You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে সদরপুর উপজেলা (ফরিদপুর)

সদরপুর উপজেলা (ফরিদপুর) ফরিদপুর জেলা সদর থেকে সদরপুর উপজেলার দূরত্ব প্রায় ২৭ কিলোমিটার। পদ্মানদীর পাড়ঘেঁষা এ এলাকার মানুষ পাকিস্তান আমলের শুরু থেকেই রাজনৈতিক নানা ঘটনাপ্রবাহে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত রাখে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তারা প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ- প্রার্থী মোশাররফ হোসেনকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে। এরপর ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণের পর থেকে তারা স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয় এবং আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যে নিজেদের প্রস্তুত করে।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মোশাররফ হোসেন এমপিএ-কে আহ্বায়ক করে সদরপুরে মুক্তিসংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের আব্দুস সালাম, শাহজাহান তালুকদার, গণেশ চন্দ্র সরকার, আব্দুস সাত্তার খান, প্লাটুন কমান্ডার শাহজাহান মিয়া (তালুকদার), ইউসুব আলী হাওলাদার (গ্রুপ কমান্ডার), জালাল উদ্দিন আহমেদ, দেলোয়ার হোসেন, আব্দুল হক শিকদার, জমসের খান, বজলুর রশিদ ব্যাপারী, ওয়াজেদ আলী মিয়া, মীর নান্নু, গঞ্জর আলী মোল্লা, জালাল মিয়া (গ্রুপ কমান্ডার), মো. ফজলুল হক (গ্রুপ কমান্ডার), মজিবর, নান্নু প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। থানা মুক্তিসংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি ইউনিয়ন পর্যায়েও অনুরূপ কমিটি গঠন করা হয়। মুক্তিসংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ সদরপুর থানা সদর ও গ্রামে-গঞ্জে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেন। একই সঙ্গে সদরপুর থানার ব্রাহ্মন্দী হাইস্কুল, চর নাসিরপুর হাইস্কুল, আমিরাবাদ হাইস্কুল ও ভাষানচরের জামতলায় ছাত্র-যুবকদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। জালাল উদ্দিন আহমেদ, বজলু হাওলাদার, নূরুল হুদা, শাহজাহান তালুকদার, নাজমুল কবির মনির (গ্রুপ কমান্ডার), প্রমুখ এসব প্রশিক্ষণকেন্দ্রে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জামতলা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে ছিলেন আব্দুস সালাম।
২৫শে মে পাকবাহিনী সদরপুরে অনুপ্রবেশ করলেও তারা এখানে কোনো ক্যাম্প স্থাপন করেনি। তবে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই আটরশি পীরের জামাতা আদেল উদ্দিন হাওলাদারের নেতৃত্বে আটরশি বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে রাজাকাররা একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। ফরিদপুর থেকে পাকবাহিনী নিয়মিত এ ক্যাম্পে আসা-যাওয়া করত।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই কনভেনশন মুসলিম লীগ নেতা আদেল উদ্দিন হাওয়ালাদারকে আহ্বায়ক করে সদরপুর থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির নেতা, আলবদর ও রাজাকারদের মধ্যে সাহাবুদ্দিন খান (আটরশি, আলবদর প্রধান), জালাল উদ্দীন হাওলাদার (চরব্রাহ্মন্দী), আব্দুল জলিল খান (সদরপুর, আটরশি ক্যাম্প কমান্ডার), আব্দুস সালাম (সদরপুর), শামসুদ্দিন (সদরপুর), আব্দুর রশিদ (সদরপুর), আবু তালেব মৃধা (সদরপুর), রাজা আসাদুল হক (সদরপুর), ছাত্তার জঙ্গি (চর নাসিরপুর), মোহাম্মদ খান (চর নাসিরপুর), আব্দুর রশিদ ব্যাপারী (চর নাসিরপুর), কাজী শফিউদ্দিন (চর নাসিরপুর), আইনুদ্দিন ফকির (ঢেউখালী), আব্দুল খালেক দালাল (ঢেউখালী), ছায়ের উদ্দিন ব্যাপারী (ঢেউখালী), মনির উদ্দিন শিকদার (নারিকেলবাড়ি), মোহাম্মদ আলী আকন (নারিকেলবাড়ি), নূর উদ্দিন সরকার (নারিকেলবাড়ি), কোরান মোল্লা (নারিকেলবাড়ি), মো. ইসমাইল (চর বিষ্ণুপুর), আব্দুল মজিদ প্রামাণিক (চর বিষ্ণুপুর), জসিম খান (চর বিষ্ণুপুর), আমীন উদ্দিন খান (বাবুরচর), মাঈনুদ্দীন খান (বাবুরচর), আব্দুল গফুর হাওলাদার (চরডুবাইল, ঢেউখালী), নুরুল হক চৌধুরী (আকটেরচর), আলাউদ্দিন ফকির (কৃষ্ণপুর), আবুল কাসেম মুন্সী (দশহাজার) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সাঁথিয়া উপজেলা পাকবাহিনী এবং তাদের দোসর শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকার বাহিনী সদরপুর উপজেলার হাটকৃষ্ণপুর, চৌদ্দরশি, আটরশি, কালিখোলা প্রভৃতি গ্রামে হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা হাটকৃষ্ণপুরে ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনা হাটকৃষ্ণপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। সাহাবুদ্দিন খানের নেতৃত্বে রাজাকাররা আটরশির জগদীশ চন্দ্র ভূঁইয়া, কালিপদ সরকার ও বিষ্ণু কুমার বণিককে গুলি করে হত্যা করে।
পাকসেনারা সদরপুর উপজেলার পূর্ব শ্যামপুর গ্রামের আছিয়া বেগম, আমেনা বেগম, কান্দির ফুলি ও কাজী গ্রামের হাসিনা বেগমকে বাড়ি থেকে ফরিদপুর ক্যাম্পে ধরে নিয়ে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এতে আছিয়া বেগমের মৃত্যু হয়। রাজাকারদের সহযোগিতায় চরমানাইর ইউনিয়নের কয়েকটি বাড়িতে তারা অগ্নিসংযোগ করে। আটরশির বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পে বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে যুবকদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো এবং অনেককে গুলি করে হত্যা করে তাদের লাশ কৃষ্ণপুর বাজারের কাছে মাটিচাপা দেয়া হতো। সদরপুর উপজেলার জামতলা গ্রামে মুক্তিবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। আগস্ট মাসের শেষদিকে রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনী জামতলা ক্যাম্প আক্রমণের জন্য অগ্রসর হলে কমান্ডার জালাল উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধরা তাদের বাধা দেয়। দুঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পর রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনী পিছু হটে। এ-যুদ্ধে চর বিষ্ণুপুরের রাজাকার জসিম খান গুলিবিদ্ধ হয়। ১৪ই ডিসেম্বর সদরপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
সদরপুর উপজেলার চারজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা গেছে। তাঁরা হলেন- খবির উদ্দিন মাতব্বর (পিতা গোলাম মাতব্বর, কৃষ্ণপুর; কুমিল্লায় সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), দেলোয়ার হোসেন (পিতা মৌলবী সুলতান উদ্দিন, ঢেউখালী; ২৪শে নভেম্বর শিবচর থানা আক্রমণে শহীদ), মোশাররফ হোসেন (পিতা দলিল উদ্দিন খান, ঢেউখালী; ২৪শে নভেম্বর শিবচর থানা আক্রমণে শহীদ) এবং আরশাদ আলী খান (পিতা গঞ্জর আলী খান, আকটের চর; কুমিল্লায় সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ)। সদরপুর থানার সামনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন ও মোশাররফ হোসেনের স্মরণে ‘জাগ্রত সদরপুর’ নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [নাজুমল কবির মুনির]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!