You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.09 | সমাদ্দার ব্রিজ যুদ্ধ (মাদারীপুর সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

সমাদ্দার ব্রিজ যুদ্ধ (মাদারীপুর সদর)

সমাদ্দার ব্রিজ যুদ্ধ (মাদারীপুর সদর) সংঘটিত হয় ৯ই ডিসেম্বর। মাদারীপুর-টেকেরহাট সড়কে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে এ-যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মাদারীপুর এলাকা হানাদারমুক্ত করার ক্ষেত্রে এ-যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে মাদারীপুর মহকুমার একাধিক থানা শত্রুমুক্ত হয়। হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান মাদারীপুর মহকুমা শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা মাদারীপুর শহরকে হানাদারমুক্ত করার জন্য চারপাশ ঘিরে একযোগে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পরিকল্পনা মাফিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার প্রাক্কালে ৮ই ডিসেম্বর ভোররাতে সড়কপথে হানাদার বাহিনী মাদারীপুর ছেড়ে ফরিদপুরের দিকে গাড়ি বহর নিয়ে অগ্রসর হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এ খবর পৌঁছে গেলে তাঁরা খলিলুর রহমান খানের নেতৃত্বে দ্রুত সমাদ্দার ব্রিজে মাইন পুঁতে রাখেন। মুক্তিযোদ্ধারা ঘটকচর ব্রিজের পর থেকে সমাদ্দার ব্রিজ পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তার দুপাশে পরিখা খুঁড়ে এম্বুশ করেন। ৮টি সামরিক বাস, ট্রাক ও জিপে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা, আলবদর ও মুজাহিদ মাদারীপুর শহর ছেড়ে ফরিদপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ঘটকচর ব্রিজ পার হয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ামাত্র পেছন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ শুরু হয়। আক্রান্ত হয়ে পলায়নরত শত্রুসৈন্যরা গাড়ি থেকে নেমে মার্চ করে সমাদ্দার ব্রিজের দিকে ছুটতে থাকে। সমাদ্দার ব্রিজে হানাদারদের গাড়িবহর ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে মাইন বিস্ফোরিত হয়। নিমিষে ব্রিজ ধ্বসে পড়ে। চারদিক থেকে একযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেল, এলএমজি ও মর্টারের গুলি ও শেল বর্ষিত হতে থাকে। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও পাকিস্তানি সেনারা ব্রিজের দুই পারের পুরনো বাংকারে আশ্রয় নিয়ে পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকলে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়৷ ৯ই ডিসেম্বর সারাদিন ও রাত বিরতিহীন যুদ্ধ চলে। সমাদ্দার ব্রিজে মাইন বিস্ফোরিত হলেও পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন সাঈদের নেতৃত্বে কিছু সৈন্য ব্রিজ পার হয়ে ওপারে চলে যেতে সক্ষম হয়। মেজর আব্দুল হামিদ খান খটক এপারে বাংকারে আশ্রয় নেয়। ১০ই ডিসেম্বর সকালে পাকিস্তানি সেনারা সাদা রুমাল ওড়ালে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি বন্ধ করে তাদের আত্মসমর্পণের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। পাকিস্তানি সেনারা তখন ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় ক্লান্ত ছিল। আত্মসমর্পণের আভাস দিয়ে তারা বাংকার থেকে বেরিয়ে সমাদ্দার খালে নেমে পানি পান করে। গাড়িতে রাখা শুকনো খাবার খায়। তারপর হঠাৎ গুলির পেটি নিয়ে বাংকারে নেমে পুনরায় গোলাগুলি শুরু করে। আসলে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি গ্রহণের নামে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ধোঁকা দেয়। কিন্তু খাদ্য ও গোলাবারুদের মজুত ফুরিয়ে এলে ১০ই ডিসেম্বর সন্ধ্যার আগে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি মেজর আবদুল হামিদ খান খটক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খলিলুর রহমান খানের হাতে কোমরের বেল্ট ও সাদাবাটের পিস্তল তুলে দিয়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। তখন রক্ত ও কাদায় মাখামাখি অবস্থায় বাংকারে পাকিস্তানি সেনাদের ৩৮টি লাশ পড়ে ছিল। তাদের অনেকেই নিহত হয় হাফপ্যান্ট পরা দুঃসাহসিক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ার হোসেন বাচ্চুর নিক্ষিপ্ত গ্রেনেডে। সে ক্রলিং করে শত্রুর বাংকারের কাছাকাছি গিয়ে অনেক গ্রেনেড ছুড়েছিল। তার নিক্ষিপ্ত গ্রেনেডে কাবু হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ১০ই ডিসেম্বর সকাল ১১টার দিকে দুভাগ্যজনকভাবে শত্রুর একটি বুলেট কেড়ে নেয় কিশোর মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চুর প্রাণ। আখতার নামে আরেক মুক্তিযোদ্ধা পেটে গুলি লেগে আহত হন। ১০ই ডিসেম্বর সমাদ্দার ব্রিজের যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে মাদারীপুর মহকুমা সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়।
সমাদ্দার ব্রিজ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন খলিল বাহিনীর প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান খান। তাঁর সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে সক্রিয় ছিলেন মাদারীপুর সদর থানার ৮নং সেক্টর কর্তৃক নিযুক্ত থানা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মতিয়ার রহমান হাওলাদার, ১নং এরিয়া কমান্ডার আলমগীর হোসাইন, কালকিনি থানার কমান্ডার এম এ রহমান, আবদুল হাকিম তালুকদার, আবদুর রহিম মিয়া, এসকান্দার আলী শিকদার, গিয়াস উদ্দিন হাওলাদার, পালং থানার আবুল কাসেম, শিবচর থানার মো. সাজাহান মিয়া (পিতা হাজী সামসুদ্দিন মুন্সি, গুয়াগাছিয়া; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক) প্রমুখসহ প্রায় এক হাজার মুক্তিযোদ্ধা। রাজৈর থানার কমান্ডার এম এ কাদের মোল্লা এবং আবদুল কাইয়ুম মীর টেকেরহাটের ঘাঁটি থেকে পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের পিছু ধাওয়া করে ছাগলছিড়া নামক স্থানে আত্মসমর্পণে বাধ্য করান। সমাদ্দার ব্রিজে যখন তুমুল যুদ্ধ চলছিল, তখন খোয়াজপুরে অবস্থিত শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন মুজিব বাহিনী ও অন্য মুক্তিযোদ্ধারা মাদারীপুর শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে
পলায়নপর রাজাকারদের গ্রেফতার ও তাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র সংগ্রহ করেন। সমাদ্দার ব্রিজে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাদ্য সরবরাহ ও প্রেরণের দায়িত্ব তাঁরা পালন করেন।
দিগনগর ফেরিঘাটের যুদ্ধ এবং সমাদ্দার ব্রিজের যুদ্ধের ফলে বরিশাল থেকে ফরিদপুরের দিকে অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি সেনারা গৌরনদীতে আটকে পড়ে। তারা পরে গৌরনদী কলেজে ভারী অস্ত্র ও প্রচুর রসদসহ ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। সমাদ্দার ব্রিজ যুদ্ধ সংলগ্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। [বেনজীর আহম্মদ টিপু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড