, বেলায়েত হোসেন, ইউসুফ, মানিক, অনিল দাশ, জসিমউদ্দিন আহমদ ও শিবনাথ।
সন্দ্বীপের মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে বেশকিছু অপারেশন পরিচালনা করেন। হরিশপুরের রাজাকার মুন্সীয়াসহ কয়েকজন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। রাজাকার আজিজুর রহমান এক অপারেশনে নিহত হয়। এছাড়া কাটঘরের রাজাকার খসরু, হারামিয়ার রাজাকার সেলিম হায়দার ও আবুল কাসেমকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম, রফিক, আবদুল বাতেন, রফিকুল মাওলা প্রমুখের নেতৃত্বে ৩১শে আগস্ট মাইটভাঙ্গা পুলিশ ক্যাম্প আক্রমণ করা হয়। এর ফলে পুলিশ সদস্যরা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। হানাদার পাকসেনাদের বিরুদ্ধে গুপ্তছড়া ঘাটে কমান্ডার ফিরোজুল ইসলাম ফিরোজ ও তাঁর গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা একটি গানবোটে আক্রমণ করে তাদের বিতাড়িত করেন। আসার পথে বাড়বকুণ্ডে এ গ্রুপের সঙ্গে পাকসেনাদের পুনরায় যুদ্ধ হয়। ২৭শে নভেম্বর অনিল বরণ রায়ের নেতৃত্বে নৌকমান্ডোদের একটি দল সন্দ্বীপে কয়েকটি বাণিজ্যিক জাহাজ ও বার্জ ডুবিয়ে দেয়। এ অপারেশনে অনিল রায়ের সঙ্গে ছিলেন আবুল বাশার, এন আই চৌধুরী, ফখরুল ইসলাম, দেলোয়ার হোসেনসহ আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযোদ্ধারা হরিশপুর টিএন্ডটি অফিস, মাইটভাঙ্গা, হারামিয়া, গাছুয়া, দীর্ঘাপাড়, বাউরিয়া, বাটাজোড়া, সারিকাইত, কাটগড়, মগধরা, আমানউল্লা ইত্যাদি স্থানের রাজাকার ক্যাম্পগুলোর ওপর বিভিন্ন সময়ে অপারেশন পরিচালনা করেন।
বিভিন্ন রাজাকার ক্যাম্পে অপারেশনের পর মুক্তিযোদ্ধারা সন্দ্বীপ থানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু থানার ওপর পরিচালিত প্রথম দফার আক্রমণ সফল হয়নি। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক প্রস্তুতি নেন। কাটগড় স্কুল তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অলিখিত হেডকোয়ার্টার্স। এখানে সিদ্ধান্ত হয় যে, সন্দ্বীপ এলাকার সকল মুক্তিযোদ্ধাকে সম্পৃক্ত করে থানা আক্রমণ করা হবে। বিএলএফ-এর ১২ জনসহ মোট ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয় অপারেশনে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার রফিকুল ইসলাম। ১লা নভেম্বর দুপুরে কাটগড় গোলাম নবী হাইস্কুলে মিটিং করে অপারেশনের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা ৩টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রত্যেক গ্রুপের দায়িত্ব নির্ধারণ ও ৩টি স্পট চিহ্নিত করেন। প্রথম দুটি গ্রুপের লিডার ও ডেপুটি লিডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে রফিকুল ইসলাম, নাজমুল হোসেন ও এ বি এম ছিদ্দিকুর রহমান। তৃতীয় গ্রুপের লিডার ও ডেপুটি লিডার ছিলেন যথাক্রমে মাহাবুবুর রহমান ও ফখরুল ইসলাম। গোপন কোডওয়ার্ডসহ স্পট নির্ধারণ করা হয়। রাত ৯টায় অবিরাম বৃষ্টির মধ্যে ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা সন্দ্বীপ শহরের দিকে রওনা করেন। শহরের উত্তর পাশে খালেকের বাড়িতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তাঁরা আবার যাত্রা শুরু করেন। প্রথম গ্রুপ হালিম সেরাং-এর পেছনের পুকুরের পাড়ে, দ্বিতীয় গ্রুপ কারগিল হাইস্কুলের পশ্চিম পাশে বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতরে এবং তৃতীয় গ্রুপ থানার পূর্বপাশের এতিমখানায় অবস্থান নেয়। ঠিক হয় যে, দ্বিতীয় গ্রুপ তাদের অবস্থানে পৌঁছে আকাশে এক ট্রেসার রাউন্ড গুলি ছুড়বে। ট্রেসার রাউন্ড যখন ছোড়া হবে তখন তা আকাশে আলো ছড়াবে। আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে সব স্পট থেকে আক্রমণ শুরু হবে। পরিকল্পনামতো মুক্তিযোদ্ধারা থানা আক্রমণ করেন। আক্রান্ত হয়ে থানায় থাকা পুলিশ সদস্যরা পাল্টা আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ২য় গ্রুপের প্রচণ্ড আক্রমণে টিএন্ডটিতে অবস্থানরতরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তাদের হাত-পা বেঁধে এক কক্ষে আবদ্ধ করে রাখা হয়। তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত অস্ত্র ও অন্য সরঞ্জামাদি নিয়ে এ গ্রুপ পূর্ব নির্ধারিত স্থানের দিকে রওনা হয়। অন্যান্য গ্রুপের সঙ্গে তখনো যুদ্ধ চলছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় গ্রুপ ঐ দুই স্পটের যুদ্ধে যোগ দিতে পারেনি। অন্য দুই গ্রুপ থানার পুলিশদের সারেন্ডার করিয়ে সকলকে বেঁধে বাটাজোড়া কমিউনিটি সেন্টারে নিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা সন্দ্বীপ থানার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সন্দ্বীপে অবস্থান না করায় তাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়নি। ১১ নভেম্বর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- বেলায়েত হোসেন, বীর উত্তম (পিতা মাজেদ মিয়া, গাছুয়া; ১৪ই নভেম্বর সালদা নদী যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল হক, বীর বিক্রম (পিতা মোহাম্মদ সুকানী, মুছাপুর) ও মোহাম্মদ দিদারুল আলম, বীর প্রতীক (পিতা ফজলুল হক, মুছাপুর)। সন্দ্বীপের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন— শামসুল আলম (পিতা সিরাজুল হক, মুছাপুর পণ্ডিতের হাট)। [জামাল উদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড