মুক্তিযুদ্ধে সখিপুর উপজেলা (টাঙ্গাইল)
সখিপুর উপজেলা (টাঙ্গাইল) ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর সমগ্র দেশের মতো সখিপুরের জনগণও স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। তাদের এই উদ্দীপনে শক্তি পেয়ে সখিপুরের নেতৃবৃন্দ শওকত মোমেন শাহজাহানের (কোম্পানি কমান্ডার ও জাতীয় সংসদ সদস্য) নেতৃত্বে গঠন করেন সখিপুর সংগ্রাম পরিষদ। পরিষদের উল্লেখযোগ্য অন্য নেতারা ছিলেন আবদুল আউয়াল সিদ্দিকী, আলী আজগর, মকবুল হোসেন খোকা, জয়নাল আবেদীন প্রমুখ। এঁরা মিলে স্থানীয় পর্যায়ে স্বাধীনতার সংগ্রামকে বেগবান করে তোলেন এবং এঁদের উৎসাহ ও নেতৃত্বে সখিপুরের ছাত্র-জনতা আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে সংকল্পবদ্ধ হয়।
মার্চের মাঝামাঝি সময়ে শওকত মোমেন শাহজাহান সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শক্রমে আন্দি গ্রামের পশ্চিম পাশে শালবনে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ কেন্দ্ৰ স্থাপন করেন। স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতা উৎসাহের সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। প্রশিক্ষণ চলে ২০শে এপ্রিল পর্যন্ত। এর আগে ৩রা এপ্রিল সখিপুরের বাঘেরবাড়ির পাশে মরিচাতে আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ক্যাম্প স্থাপন করেন। ১০ই জুন তিনি সখিপুরের বহেড়াতৈল এ নিজের গঠিত কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের শপথ পড়ান। তাঁর নির্দেশে সখিপুরের বড়চওনাতেও কমান্ডার ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ চলে। এক পর্যায়ে কাদের সিদ্দিকীর আহবানে শওকত মোমেন শাহজাহান তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সখিপুর ছিল নিরাপদ এলাকা। তাই কাদের সিদ্দিকী সখিপুরের মহানন্দপুরে স্থাপন করেন কাদেরিয়া বাহিনীর সদর দফতর।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সখিপুরে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন শওকত মোমেন শাহজাহান, মো. হামিদুল হক, বীর প্রতীক (কচুয়া), কোম্পানি কমান্ডার লোকমান হোসেন (বেতুয়া), কোম্পানি কমান্ডার ইদ্রিস আলী (বড়চওনা), কোম্পানি কমান্ডার মকবুল হোসেন খোকা (সানবান্দা), কোম্পানি কমান্ডার আবদুল হালিম (সখিপুর), কোম্পানি কমান্ডার খলিলুর রহমান (সাড়াসিয়া), শেখ হাবিবুর রহমান হাবিব, মো. আমজাদ হোসেন (সখিপুর), আবদুর রাকিব মিয়া (শোলাপ্রতিমা), মোহাম্মদ ওসমান গণি মিয়া (গরগোবিন্দপুর) প্রমুখ।
১লা জুলাই সকালে বংশাই নদীর পশ্চিম পাড়ে বাসাইলের কাউলজানী থেকে সাতটি নৌকাযোগে পাকবাহিনী সখিপুরের কালিয়ান গ্রামের দিকে আসতে থাকলে কাদেরিয়া বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার খন্দকার মুসার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বাধা দেন। উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী কালিয়ান গ্রামে ঢুকে কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা করে বাসাইল ফিরে যায়।
সখিপুরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের মধ্যে ইব্রাহিম তালুকদার (বৈলারপুর), মাওলানা বরকত উল্লাহ (চকপাড়া, বহরমপুর) ও হতেয়ার আবদুল হাই সালাফির নাম উল্লেখযোগ্য।
পাকবাহিনী সখিপুর উপজেলায় শুধু কালিয়ান গ্রামেই একবার প্রবেশ করে এবং অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা চালায়। কালিয়ান গণহত্যায় ১৮ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। এ উপজেলায় একটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে কুতুবপুর গণকবর।
সখিপুর উপজেলায় কাদেরিয়া বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখে। এর প্রধান ছিলেন আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম।
সখিপুরে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি যুদ্ধ হয়। প্রথম যুদ্ধ হয় ৪ঠা মে বইলানপুরে। ১৯শে এপ্রিল কালিহাতীর যুদ্ধে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর পাকবাহিনী সখিপুরের পাহাড়ি এলাকায় কাদের সিদ্দিকী ও মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটির সন্ধান নিতে পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশ দেয়। এ নির্দেশ পেয়ে গোপালপুর সার্কেল পুলিশ ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে গোপালপুর, মধুপুর ও ঘাটাইল থানার পুলিশ বইলানপুরে এসে জোরপূর্বক ইব্রাহিম মেম্বারের বাড়িতে দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি নেয়। এ খবর পেয়ে কাদের সিদ্দিকীর নির্দেশে কমান্ডার আব্দুল খালেক প্রমুখের নেতৃত্বে প্রায় একশ মুক্তিযোদ্ধার একটি দল তিনদিক থেকে তাদের আক্রমণ করে। অতর্কিত এ আক্রমণের কারণে কোনোরূপ প্রতিরোধ না করেই পুলিশ বাহিনী পলায়ন করে। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধারা ১৩ জনকে আটক করেন এবং ২০টি রাইফেল ও ২০০০ গুলি উদ্ধার করেন।
দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় কচুয়ায় জুন মাসে। কামালপুরের যুদ্ধে ছত্রভঙ্গ পাকবাহিনীর তিনজন সেনা কচুয়ার নির্জন স্থানে আশ্রয় নিলে প্লাটুন কমান্ডার স্বপন কুমারের নেতৃত্বে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা তাদের অবরোধ করেন। তারা কোনোরূপ প্রতিরোধ না করেই আত্মসমর্পণ করে। বন্দি অবস্থায় তাদের মহানন্দপুর সদর দফতরে নিয়ে আসা হয় এবং তাদের কাছ থেকে বেশকিছু অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই সখিপুর ছিল মুক্তাঞ্চল।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুর রকিব মিয়া, বীর বিক্রম (পিতা হাতেম আলী মুন্সী, শোলাপ্রতিমা) ও মো. হামিদুল হক, বীর প্রতীক (পিতা মোহাম্মদ হাকিমুদ্দিন, সখিপুর)।
সখিপুর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুর রকিব মিয়া (২৫শে অক্টোবর নৌকমান্ডো অপারেশনে শহীদ), শামছুল হক (পিতা আবদুল লতিফ শিকদার, দামিয়া), মোশারফ হোসেন (পিতা এস এম মফিজ উদ্দিন, গোহাইলবাড়ী), আব্দুল আজিজ (পিতা আবদুল করিম সরকার, গোহাইলবাড়ী), নুরুল হক মিয়া (পিতা কোমেজ সরকার, দাড়িয়াপুর; পুলিশ সদস্য), ইদ্রিস আলী (পিতা ফয়েজ উদ্দিন, কুতুবপুর), জোনাব আলী, (পিতা জংশের আলী, আমতৈল), মোশারফ বিল্লাহ (পিতা আবদুর রশিদ মিয়া, নলুয়া), শরাফত আলী (পিতা আশ্রাব আলী, নিশ্চিন্তপুর), আব্দুল কাশেম (পিতা ওহাদ আলী, নিশ্চিন্তপুর), সাদেক আলী (পিতা আব্বাস আলী, নিশ্চিন্তপুর), আবদুল কদ্দুস (পিতা আমোদ আলী, কালিয়া আড়াইপাড়া), সাবদুল (পিতা সোনাউল্লাহ মিয়া, কালমেঘা) এবং আবদুল খালেক (কৈয়ামধু)।
সখিপুর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিরক্ষার্থে গৃহীত উদ্যোগসমূহ হলো- বহেড়াতৈল স্মৃতিস্তম্ভ, কোকিলা পাবর স্মৃতিসৌধ (সখিপুর), মুক্তিযোদ্ধা গোলাম সারোয়ার সড়ক (কুতুবপুর-চরিবাইদ), মুজিব কলেজ (সখিপুর), শহীদ রকিব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় (বংকী, শোলাপ্রতিমা) এবং ইদ্রিস কমান্ডার স্মৃতি পাঠাগার (বড়চওনা)। [মোজাম্মেল হক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড