মুক্তিযুদ্ধে শ্রীনগর উপজেলা (মুন্সীগঞ্জ)
শ্রীনগর উপজেলা (মুন্সীগঞ্জ) ঢাকার নিকটবর্তী হওয়ায় ৪৮ ও ৫২-র ভাষা-আন্দোলন, ৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬-র ৬-দফা আন্দোলন এবং ৬৯-এর ১১ দফা ছাত্র-আন্দোলনে এ উপজেলার নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র-জনতা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। তারই ধারাবাহিকতায় ৭০-এর নির্বাচনেও তারা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মে মাসে মুন্সীগঞ্জে এক জনসভায় ভাষণ দেন। শ্রীনগর থেকে সেই সভায়
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এর নেতাকর্মীরা যোগদান করেন। জুলাই মাসে শ্রীনগর উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শ্রীনগর থানা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও পাটাভোগ ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মো. চুন্নু মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় ৬ দফার গুরুত্ব তুলে ধরে আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা করেন কফিল উদ্দিন চৌধুরী (যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী), এম কোরবান আলী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ব্যারিস্টার কাজী কামাল, সিরাজুল ইসলাম খান, আবদুর রশিদ মিয়া প্রমুখ। নির্বাচনে শ্রীনগর-লৌহজং-সিরাজদিখান এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কফিল উদ্দিন চৌধুরী এবং শ্রীনগর-লৌহজং এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বিপুল ভোটে জয়ী হন। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে শ্রীনগর কলেজের ছাত্ররা এর তীব্র প্রতিবাদ করে। কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে সকল ছাত্রছাত্রী মিছিলসহ কলেজ ও বাজারের রাস্তা দিয়ে “ইয়াহিয়ার ঘোষণা মানি না মানি না’, ‘তোমার আমার ঠিকানা – পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ ইত্যাদি স্লোগানে থানা প্রদক্ষিণ করে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সারাদেশে হরতাল আহ্বান করেন। শুরু হয় ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শ্রীনগরের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করে। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পরের দিন রেডিও থেকে সরাসরি মাইকযোগে শহরে প্রচার করা হয়। শতশত মানুষ কাঠপট্টি, কাঠের পুল ও পোস্ট অফিস সংলগ্ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে
ঐতিহাসিক এ ভাষণ শোনে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর নির্দেশ অনুসারে দেশের সর্বত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। শ্রীনগর থানা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় কফিল উদ্দিন চৌধুরী এমএনএ ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এমপিএ-কে প্রধান উপদেষ্টা করে। এ পরিষদে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন আবদুর রশিদ মিয়া, মো. চুন্নু মিয়া, মজিবর রহমান মজনু (শ্রীনগর থানা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক), নূরুল ইসলাম বাচ্চু ও পরেশ চন্দ্র পোদ্দার। জামাল চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-এর শ্রীনগর থানা শাখা গঠিত হয়। এ পরিষদের সদস্যরা ছিলেন- গাজী শামসুদ্দিন, মো. জয়নাল আবেদীন, ফজলুল হক সেলিম, আনোয়ার হোসেন খান, মোফাজ্জল হোসেন, ইদ্রিস আলী মিয়া, আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া প্রমুখ।
২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের খবর সংবাদপত্রে পড়ে শ্রীনগর থানা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দও আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী ১৩ই মার্চ শ্রীনগর খেলার মাঠে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক ছাত্র-জনসভাশেষে পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত হয়। ১২ই মার্চ শ্রীনগরn বাজারের দর্জি কাজী এমারত হোসেন সারারাত জেগে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লালবৃত্তসহ সবুজ বর্ণের একটি বড় সাইজের পতাকা তৈরি করে দেন। ১৩ই মার্চ বিকেলে শ্রীনগর থানা খেলার মাঠে ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জয়নাল আবেদীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ছাত্র- জনসভায় ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বক্তৃতা করেন ছাত্রলীগ নেতা ইদ্রিস আলী মিয়া, ফজলুল হক সেলিম, আবদুস শহীদ ভূঁইয়া, আনোয়ার হোসেন খান, মোফাজ্জল হোসেন ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মাহফুজুর রহমান রিপন। সভায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা আবদুস শহীদ খান সেন্টু সকলকে বাম হাত বুকে ও ডান হাত ঊর্ধ্বে তুলে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করার শপথ করান। সভাশেষে মো. জয়নাল আবেদীন পাকিস্তানি পতাকায় অগ্নিসংযোগ করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে সভা শেষ হয়। এরপর থেকে শ্রীনগরে পাকিস্তানি সৈন্যদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত এই পতাকা নিয়মিতভাবে উত্তোলন করা হতো।
২১শে মার্চ শ্রীনগর থানা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে স্থানীয় খেলার মাঠে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ নেতা ও নবনির্বাচিত প্রাদেশিক আইন পরিষদ সদস্য শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এ সভায় সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্ণনা করে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। তিনি বলেন, এবারের সংগ্রাম হবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একদফা অর্থাৎ বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম। জনসভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের মালিক মধুসূদন দে (মধুদা) উপস্থিত ছিলেন। তিনিও সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন।
পাকবাহিনী কর্তৃক ঢাকায় ২৫শে মার্চ গণহত্যা শুরুর পর ২৬শে মার্চ থেকে শুরু হয় ঢাকা থেকে হাজার- হাজার মানুষের আগমন। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের দক্ষিণে অবস্থিত মুন্সীগঞ্জ মহকুমা নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলার মানুষ ঢাকা থেকে প্রাণ রক্ষার্থে মুন্সীগঞ্জ সদর, টঙ্গীবাড়ি, সিরাজদিখান, লৌহজং ও শ্রীনগর থানায় এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। জিনজিরা দিয়ে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে অধিকাংশ ছিন্নমূল মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করে শ্রীনগরে। তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় শ্রীনগর কলেজ ও শ্রীনগর হাইস্কুলে। এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন থানা আওয়ামী লীগ সম্পাদক আবদুর রশিদ মিয়া, মজিবর রহমান মজনু, পরেশ চন্দ্র পোদ্দার, শ্রীনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নির্মলেন্দু মণ্ডল, ষোলঘর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. ওয়াজিউল্লাহ, ছাত্রলীগের থানা নেতৃবৃন্দের মধ্যে মো. জয়নাল আবেদীন, ফজলুল হক সেলিম, আনোয়ার হোসেন খান, মোফাজ্জল হোসেন, তোফাজ্জল হোসেন, নূর মোহাম্মদ প্রমুখ।
২৬শে মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের মালিক মধুসূদন দে, সকলের প্রিয় মধুদা। মধুদার জ্যেষ্ঠ পুত্র রনজিত কুমার দে, স্ত্রী যোগমায়া দে ও পুত্রবধূ রীনা রাণী দে-কেও পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করে। মধুদার এক কন্যা গুলিতে আহত হন। তাঁকেসহ মধুদার অন্যান্য সন্তানরা মার্চের শেষ দিকে গ্রামের বাড়ি শ্রীনগরে চলে আসেন। মধুদার হত্যা সংবাদ শুনে এবং তাঁর গুলিবিদ্ধ কন্যাকে দেখে শ্রীনগরের ছাত্র-জনতা প্রতিশোধ গ্রহণে দৃঢ় শপথ নেয়।
২৯শে মার্চ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ঢাকা থেকে শ্রীনগরে এসে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঐদিনই শ্রীনগর থানা থেকে কয়েকটি রাইফেল ও কিছু গুলি হস্তগত করা হয়। এগুলো নিয়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দসহ সর্বস্তরের জনগণ পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সম্মিলিতভাবে সিরাজদিখান উপজেলার সৈয়দপুরের দিকে ছুটে যায়। সৈয়দপুর যাত্রার প্রাক্কালে শ্রীনগর উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। তখন ঢাকার ফায়ার সার্ভিসের ফায়ারম্যান আ. সামাদ তাঁর পোশাকে রক্তের দাগ দেখিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা নির্মমভাবে বাঙালি হত্যার বর্ণনা দেন। তাঁর মুখে হত্যাকাণ্ডের বিবরণ শুনে শ্রীনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নির্মলেন্দু মণ্ডল তীর-ধনুক নিয়ে সকলকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানান।
এদিকে এপ্রিল মাসের ২ তারিখে ঢাকা থেকে জিনজিরা হয়ে শ্রীনগর আসার পথে ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আ ন ম হামিদউল্লাহ্ একমাত্র পুত্র ইবনে হামিদ জাকিউল্লাহ্ টুটুল (বয়স ১০ বছর) পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে শহীদ হন। তাঁর স্ত্রী মোসাম্মৎ ছিদ্দিকা খানম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। জিনজিরা দিয়ে আসার পথে শ্রীনগর থানার মজিদপুর দয়হাটা গ্রামের বেলায়েত হোসেন মোল্লার কন্যা রুবি পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে শহীদ হন। হামিদউল্লাহর পুত্র টুটুলের লাশ শ্রীনগর এসে পৌঁছলে হাজার-হাজার মানুষের সমাবেশ ঘটে। তার লাশ যখন শ্রীনগর বাজারের ওপর দিয়ে সমসপুর গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন এক হৃদছবিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সকলের চোখে অশ্রু ও হৃদয়ে প্রতিশোধের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। শ্রীনগরের মধুদার পরিবারের ৪ জন, হামিদউল্লাহ্ স্ত্রী-পুত্র ও মজিদপুর দয়হাটার রুবির হত্যাকাণ্ডে দারুণ প্রতিক্রিয়া হয়। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এমপিএ শ্রীনগর থানা থেকে উদ্ধারকৃত রাইফেল নিয়ে তাঁর দলবলসহ সৈয়দপুর ও অন্যত্র অবস্থান করে দু-চার দিন পর শ্রীনগরে ফিরে আসেন এবং এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে কলকাতার উদ্দেশ্যে বিক্রমপুর ত্যাগ করেন। দলীয় কর্মীদের যথাসময়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করারও নির্দেশ দেন। জুলাই মাসের শেষদিকে ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্র নিয়ে এলাকায় প্রবেশ করেন। তাঁরা থানা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্র আনার জন্য ভারতে প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। এ ধরনের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্ৰ মজিদপুর দয়হাটার কফিল উদ্দিন চৌধুরী এমএনএ-এর বাড়িতে গড়ে ওঠে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি পরিচালনায় মুন্সীগঞ্জের শহিদুল আলম সাঈদ ও দয়হাটার জামাল চৌধুরী মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এ কেন্দ্রের অধীনে ভোজপাড়ার মর্তুজাদের বাড়ির একটি দালানের অভ্যন্তরেও প্রশিক্ষণ চলে। প্রশিক্ষক হিসেবে শহিদুল আলম সাঈদ, শহিদুল ইসলাম, আবদুল লতিফ ও আহমদ মোড়ল দায়িত্ব পালন করেন। তন্তর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা কাজী আজিজুল হক, তিনগাঁও নিবাসী এনায়েত উল্লাহ দেওয়ান, শ্রীনগরের মো. জয়নাল আবেদীন ও হাসাড়ার আওলাদ হোসেনসহ ২৬ জনের একটি দলকে প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্র আনতে ভারতে প্রেরণ করা হয়। প্রশিক্ষণ পরিচালনা, ভারতে প্রেরণ ও শ্রীনগর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রসদ সরবরাহের কাজে নিয়োজিত ছিলেন মজিবর রহমান মজনু, নূরুল ইসলাম বাচ্চু, ফজলুল হক সেলিম ও দয়হাটার আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া। ২৬ জনের উপর্যুক্ত দলের সঙ্গে মুন্সীগঞ্জের ফজলে এলাহীর গ্রুপসহ মোট ৫২ জন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন হায়দারের মাধ্যমে অস্ত্রসহ দেশে প্রবেশ করেন। ডিসেম্বর মাসের ৯ তারিখ কাজী আজিজুল হক, এনায়েত উল্লাহ দেওয়ান প্রমুখ ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে গজারিয়ার বাউইশা ও মেঘনা ফেরিঘাটে পাকবাহিনীর একটি যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হয় এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা নজরুল ইসলাম (গজারিয়া উপজেলা) শহীদ হন।
শ্রীনগর উপজেলায় কফিল উদ্দিন চৌধুরী এমএনএ ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এমপিএ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ২১শে মার্চ শ্রীনগর মাঠে আয়োজিত বিরাট জনসভায় সকলকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। ২৯শে মার্চ তাঁর নেতৃত্বে সৈয়দপুরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস তিনি মুজিবনগর সরকারের সংসদীয় দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে ভারতে জনমত গড়ে তোলেন এবং ভারতীয় লোকসভার যৌথ অধিবেশনে মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আহ্বান জানিয়ে এক আবেগময় ভাষণ দেন। কফিল উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর পুত্র ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ভারতের আগরতলায় যান এবং নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন। ডা. বি চৌধুরী ভারতে যাওয়ার আগে তাঁর গ্রামের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপনে সহায়তা করেন। এ- সময় তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসাসেবা দেন। বাসাইলভোগের ফয়েজ আহমদ মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষণমূলক কথিকা ‘পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে’র লেখক ছিলেন। তাঁর লেখার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা ফুটে ওঠে, যা দেশ-বিদেশে জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ষোলঘরের আশফাকুর রহমান খান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গীত ও উপস্থাপনা বিভাগের অন্যতম সংগঠক ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের মধ্যে শ্রীনগর থানার বাড়ৈখালি ইউনিয়নের শ্রীধরপুর গ্রামের সরদার আলাউদ্দিন ছিলেন অন্যতম। তাঁর গাওয়া ‘রুখে দাঁড়াও রুখে দাঁড়াও বাঙালির সন্তান’ ও ‘জগৎবাসী একবার বাংলাদেশকে যাও দেখিয়া’ গানদুটি মুক্তিযুদ্ধের সময় খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। শ্রীনগর থানার আটপাড়া গ্রামের রণেন কুশারী ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম নাট্য প্রযোজক। তাঁর প্রযোজিত নাটকগুলো মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর মনোবল অটুট রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিমের অন্যতম সদস্য ছিলেন দোগাছির প্রতাপ হাজরা। ষোলঘরের ডা. আমানুর রহমান খান (রতন ) অস্ট্রেলিয়া টেলিভিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা তুলে ধরেন।
ন্যাপ (ভাসানী) নেতা কাজী জহিরুল হক (ষোলঘর) মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতা ও আগরতলায় একটি তথ্যকেন্দ্র পরিচালনা করেন। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে আগ্রহী ছাত্র- যুবকদের নিরাপদে সীমান্ত পার করিয়ে ভারতে পৌঁছে দেয়ার গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ছিলেন শ্রীনগরের দেউলভোগ নিবাসী কবি আবদুল খালেক ও শ্রীধরপুরের আবদুল জলিল। সংগঠক হিসেবে শ্রীনগর থানার সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে সমসপুরের আ ন ম হামিদউল্লাহ্ (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর), বাড়ৈখালির মঞ্জুরুল করিম (প্রাক্তন সচিব) ও ষোলঘরের নূরুল মোমেন খান মিহির (প্রয়াত প্রাক্তন সচিব)-এর অবদানও স্মরণীয়। আ ন ম হামিদউল্লাহ্ ১৯৭১ সালে ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। ইয়াহিয়া সরকার বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার জন্য যে প্রহসনমূলক বিচারের আয়োজন করে, তাতে সাক্ষ্য দিতে আ ন ম হামিদউল্লাহকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। বিচারকক্ষে তিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখে হাত তুলে সালাম দেন। দৃঢ়চেতা হামিদউল্লাহ্ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে যে দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন, সময়ের প্রেক্ষাপটে তা ছিল এক অত্যন্ত দুঃসাহসিক কাজ।
নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক হিসেবে মঞ্জুরুল করিম ও খুলনার পুলিশ সুপার হিসেবে নূরুল মোমেন খান মিহির মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াকু সৈনিক হিসেবে কাজ করেন। ষোলঘরের জি এ মোমেন ঢাকায় ফাইজার ওষুধ কোম্পানিতে উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন। তিনি নিজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোপনে ওষুধ সরবরাহ করে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন। ষোলঘরের ড. এ আর খান, ডা. আশেকুর রহমান খান ও ড. হারুন-উর-রশিদ ২৬শে মার্চের পর ঢাকা থেকে ষোলঘর এসে নিজেদের বন্দুক দিয়ে এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ড. এ আর খান ষোলঘরের একজন নারী নির্যাতনকারীকে বেঁধে প্রকাশ্যে শাস্তি প্রদান করেন।
শ্রীনগর থানার ওসি-র সরকারি বাসভবনে থানা মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। এখানে প্রথমে আতিক উল্লাহ খান মাসুদ (বর্তমানে দৈনিক জনকণ্ঠ সম্পাদক) থানা মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর থানা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন এম এ তাহের লস্কর ও কাজী আজিজুল হক (লেবু কাজী)। এ-সময় ইউনিয়ন পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প গড়ে ওঠে। বিভিন্ন ইউনিয়নে গঠিত মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প কমান্ডাররা ছিলেন- শ্রীনগরে সিরাজুল ইসলাম, পাটাভোগে মো. জয়নাল আবেদীন, ষোলঘরে হারুনুর রশীদ চৌধুরী, শ্যামসিদ্ধিতে আ. হামিদ, রাঢ়িখালে মজিবুর রহমান, আটপাড়ায় মীর আতাহার হোসেন, বাড়ৈখালিতে কে এইচ কবির, ভাগ্যকূলে আবদুস সহিদ ভূঁইয়া, কোলাপাড়ায় আবদুল আউয়াল, কুকুটিয়ায় আওলাদ হোসেন কাঞ্চন ও তন্তরে মো. শাহজাহান। শ্রীনগর সদর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার পরিবেশনের কঠিন দায়িত্ব পালন করেন বেজগাঁও গ্রামের মো. ইউনুছ ফকির।
১১ই মে মঙ্গলবার ৩৩ জন পাকিস্তানি সৈন্য তালতলা থেকে শ্রীনগরে আসে। স্থানীয় দালালরা তাদের সংবর্ধনা দেয়। শ্রীনগর ডাকবাংলোয় পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যাম্প স্থাপন করে এবং খাওয়া-দাওয়ার পর ভাগ্যকূলের দিকে রওনা দেয়। পথে মাইঝপাড়ার ইন্দু বিহারী রায় (নসুবাবু), শিবদাশ মিত্র ও রাজমোহন সাহার রাঢ়িখালের বাড়িতে আগুন দেয়। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের দোগাছির বাড়িও জ্বালিয়ে দেয়। তারা বেণী মাধব পোদ্দার ও পরেশ পোদ্দারের বাড়ি লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। শ্রীনগর বাজার লুট করে। ষোলঘর, রুসদি, অন্তর, বেলতলীসহ আরো অনেক গ্রামের হিন্দুবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।
২৮শে মার্চ শ্রীনগর থানা থেকে অস্ত্র নিয়ে আসার পর এলাকায় যে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল, পরবর্তীতে তাতে কিছুটা ভাটা পড়ে। এদিকে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ভারতে চলে যাওয়ায় স্থানীয় ছাত্র-যুবকরা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই থানা থেকে উদ্ধারকৃত রাইফেল ও গুলি কোলাপাড়ার আবদুল মালেক গোরস্তানে লুকিয়ে রাখা হয়। এ-সময় অস্ত্রলুটের অভিযোগ এনে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ ১১ জন রাজনৈতিক কর্মীকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়। মুসলিম লীগ-এর নেতাকর্মীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। মুন্সীগঞ্জ থেকে মুসলিম লীগ নেতা (প্রাক্তন এমএলএ) আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী শ্রীনগর এসে থানা শান্তি কমিটি গঠন করে। বাসাইলভোগের সৈয়দ আবদুল মান্নানকে করা হয় শান্তি কমিটির আহ্বায়ক। এর সদস্য ছিল- এডভোকেট মাহতাবউদ্দিন আহমেদ (দামলা), আলিমুল্লাহ (সিংপাড়া), আবদুস সামাদ লস্কর (কুকুটিয়া), আবদুল জলিল খান (বাড়ইখালি), শাহ আলম (আরধিপাড়া), নূরুল ইসলাম (সিংপাড়া), আমিনুল হক (কুকুটিয়া) প্রমুখ। শান্তি কমিটির সদস্যরা থানা থেকে নিয়ে আসা অস্ত্রগুলো উদ্ধারের জোর চেষ্টা চালায়। তাই কবরস্থানে লুকানো অস্ত্রগুলো থানায় ফেরত দেয়া হয়। শ্রীনগরে পাকবাহিনীর পথপ্রদর্শক ও সহায়তাকারীদের মধ্যে মমিন খান (আরধিপাড়া; থানা আনসার কমান্ডার), আবদুল আউয়াল তোতা (দেলভোগ) ও এম এম খান (মাশুরগাঁও; সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শ্রীনগরের প্রথম ব্যাচের মুক্তিযোদ্ধা মোর্শেদুল এহছান (হাসাড়া) সূত্রাপুর ব্রিজ ধ্বংস করতে গিয়ে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনকালে পাকবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার নিয়াজি স্বয়ং তাঁর নিকট থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য বের করার চেষ্টা করে। ১৬ই ডিসেম্বর অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গে তিনি মুক্তি পান। এছাড়া শ্রীনগর-বেজগাঁও গ্রামের মুসলিম আধ্যাত্মিক সাধক বিন্দু ফকির শ্রীনগর বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে পাকবাহিনী তাঁকে আটক করে শ্রীনগর থানায় নিয়ে যায়। তিনি সর্বদা ধুতি কাপড় পরতেন। তাই পাকবাহিনী তাঁকে হিন্দু মনে করে আটক করে এবং তাঁকে দিয়ে ইট টানায়। অবশ্য পরে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। শ্রীনগরে পাকবাহিনীর হাতে কোনো হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটেনি। তাই কোনো বধ্যভূমি নেই।
শ্রীনগরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে ওঠে ২৮শে মার্চ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে। শ্রীনগর থানা থেকে সংগৃহীত রাইফেল দিয়ে তা করা হয়, যদিও তখন পর্যন্ত ভালোকরে কেউ গুলি ছুড়তে জানত না। এরপর শ্রীনগর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ও থানা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য মো. জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে স্থানীয়ভাবে একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে ওঠে। এ বাহিনীর সদস্য ছিলেন- বেজগাঁও গ্রামের আনোয়ার হোসেন খান, মোজাম্মেল হোসেন, মোফাজ্জল হোসেন, বাসাইলভোগের আবদুল গাফফার, আজিজুল হক খান মনি, সোহরাওয়ার্দী চৌধুরী অরুণ ও হরপাড়ার ছিদ্দিকুর রহমান। এঁরা দালাল খতম করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই গেরিলা বাহিনী মজিদপুর দয়হাটার হুমায়ুনের মাধ্যমে -মুজিবনগর সরকার-এর নির্দেশাবলি সম্বলিত অনেকগুলো লিফলেট সংগ্রহ করে এবং সেগুলো খামে ভরে দালালদের নামে হত্যার হুমকি দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। এতে দালালরা ভীত হয়ে পড়ে এবং তাদের তৎপরতা কমিয়ে দেয়। গেরিলা দলটি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও অস্ত্র আনার উদ্দেশ্যে ভারতে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শ্রীনগর এলাকায় স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে জনমতকে চাঙ্গা রাখার জন্য নানাভাবে কাজ করে।
স্থানীয়ভাবে অপর একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করেন ভাগ্যকূলের গাজী শামসুদ্দিন। ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি শ্রীনগর থানার বিভিন্ন ইউনিয়নের অধিবাসীদের মধ্যে যাঁরা সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ইপিআরের সদস্য ছিলেন তাঁদের সংগঠিত করেন। পাইনপুকুরের বড়বাড়িতে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়। গাজী শামসুদ্দিন এ কেন্দ্রের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কেন্দ্রের সদস্যরা ছিলেন- আবদুস শহীদ ভূঁইয়া (হরপাড়া; সেনাবাহিনীর সদস্য), ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী পান্নু (আরধিপাড়া; সেনাবাহিনীর সদস্য), বাহাউদ্দিন (সমসপুর; সেনাবাহিনীর সদস্য), আবদুল হামিদ (মওগ্রাম; সেনাবাহিনীর সদস্য), হুমায়ুন কবির মোহর (রাঢ়িখাল পুলিশ সদস্য), রফিকুল ইসলাম (কামারগাঁও; পুলিশ সদস্য), আবদুল জলিল (কামারগাঁও; ইপিআর সদস্য) এবং আ. খলিল (কামারগাঁও; ইপিআর সদস্য)। এই ৮ জনকে সংগঠিত করে গাজী শামসুদ্দিন দোহার থানার জয়পাড়ার এক বাড়িতে বসে কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন। এরপর ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রশিক্ষণ চালানোর জন্য তাঁদের একটি রাইফেল দেন। এই রাইফেল দিয়ে তাঁরা ভাগ্যকূলে যুবকদের প্রশিক্ষণ দেন। এ-সময় কাজীর পাগলার সোলায়মান, আবুল হোসেন, কোলারপাড়ার এম এ মালেক ও লস্করপুরের জাহাঙ্গীর হাবিবউল্লাহর সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ হয়। শ্রীনগরের ছাত্রলীগ নেতা মো. জয়নাল আবেদীন, ফজলুল হক সেলিম, আনোয়ার হোসেন খান, মোজাম্মেল হোসেন ও মোফাজ্জল হোসেন অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণের জন্য এ-সময় প্রায়ই নৌকাযোগে ভাগ্যকূল আসতেন। জুলাই মাসে ভারত থেকে ফ্লাইট সার্জেন্ট এম এ ওমর, খন্দকার হেদায়েতুল ইসলাম কাজল, ঢালী মোয়াজ্জেম হোসেন, বাহারুল ইসলাম নান্নু, আরশাদ হোসেন, নূরুল ইসলাম ও খসরু বিক্রমপুরে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ প্রবশে করেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিকল্পিতভাবে দালাল খতম ও থানা অপারেশন করে অস্ত্র সংগ্রহের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
শ্রীনগর থানায় মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের সূচনা হয় আগস্ট মাসে মমিন খান হত্যা এবং শ্রীনগর থানা ও শ্রীনগর বাজার শাখা হাবিব ব্যাংক লিমিটেডে সফল অপারেশনের মধ্য দিয়ে। আরধিপাড়ার অধিবাসী মমিন খান প্রথমে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সঙ্গে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়। পরে সুযোগ বুঝে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে হিন্দুদের ঘরবাড়ি পোড়াতে ও লুট করতে সাহায্য করে, বহু নারীর ইজ্জত নষ্ট করে এবং শতশত মানুষকে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করে। ৫ই আগস্ট রাতে শ্রীনগর থানার কাছাকাছি জোরদখলকৃত এক হিন্দুবাড়িতে নারী ও মাদক আসক্ত অবস্থায় মুক্তিবাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করে। তার প্রধান সহকারী আবদুল আউয়াল তোতা খালে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যায়। তোতার এক গোমস্তা এবং মমিন খানের অপর এক সহকারীও সেদিন নিহত হয়।
৬ই আগস্ট সকাল ৭টায় মুক্তিবাহিনীর তরুণরা অতি অল্প সময়ের মধ্যে থানার সমস্ত অস্ত্র হস্তগত করে কাগজপত্র সব পুড়িয়ে দেন। থানার পোস্ট অফিসটি পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং হাবিব ব্যাংকের মানেজারকে ধরে এনে তালা খুলিয়ে নগদ ৬০ হাজার টাকা হস্তগত করা হয়। শ্রীনগর শান্তি কমিটি ও পুলিশ বাহিনী মুক্তিবাহিনীকে ঠেকানোর জন্য যে দুর্গ গড়ে তুলেছিল, তা মুহূর্তে ভেঙ্গে যায়। এলাকার যারা মুক্তিবাহিনীর অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান ছিল, তারা এ অপারেশন দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে পড়ে। এরপর থেকে শান্তি কমিটির সদস্যরা সাবধানে চলাফেরা করে। এসব অপারেশনে নেতৃত্ব দেন খন্দকার হেদায়েতুল ইসলাম কাজল। তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন- আবদুস শহীদ ভূঁইয়া (হরপাড়া), ফখরুদ্দিন চৌধুরী পান্নু (আরধিপাড়া), বাহারুল ইসলাম নান্নু (কামারগাঁও) প্রমুখ। বাড়ৈখালি গ্রামের ফ্লাইট সার্জেন্ট (অব.) ওমর আলীকে মুন্সীগঞ্জ মহকুমা মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পর থেকে শ্রীনগর থানার সর্বত্র মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা আরো বৃদ্ধি পায়। আড়িয়াল বিলের উত্তর তীরে সার্জেন্ট ওমর তাঁর কর্মস্থল নির্ধারণ করেন।
শ্রীনগর উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয়- কামারখোলা যুদ্ধ ও শ্রীনগর থানাযুদ্ধ। কামারখোলার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২৫শে অক্টোবর কমান্ডার মাসুদ, কমান্ডার সুলায়মান ও কমান্ডার আবদুশ শহীদ ভূঁইয়ার নেতৃত্বে। এ-যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। শ্রীনগর থানাযুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৭ই নভেম্বর কমান্ডার আতিকউল্লাহ খান মাসুদ প্রমুখের নেতৃত্বে এবং এ যুদ্ধের মাধ্যইে শ্রীনগর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
শ্রীনগর থানা মুক্ত হওয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৯শে নভেম্বর (২রা অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮)। এদিন পাকসেনারা শ্রীনগর থানা ছেড়ে মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পথিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন। এতে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং কয়েকজন শ্রীনগরের দিকে ফিরে আসে। কিন্তু এখানেও তারা মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নিহত হয়। এ-সময় দুজন রাজাকারও নিহত হয়। অবশেষে এদিনই শ্রীনগর থানা হানাদারমুক্ত হয়।
শ্রীনগর শত্রুমুক্ত হওয়ার পর মুজিবনগর সরকারের নির্দেশমতে বেসামরিক প্রশাসন চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। বেজগাঁও গ্রামের মজিবর রহমান মজনু থানা বেসামরিক প্রশাসনের আহ্বায়ক ও সেলামতির আবদুল হক দপ্তর পরিচালনার দায়িত্ব পান। শ্রীনগর ডাকঘরের পশ্চিম পাশে বেজগাঁও গ্রামের হাছেন বেপারীর টিনশেড ভবনে থানা বেসামরিক প্রশাসনের কার্যালয় স্থাপিত হয়। ইউনিয়ন পর্যায়েও বেসামরিক প্রশাসন চালুর ব্যবস্থা করা হয় এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে থেকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হয়। তাঁরা হলেন— শ্রীনগরে হাবিবুর রহমান, পাটাভোগে নূরুল ইসলাম বাচ্চু, ষোলঘরে আবদুল কাদের, রাঢ়িখালে সিরাজ উদ্দিন খান, ভাগ্যকূলে গাজী আক্কেল আলী, শ্যামসিদ্ধিতে আবদুস ছামাদ মোল্লা, কুকুটিয়ায় মো. মোছলেম আলী খান, বাঘড়ায় আ. রউফ মাস্টার, তন্তরে কালাচান ভৌমিক, কোলাপাড়ায় আ. বাছের হাওলাদার, হাসাড়ায় ফজলুল হক খান, বীরতাড়ায় বোরহান উদ্দিন চৌধুরী, বাড়ৈখালিতে শামসুল হক ও আটপাড়ায় হাবিবুর রহমান মোল্লা। বেসামরিক প্রশাসন এলাকার আইন-শৃংখলা, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপন, তাঁদের রসদ সরবরাহসহ সামাজিক বিচার-সালিশের কাজ পরিচালনা করে।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েল, বীর বিক্রম (পিতা আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী, দক্ষিণ পাইকশা) ও মহসিন উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম (পিতা মহিউদ্দিন আহমেদ, দামলা)। শ্রীনগরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েল, বীর বিক্রম (৩০শে আগস্ট শহীদ), আব্দুল্লাহ ভূঁইয়া ফুল (ষোলঘর; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সহকারী), নিজামউদ্দিন আজাদ (পিতা কামরুদ্দিন আহমদ, ষোলঘর), মহিউল ইসলাম মিন্টু (ষোলঘর; এ কে এস কে উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্র), আবদুর রহমান (বেজগাঁও; ইপিআর সদস্য), আবদুল মোতালেব (প্রাণীমণ্ডল), নবী চোকদার (হাসারগাঁও), নূরুল ইসলাম (দেলভোগ; নৌবাহিনীর সদস) এবং মোশারফ হোসেন (কবুতর খোলা)। স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ভাষা শহীদদের স্মরণে ১৯৭২ সালে শ্রীনগর কলেজ প্রাঙ্গণে একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে। [মো. জয়নাল আবেদীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড