You dont have javascript enabled! Please enable it! সত্তরের নির্বাচন - সংগ্রামের নোটবুক

সত্তরের নির্বাচন

সত্তরের নির্বাচন ছিল অবিভক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন। ৭ই ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ এবং ১৭ই ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় (প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সমুদ্র উপকূলবর্তী পূর্ব বাংলার দক্ষিণ অঞ্চলে উভয় পরিষদের কতিপয় আসনে ১৭ই জানুয়ারি ১৯৭১ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়)। নির্বাচনের ফলাফল ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের পরিচয়বাহী। এ নির্বাচন পাকিস্তানের দুই অংশকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করায়, সৃষ্টি হয় এক ক্রান্তিকাল।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ জেনারেল আইয়ুব খানের পতন ও তার এক দশকের শাসনের অবসান ঘটে। ২৫শে মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান নতুন শাসক হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি দেশে সামরিক আইন জারি করেন, ১৯৬২ সালে আইয়ুব প্রণীত সংবিধান এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদ বাতিল ঘোষণা করেন। জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে তিনি যথাশীঘ্র সম্ভব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের অঙ্গীকার করেন। ১৯৭০ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক কার্যকলাপের ওপর বিধি-নিষেধ তুলে নেয়া হয়। ১লা মার্চ এক আদেশবলে এক ইউনিট ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্বের প্রদেশগুলোকে পুনরুজ্জীবীত করেন। সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি ৩০শে মার্চ কতিপয় শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপসহ একটি আইনগত কাঠামো আদেশ ‘এলএফও’ (Legal Framework Order) জারি করেন। এর প্রধান দিকসমূহ ছিল এরূপ- (এক) সর্বজনীন ভোটাধিকার, (দুই) ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতি, (তিন) জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা ৩১৩ নির্ধারণ (এলাকা ভিত্তিক ৩০০ এবং মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১৩টি আসন), (চার) জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রদেশসমূহের মধ্যে আসন বণ্টন (পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মোট আসন ১৬৯টি – ১৬২টি এলাকা ভিত্তিক ও ৭টি মহিলা), (পাঁচ) ১২০ দিনের মধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হলে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জাতীয় পরিষদ ভেঙ্গে দেয়া এবং নতুন নির্বাচনের আয়োজন, এবং (ছয়) জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা প্রণীত সংবিধান প্রেসিডেন্ট কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা। লক্ষণীয় যে, আইনগত কাঠামো আদেশে কার্যত প্রেসিডেন্টের হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা ন্যস্ত রাখা হয়, যা রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ কর্তৃক তীব্রভাবে সমালোচনার সম্মুখীন হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলসমূহ হচ্ছে— আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিন্যাপ (ওয়ালী খান), মুসলিম লীগ-এর বিভিন্ন গ্রুপ, জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামা-ই-ইসলাম, জমিয়তে উলামা-ই-পাকিস্তান, নেজামে ইসলামী, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) ইত্যাদি। এর মধ্যে প্রধান দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দল হচ্ছে পূর্ব বাংলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পাটি। নির্বাচনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, কোনো রাজনৈতিক দলই সমগ্র পাকিস্তানে এলাকাভিত্তিক ৩০০ আসনের সবকটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম হয়নি।
উপরন্তু, পূর্ব বাংলার এক সময়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ‘ভোটে মুক্তি আসবে না’ এবং ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ স্লোগান তুলে নির্বাচন বয়কট করে। রাজনৈতিক দলের বাইরে নির্বাচনে বেশ কয়েকজন নির্দলীয় প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইস্যু ছিল বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ ৬-দফা। নির্বাচনী প্রতীক ছিল নৌকা। ২৮শে অক্টোবর রেডিও-টেলিভিশনে নির্বাচনী ভাষণে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ নির্বাচনকে ছয়দফা কর্মসূচি-র ওপর গণভোট বলে আখ্যায়িত করেন। পূর্ব বাংলার ওপর দুই দশকের অধিক সময় ধরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-বঞ্চনা, আঞ্চলিক বৈষম্য, ১২ই নভেম্বর (১৯৭০) পূর্ব বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের সময় কেন্দ্রীয় সরকারের ঔদাসীন্য ইত্যাদি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারে গুরুত্ব পায়। অপর দিকে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির নিবাচনী স্লোগান ছিল ‘ইসলাম আমাদের বিশ্বাস, গণতন্ত্র আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সমাজতন্ত্র আমাদের অর্থনীতি’। পিপলস পার্টির প্রচারণার মূল বিষয়বস্তু ছিল ‘শক্তিশালী কেন্দ্র,’ ‘ইসলামি সমাজতন্ত্র’ এবং অব্যাহত ভারত বিরোধিতা। এছাড়াও মুসলিম লীগ ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দল বা গ্রুপ পাকিস্তান পিপলস পার্টির অনুরূপ ইসলামি সংবিধান, শক্তিশালী কেন্দ্র এবং ভারত বিরোধিতার ওপর তাদের নির্বাচনী প্রচারে গুরুত্বারোপ করে। বস্তুত ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রূপ নেয়।
আওয়ামী লীগের প্রধান নির্বাচনী কৌশল ছিল দেশব্যাপী বড়বড় জনসভা অনুষ্ঠান। ঐসব জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৬-দফা কর্মসূচিভিত্তিক বাঙালির জাতীয় মুক্তির ওপর গুরুত্বারোপ করে বক্তব্য রাখেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে লক্ষ-লক্ষ পোস্টার, লিফলেট ও পুস্তিকা ছাপিয়ে তাতে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে আঞ্চলিক বৈষম্যের ক্ষতিয়ান তুলে ধরা হয়। এ ক্ষেত্রে ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ নামে সারা পূর্ব বাংলার সর্বত্র প্রচারিত প্রচারপত্রটি (পোস্টার) ছিল খুবই কার্যকর। আওয়ামী লীগের প্রচার কার্যে ছাত্র ও যুবশক্তির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলার জন্য সংরক্ষিত ১৬২টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন এবং প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৭২.৫৭ ভোট লাভ করে। বাকি দুটি আসনের একটিতে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রধান নুরুল আমিন এবং অপরটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজা ত্রিদিব রায় নির্বাচিত হন। জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলার জন্য সংরক্ষিত ৭টি নারী আসনের মধ্যে সবকটিতে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে এবং এ নিয়ে পূর্ব বাংলার জন্য সংরক্ষিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৭টি।
পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তাতে মোট ৩০০টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টি আসন
এবং প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৮৯ ভাগ ভোট লাভ করে। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১০টি আসনের সবকটিতে আওয়ামী লীগ জয়যুক্ত হয়। ফলে প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৮টি। প্রাদেশিক পরিষদের ১২টি এলাকাভিত্তিক আসন (যা আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়)-এর মধ্যে ৯টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী, ২টিতে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং ১টিতে জামায়াতে ইসলামী জয় লাভ করে।
নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের জন্য বরাদ্দকৃত ১৩৮টি এলকাভিত্তিক আসনের মধ্যে ভুট্টোর পিপলস পার্টি ৮১টি আসন ও প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৪২.২ ভাগ ভোট লাভ করে। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৬টি আসনের মধ্যে পিপলস পার্টি ৫টি এবং ন্যাপ (ওয়ালী খান) ১টিতে জয়ী হয়। মহিলা আসন নিয়ে পিপলস পার্টির মোট আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৮টি। পশ্চিম পাকিস্তানের বাকি ৫৫টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ (কাইউম) ৯টি, মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) ৭টি, জমিয়তে উলামা-ই-ইসলাম ৭টি, জমিয়তে উলামা-ই-পাকিস্তান ৭টি, ন্যাপ (ওয়ালী খান) ৬টি, জামায়াতে ইসলামী ৪টি, মুসলিম লীগ (কনভেনশন) ২টি এবং নির্দলীয় প্রার্থীরা ১৩টিতে জয়যুক্ত হয়।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। অন্যদিকে ৮৮টি আসন পেয়ে ভুট্টোর পিপলস পার্টি দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের স্থান লাভ করে। নির্বাচনের ফলাফলে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রধান দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের কোনোটি দেশের উভয় অংশে আসন লাভ করতে সক্ষম হয়নি। নির্বাচনী রায় পাকিস্তানের দুই পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান অংশকে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে নিয়ে যায় এবং পাকিস্তানের ভাঙ্গন ত্বরান্বিত করে। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের পরপর ৯ই ডিসেম্বর লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্য টাইমস পত্রিকার সম্পাদকীয় শিরোনাম ছিল, ‘The first and perhaps last election’I
নির্বাচনে ৬-দফার পক্ষে বাঙালিদের গণরায় বা ম্যান্ডেট বাঙালির জাতীয় মুক্তির পথকে সুগম করে। এর ফলে বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের স্বীকৃত একমাত্র মুখপত্র হিসেবে আবিভূর্ত হন। মেজরিটি পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে জেনারেল ইয়াহিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক জান্তার ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ বঙ্গবন্ধুকে তাঁর স্বাধীনতার লালিত স্বপ্ন পূরণের সুযোগ এনে দেয়। ২৫শে মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট- নামে গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়লে তা পাকিস্তানের ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: হারুন-অর-রশিদ, বাংলাদেশ : রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন, ১৭৫৭-২০১৮, ঢাকা, অন্য প্রকাশ ২০১৮

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড