You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্থানীয় বাহিনী ‘সবুর বাহিনী’ (চিতলমারী, বাগেরহাট)

সবুর বাহিনী (চিতলমারী, বাগেরহাট) খুলনা-বাগেরহাট এলাকার একটি স্থানীয় বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে এ বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। সবুর বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন এডভোকেট এস এম এ সবুর (পিতা শের আলী মোল্লা, আড়ুয়াবর্নি, চিতলমারী)। এস এম এ সবুর ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন- মতিয়া গ্রুপের অনুসারী ছিলেন। ১৯৬১- ৬২ শিক্ষাবর্ষে বাগেরহাট পি সি কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি জিএস নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৬২ সালে শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে বাগেরহাটে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
১৯৭১-এর ২৭শে মার্চ এস এম এ সবুর চিতলমারী উপজেলার বাবুগঞ্জ বাজারের বিমল বাবুর বাসায় বসে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থকদের নিয়ে একটি মুক্তিযুদ্ধ সেল গঠন করেন। সেলটির নেতৃত্বের বিন্যাস ছিল এরকম: এস এম এ সবুর- সভাপতি, এ বি এম রেজাউল করিম- সম্পাদক (দীঘিরজান, নাজিরপুর), কাজী সোহরাব হোসেন— সদস্য (হিজলা, চিতলমারী), ডা. মো. আলাউদ্দিন- সদস্য (মাহামুদকান্দা, নাজিরপুর) এবং এম এ রব- সদস্য (চরমাটিভাঙ্গা, নাজিরপুর)।
২৪শে এপ্রিল পাকবাহিনীর হাতে বাগেরহাট শহরের পতনের পর সবুর বাহিনী এ এলাকায় লুটতরাজ বন্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। জুলাইয়ের প্রথমদিকে সবুর বাহিনীর ২ শতাধিক তরুণ প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যায়। ভারতে এ বিশেষ বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ এবং ন্যাপ নেতা মোজাফফর আহমেদ। এ বাহিনীতে পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগর, বনগাঁ, টাকি, বালুরঘাট ও ত্রিপুরার আগরতলা রিক্রুটিং ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করা হতো। আসামের তেজপুরে ভৈরম মন্দিরের পাদদেশে ক্যাপ্টেন মুখার্জির তত্ত্বাবধানে এ বাহিনী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। গেরিলা বাহিনীর নেতৃত্বাধীনে বাংলাদেশের রণাঙ্গণকে পূর্বাঞ্চলের ৭টি এবং পশ্চিম অঞ্চলের ১১টি জেলা নিয়ে দুটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। পশ্চিমাঞ্চলের ১১টি জেলার অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ পান এস এম এ সবুর। খুলনা ও বরিশালের কমান্ডারের অতিরিক্ত দায়িত্বও তিনি পালন করেন।
এ বাহিনীর একটি অগ্রবর্তী দল বাংলাদেশে প্রবেশ করে পাকবাহিনীর মুখোমুখি হয় এবং এখানে এ কে আজাদসহ ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এরপর এস এম এ সবুর তাঁর বাহিনী নিয়ে ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ-মাদারীপুর-গৌরনদী-চিতলমারী- বাগেরহাটে পৌঁছান। তাঁরা বাগেরহাট টাউন স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ বাহিনীতে চিতলমারীর বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন- চাঁনমিয়া মোল্লা, শেখ আব্দুস সবুর বাচ্চু, এস এম রেজাউল করিম, খন্দকার আনোয়ার হোসেন, এ বি এম রেজাউল করিম (নাজিরপুর, ডেপুটি কমান্ডার, সবুর বাহিনী), জেন্নাত আলী, মীর শাজাহান আলী, শেখ আব্দুস সবুর, মনীন্দ্রনাথ বোস, গোপাল চন্দ্র বসু, রাধাবল্লভ সাহা, অসীম কুমার সাহা, সতীশ চন্দ্র মণ্ডল, আ. রব, জিতেন্দ্রনাথ মণ্ডল, এস এম মাকফার হোসেন, শেখ আলাউদ্দিন, শেখ আফজাল হোসেন, হুমায়ুন কবির, অনঙ্গ রায়, সোহরাব হোসেন প্রমুখ।
৩রা ডিসেম্বর এস এম এ সবুর খুলনা ও বরিশালে ৬ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মিত্রবাহিনী সহ আগরতলা হয়ে আখাউরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ঢাকা অবরোধে অংশ নেন।
১৬ই ডিসেম্বরের পর অস্ত্র জমাদানের জন্য বাগেরহাট পি সি কলেজ ময়দানে একটি মিলিশিয়া ক্যাম্প খোলা হয়। অস্ত্র জমাদানের শেষদিকে উত্তেজিত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ এ ক্যাম্প থেকে হাজার-হাজার অস্ত্র লুট করে গ্রামের দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তখনো সবুর বাহিনী অস্ত্র জমা দেয়নি। এ অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতির আশঙ্কা দেখা দিলে প্রশাসনের অনুরোধে সবুর বাহিনী ট্রেজারি, জেলখানা, পুলিশ স্টেশন, মনিগঞ্জ খেয়াঘাট এবং শহরের প্রতিটি বহির্গমন পয়েন্টে সশস্ত্র অবস্থান গ্রহণ করে। তাঁরা লুণ্ঠিত প্রায় এক হাজার অস্ত্র উদ্ধার করতে সক্ষম হন। সবুর বাহিনীর কারণে অস্ত্র লুণ্ঠনকারীরা শহরের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে মাইকে প্রচারিত আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা পি সি কলেজ মাঠে লুট করা অস্ত্র জমা দিতে বাধ্য হয়।
১৯৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারি স্বাধীনতা উদ্যানে সবুর বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে বাগেরহাট মহকুমা প্রশাসক ইউ সি সরকারের হাতে অস্ত্র সমর্পণ করে। এ অনুষ্ঠানে ৯নং সাব- সেক্টর কমান্ডার সামছুল আরেফিন, বাগেরহাট মহকুমা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক শেখ আ. রহমান এমপিএ, শেখ সাখাওয়াত হোসেন দারু, কেন্দ্রীয় ন্যাপ সহ- সভাপতি নীরদ বিহারী নাগ, বাগেরহাট মহকুমা ন্যাপ সভাপতি আতার উদ্দিন খানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। [মনীন্দ্র নাথ বোস]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!