মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর উপজেলা (গাজীপুর)
শ্রীপুর উপজেলা (গাজীপুর) শ্রীপুরের কিছু উদার দেশপ্রেমিক নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের উদ্যোগে ১৯৬৬ সালে অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট সাদির আকন্দ (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ)-এর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ-এর প্রথম কমিটি গঠিত হয়। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি শাসন-শোষণ থেকে জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষার বীজ রোপিত হয়েছিল। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের সাতই মার্চের ভাষণ এর উত্তাল তরঙ্গ আছড়ে পড়ে শ্রীপুরের শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, তরুণ তথা সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। পাকিস্তানিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা আর মাতৃভূমির শৃংখলমুক্তির বাসনা, বিশেষ করে শ্রীপুরের ছাত্র ও তরুণ সমাজকে দুঃসাহসী করে তোলে। এই দুঃসাহসী তরুণদের উৎসাহ দান ও সংগঠিত করার ক্ষেত্রে শ্রীপুরের কৃষক লীগ নেতা এডভোকেট মো. রহমত আলী এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে এডভোকেট মো. রহমত আলীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত শ্রীপুরের মুক্তিকামী ছাত্র-শ্রমিক-জনতা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণে এগিয়ে আসে।
৮ই মার্চ শ্রীপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইসমাইল হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক সাহাব উদ্দিন মণ্ডলের নেতৃেত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন এডভোকেট মো. রহমত আলী এবং শফিরউদ্দিন আহমেদ এমপিএ। সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজিম উদ্দিন আহমেদ, ডা. কমর উদ্দিন, ফকির আ. মান্নান মাস্টার, মনির উদ্দিন ফকির, আফসার উদ্দিন আকন্দ, মিজানুর রহমান খান, ইব্রাহিম মণ্ডল, ডা. আবুল মুনসুর খান, বাবর আলী মোল্লাহ, নূর মোহাম্মদ ফকির, সাহাব উদ্দিন বিএসসি-র মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
জনগণকে সংগঠিত করতে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পাশাপাশি এডভোকেট মো. রহমত আলীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শ্রীপুর থানা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন আব্দুল মোতালেব মোড়ল এবং সদস্য-সচিব ছিলেন মো. মনসুর খান। কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন- আব্দুল করিম প্রধান, আবুল মনসুর আহমেদ খান, মো. জহিরুল ইসলাম সুবেদ, এস এম লুৎফর রহমান, আব্দুল মান্নান, আফতাব উদ্দিন আহমেদ, খন্দকার জালাল উদ্দিন, মো. আমির হামজা, সিরাজুল ইসলাম বকুল, মো. আব্দুল হাই, মো. সিরাজুল হক, মহিউদ্দিন আহমেদ, মো. হাবিবউল্লাহ, রবীন কুমার, মো. সামসুল হক, মো. ইদ্রিস আলী, মো. সারোয়ার জাহান প্রমুখ। এই পরিষদ গঠনের ক্ষেত্রে জনপ্রিয় সাবেক ছাত্রনেতা ও বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এর ফলে শ্রীপুর হয়ে ওঠে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের এক শক্তিশালী ঘাঁটি।
২৫শে মার্চের কালরাতে পাকিস্তান বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে ঢাকায় ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার সংবাদ পেয়ে শ্রীপুরের প্রতিবাদী ছাত্র-জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ-এর তৎপরতায় সমগ্র শ্রীপুর থানাব্যাপী জনতা সংগঠিত হতে শুরু করে। তারই অংশ হিসেবে থানা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে সেনাসদস্য আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মাওনা হাইস্কুল মাঠে এবং আকরাম উল্লাহ মাস্টারের নেতৃত্বে গোসিংগা প্রাইমারি স্কুল মাঠে বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা দেশীয় অস্ত্র দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে আরো সংগঠিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণের জন্য তাঁরা ছোট-ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ভারতে গমন করেন। মুক্তিযুদ্ধ প্রতীক: পরিচালনার জন্য গঠিত বাংলাদেশ সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ-এর নির্দেশে এডভোকেট রহমত আলী ভারতে যান এবং কলকাতা ৮নং থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের সদর দফতরে যোগদান করেন। তিনি ফ্লাইট কোরিয়ার হিসেবে বিমানে বিভিন্ন সেক্টর থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম-এর নিকট পৌঁছে দেয়ার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এদিকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংগঠকরা শ্রীপুরের কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ জনতাকে শক্তি ও সাহস যোগাতে থাকেন।
২৫শে মার্চ পাকবাহিনীর গণহত্যার পর দিশেহারা মানুষ প্রাণভয়ে ঢাকা শহর ত্যাগ করে পলায়ন করতে থাকে। এসব পলায়নপর মানুষের আশ্রয় এবং সেবাদানের জন্য থানা সংগ্রাম পরিষদ এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা-কর্মীরা স্থানীয় জনগণের সহায়তায় সমগ্র উপজেলায় আশ্রয় কেন্দ্ৰ স্থাপন করেন। এ সকল আশ্রয় কেন্দ্রে শরণার্থীদের আশ্রয় দান, তাদের চিকিৎসা, খাওয়া, পথ দেখিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নেতা-কর্মীরা পালন করেন।
আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর মধ্যে টেংরা আশ্রয় কেন্দ্র সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল। এ আশ্রয় কেন্দ্রে আবদুল মতিন, মো. হানিফ (মেম্বর), আবদুল কাদের, আমির মিয়া, মাজম আলী (মেম্বর), মহিউদ্দিন (মেম্বর), ইদ্রিস আলী, আনসার আলী সরকার, সামসুল হক ফিরোজ, আজিজ ফকির, অনিল সরকার প্রমুখ সেবক হিসেবে ভূমিকা রাখেন।
২৮-২৯শে মার্চ গোসিংগা বাজার আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। উত্তর অঞ্চল, চট্টগ্রাম এবং সিলেট অঞ্চলের মানুষের জন্য এ আশ্রয় কেন্দ্র নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত ছিল। এ কেন্দ্রে সেবক হিসেবে শামসুল হক, ছানা উল্লাহ মাস্টার, আবদুল বারী শেখ, মাওলানা আশরাফ উদ্দিন আহমেদ, মাওলানা আবদুস সালাম, আবদুল জব্বার, রাজা মিয়া, অছিম উদ্দিন আহমেদ, ফজলুর রহমান প্রধান, মামুদ আলী সরদার, লাল মিয়া প্রমুখ ভূমিকা রাখেন।
উপজেলার বৃহৎ বাণিজ্য কেন্দ্র বরমী বাজার আশ্রয় কেন্দ্রে হাজার-হাজার শরণার্থী আশ্রয় নিয়ে মানবিক সহানুভূতি লাভ করে। এ আশ্রয় কেন্দ্রে স্থানীয় ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এখানে সেবক হিসেব আবদুল মান্নান ফকির, শাহাব উদ্দিন, আবদুর রউফ মাস্টার, আবদুল মান্নান মেকার, শওকত হোসেন, গিয়াস উদ্দিন, আমজাদ হোসেন, গোলাম শহীদ, আহমেদ আলী, রমেশ চন্দ্র সাহা প্রমুখ দায়িত্ব পালন করেন।
রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টমেন্টের পাশেই রাজবাড়ি বাজার আশ্রয় কেন্দ্রে বিপদগ্রস্থ অনেক মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করে। মো. বাবর আলীর নেতৃত্বে এ কেন্দ্রে সেবক হিসেবে কাজী আফছার, আয়েত আলী মেম্বার, নূরুল ইসলাম সিরাজী, ডাক্তার আবুল বাতেন, হাসিম উদ্দিন মেম্বর, আবদুল গণি ফকির প্রমুখ দায়িত্ব পালন করেন।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে কাওরাইদ বাজার ছিল শ্রীপুরের অপর একটি আশ্রয় কেন্দ্র। এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি মনির উদ্দিন ফকিরের নেতৃত্বে সাফায়েত উল্লাহ, ছফির উদ্দিন সরকার, মো. সরাফত আলী, ডাক্তার মসলেহ উদ্দিন, হাসেম আলী মৃধা, আবদুল বারী ফকির, মতিউর রহমান মাস্টার, আবদুল মান্নান প্রমুখ এ আশ্রয় কেন্দ্রে সেবক হিসেবে শরণার্থীদের সেবা দেন।
মাওনা আশ্রয় কেন্দ্রে ভৌগোলিকভাবে প্রচুর সংখ্যক শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করে। এ কেন্দ্রে সেবক হিসেবে হাজী আফির উদ্দিন আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম, আবদুল খালেক, নূরুল ইসলাম, ডা. মোশাররফ হোসেন, বারী সরকার, ইলিয়াস, আবদুল আজিজ ফকির, আবদুল বাকের ফকির, ছাত্রনেতা সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া শ্রীপুর হাইস্কুলেও আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়। এ কেন্দ্রে সাহাব উদ্দিন মণ্ডল, আবুল হাসান, মসলেহ উদ্দিন, ডাক্তার মনসুর আহমেদ, ফকির আবদুল মান্নান, এস এম লুৎফর রহমান, আবুল মনসুর খান, আবদুল মোতালেব মোড়ল প্রমুখ সেবক হিসেবে কাজ করেন।
ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে সর্বপ্রথম প্লাটুন কমান্ডার সিরাজ উদ্দিন (পিতা মো. ছমেদ আলী, পেলাইদ, গোসিংগা)-এর নেতৃত্বে সেকশন কমান্ডার ইসলাম উদ্দিন মাস্টার (পিতা আ. কাদির, তেলিহাটি), আ. ওহাব (পিতা রজব আলী, পেলাইদ, গোসিংগা), মো. সাহাবুদ্দিন ফকির (পিতা হাসান আলী, পেলাইদ, গোসিংগা), মফিজ উদ্দিন (পিতা হাসান আলী, পেলাইদ, গোসিংগা), আলাউদ্দিন ভূঞা (পিতা আবুল হাশেম ভূঞা, কাওরাইদ), আবু সাইদ (পিতা হাফিজ উদ্দিন, বন খুবিয়া, প্রহ্লাদপুর) প্রমুখ শ্রীপুর থানায় প্রবেশ করেন। ২য় ব্যাচে প্লাটুন কমান্ডার এম এ কাদির (প্রহ্লাদপুর)-এর নেতৃত্বে সেকশন কমান্ডার মিয়ার উদ্দিন (পিতা আব্দুর রহমান, ডোয়াইবাড়ি, রাজাবাড়ি), মাহবুবুর রহমান ফকির (পিতা মৌলভী আ. কদির), আ. আজিজ (পিতা মনসুর উদ্দিন, আতলরা, প্রহ্লাদপুর), হযরত আলী (প্রহ্লাদপুর) প্রমুখ প্রবেশ করেন। ৩য় ব্যাচে প্লাটুন কমান্ডার গিয়াস উদ্দিন (পিতা সবজে আলী, দরগারচালা, বরমী)-এর নেতৃত্বে সেকশন কমান্ডার দেলুয়ার হোসেন মোল্লা (পিতা কাশেম আলী মোল্লা, বারতোপা, মাওনা), আ. মতিন (পিতা কুদরত আলী, ধনুয়া), আ. আউয়াল মৃধা (পিতা মহর আলী মৃধা, তেলিহাটী), ওয়াহিদুজ্জামান (পিতা হারুন আল রশিদ, নান্দিয়া সাংগুন, বরমী), ফিরোজ শাহ (পিতা আ. রহমান সরকার, চরবাহার, বরমী) প্রমুখ শ্রীপুরে আসেন। ৪র্থ ব্যাচে প্লাটুন কমান্ডার জেড আই সুবেদ (পিতা মো. আতশ আলী, কায়েতপাড়া, বরমী)-এর নেতৃত্বে আ. বারেক (পিতা হামিদ শেখ, শ্রীপুর পৌরসভা), জয়নাল আবেদীন (পিতা আরফান আলী, গোসিংগা), মোবারক হোসেন (পিতা কলিম উদ্দিন, সিংগারদিঘী, মাওনা) প্রমুখ শ্রীপুরে আসেন। ৫ম ব্যাচে প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল হাই (রায়েদ, কাপাসিয়া)-এর নেতৃত্বে, সেকশন কমান্ডার বাবর আলী সরদার (পিতা মাহমুদ আলী সরদার, লতিফপুর, গোসিংগা), আ. মান্নান (পিতা আ. মজিদ, বরমী), এমদাদুল হক (পিতা মকবুল হোসেন, কাওরাইদ), নজরুল ইসলাম বিএসসি (পিতা সামসুদ্দিন আহম্মেদ, ধনুয়া), প্লাটুন কমান্ডার বীরেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ (পিতা দেবেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ, উত্তর পেলাইদ, তেলিহাটী) প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা আসেন।
শ্রীপুরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে এডভোকেট মো. রহমত আলী, নূর মোহাম্মদ ফকির, হাসান আলী মৃধা, হালিম মাস্টার (কেওয়া পশ্চিম খণ্ড), বাবু খালেক (মুলাইদ), আফির উদ্দিন সরকার (মাওনা), আনোয়ার হোসেন মাস্টার (পেলাইদ), আনসার আলী সরকার (ষাইটালিয়া), আ. জব্বার মুন্সী (ষাইটালিয়া), ডা. মোশারফ হোসেন (মাওনা), মাজম আলী (টেংরা), আশ্রব আলী (টেংরা), ইদ্রিস আলী, আ. কাদির, আমির মিয়া, ছানা উল্লাহ মাস্টার (গোসিংগা), অধ্যাপক আ. মোতালেব (সাতখামাইর), আ. বাতেন মাস্টার (বিধায়), নূরুল ইসলাম সিরাজী (ইজ্জতপুর), কাজিম উদ্দিন আহম্মেদ (গাজীপুর), নূরু মিয়া (বদনীভাংগা), হাশেম মাস্টার (মুলাইদ), নূরুল ইসলাম এমএ, ছাত্রনেতা সিরাজুল হক প্রমুখ বিশিষ্ট ভূমিকা রাখেন।
৩১শে মার্চ রাজেন্দ্রপুর, জয়দেবপুর ও পিলখানা সমরাস্ত্র কারখানা থেকে অস্ত্রসহ পালিয়ে আসা সুবেদার সুলতান আহমেদের নেতৃত্বে ৬০ জনের একটি দল শ্রীপুর হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এপ্রিলের ১ম সপ্তাহে সুবেদার সুলতান “আহমেদ ও হাবিলদার আফাজ উদ্দিন ভূঞার নেতৃত্বে রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সুনির্দিষ্ট সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায় যে, পাকসেনারা রেলযোগে ময়মনসিংহ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিরোধযোদ্ধারা প্রথমে মাইজপাড়া গ্রাম রেল গেইটে বাংকার খনন করে ময়মনসিংহের পথে যাওয়া পাকসেনাদের আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে ৬ দিন অবস্থান করেন। পরবর্তীতে তাঁরা পাকবাহিনীর চলাচলের পথে বিঘ্ন ঘটিয়ে আক্রমণের জন্য রেল ব্রিজ ধ্বংস করেন। ১৯শে এপ্রিল পাকবাহিনীর অস্ত্রবোঝাই স্পেশাল ট্রেন প্রথমে শ্রীপুর ও কাওরাইদ হয়ে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে গোলাঘাট নামক স্থানে সুবেদার সুলতান আহমেদের নেতৃত্বে ৬০ জনের দলটি এবং স্থানীয় জনতা মিলে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকবাহিনী প্রতিরোধ ভাঙ্গার জন্য পাল্টা আক্রমণ চালায়। এ-সময় উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়৷ গোলাঘাট প্রতিরোধযুদ্ধএ ভিটিপাড়া গ্রামের অসম সাহসী নূর মোহাম্মদ মেম্বার শহীদ হন। এটাই ছিল পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে শ্রীপুরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রথম প্রতিরোধ।
১৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী রেলযোগে সর্বপ্রথম শ্রীপুরে অনুপ্রবেশ করে শ্রীপুর থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে তারা শ্রীপুর হাইস্কুল মাঠ, গোসিংগা রাজকাচারী, কাউরাইদ স্টেশন, সাতখামাইর স্টেশন, গাজীপুর স্টেশন ও গোলাঘাট পুলপারে স্থায়ী এবং ইজ্জতপুর ও বলদীঘাট স্কুলে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে অপারেশন চালায়। এছাড়া তারা রাজাকার এবং শান্তি কমিটির সদস্যদের দিয়ে স্টেশন, ব্রিজ-কালভার্ট ও গুরুত্বপূর্ণ জনপদে চেকপোস্ট বসায়। শ্রীপুরে পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশের পর তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় থানার ওসি খবিরুজ্জামানের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী এবং মাওলানা মান্নান মমতাজী (ভাংনাহাটি)-র নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। পর্যায়ক্রমে উপজেলার সকল ইউনিয়নে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। কাওরাইদ ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল আফাজ উদ্দিন চৌধুরী। শ্যান্তি কমিটি ও রাজাকারদের প্রধান কাজ ছিল লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে যাওয়া যুবকদের তথ্য দেয়া। তাদের সহযোগিতায় পাকসেনারা ভারতে যাওয়া যুবকদের পিতা-মাতা ও স্বজনদের ধরে এনে নানারকম অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে।
শ্রীপুরে কুখ্যাত রাজাকারদের মধ্যে বাঘিয়ার মাওলানা জালালউদ্দিন আকবরি খিদিরপুরী, আবদুর রাজ্জাক, হযরত মোড়ল, হেলাল মণ্ডল, হান্নান মমতাজী, তাজউদ্দিন, আ. কাদির, মৌলবী আ. আউয়াল, জামাল উদ্দিন, আ. ছাত্তার মাস্টার, নোয়াব আলী চৌকিদার, ওসমান মেম্বার (মুন্সিবাড়ি, কেওয়া পশ্চিম খণ্ড), কাইল্যা রাজাকার (ইন্দ্রবপুর) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। কাওরাইদ ইউনিয়নের রাজাকারদের মধ্যে ছিল মান্নান খান, ওয়াহিদ মাস্টার, কুদরত আলী, খলিল শেখ এবং শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল আফাজ উদ্দিন চৌধুরী। এছাড়া বরমীর মো. আমীর সরকার, হক সাহেব, বোরহান সরকার, আবদুল আওয়াল, আব্দুল গফুর, দিয়ানত মুন্সী, ছাত্তার মাস্টার, গাজীপুরের আফসারউদ্দিন চেয়ারম্যান, আব্দুল হামেজ ফকির, জয়নাল মুন্সী, কলু মেম্বার, গোসিংগার টুকু মিয়া, নুরু মিয়া, মীর মো. নূরে আ হাই, তাহের আলী, সেকান্দার আলী, আবুল সরকার, প্রহ্লাদপুরের তাজরউদ্দিন চেয়ারম্যান, ইব্রাহিম সরকার চেয়ারম্যান, ইসমাঈল হোসেন বাগমার, শহিজউদ্দিন মোল্লা, মাওনার শহর আলী মোড়ল, রাজাবাড়ি ইউনিয়নের শরাফত আলী সরকার, আ. রউফ সরকার, নাজিম উদ্দিন খান, ইউসুফ আলী খোকা মিয়া, পীরজাদা আ. হাই ছিল দুর্ধর্ষ রাজাকার। এরা পাকহানাদার বাহিনীর সহযোগিতায় অগ্নিসংযোগ, হত্যা, গণহত্যা, লুটতরাজ, নারীনির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য অপরাধে লিপ্ত হয়।
১৮ই এপ্রিল শ্রীপুর থানায় পাকবাহিনী ক্যাম্প স্থান করে। তাদের সঙ্গে এখানে বহুসংখ্যক রাজাকার অবস্থান করতে থাকে। এখানকার দুর্ধর্ষ রাজাকারদের মধ্যে ছিল ঘটিয়াপাড়ার আমজাদ হোসেন, গাড়ারনের আবদুল কাদির, আবদুল আউয়াল, মজিবর রহমান, কাইল্যা, জামাল উদ্দিন প্রমুখ। থানার ওসি, শান্তি কমিটি এবং রাজাকারদের সমন্বয়ে পাকবাহিনী এ ক্যাম্প থেকে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করত। মে মাসের শেষদিকে পাকবাহিনীর অপতৎপরতা অত্যধিক বেড়ে যায়। এ-সময় তারা গ্রামে লুটপাট, নির্যাতন, হত্যা ও অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। কেওয়া, সাতখামাইর, বরমী, মাওনা প্রভৃতি অঞ্চলে ওসি খবিরুজ্জামানের টহল মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাদের অত্যাচারে এলাকার মানুষজন অন্যত্র চলে যেতে থাকে। ১৭ই জুন পাকবাহিনী উজিলাব গ্রামে গণহত্যা চালায়। উজিলাব গণহত্যায় ৭ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। তাদের শ্রীপুর মহাবিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে গুলি করে হত্যা করে একটি গর্তে মৃতদেহগুলো পুঁতে রাখা হয়। একই সময়ে তারা কেওয়া গ্রামের আবদুস সাত্তার ও আবদুল খালেককে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ গ্রামের ওমর আলী ও তার ভাই-ভাবীকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন শেষে হত্যা করে কলেজের পাশে গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হয়। কেওয়া গ্রাম থেকে বন্দি করে এনে শুকুর আলী ও বাদশা আকন্দকে হত্যা করে একই গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হয়। আজিলাব গ্রামের আমীর আলী মোড়লকে ধরে ক্যাম্পে নির্যাতন চালায় পাকবাহিনী। পরে টাকার বিনিময়ে সে মুক্তি পায়।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাড়ি দরদরিয়ার পাশে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়েই গোসিংগা বাজার। এ বাজারে প্রতিষ্ঠিত পাকবাহিনীর রাজকাচারি ক্যাম্পে শতাধিক পাকসেনা ও সমসংখ্যক রাজাকার সার্বক্ষণিক অবস্থান করত। নদীর পূর্ব পাড়কে বলা হতো ‘ইন্ডিয়া’ আর পশ্চিম পাড়কে ‘পাকিস্তান’। এ ক্যাম্পের রাজাকারদের মধ্যে বাঘিয়ার মাওলানা জালাল উদ্দিন আকবরী, আবদুর রাজ্জাক ও তাজউদ্দিন ভয়ঙ্কর ছিল। তারা প্রহ্লাদপুরের সিরাজ উদ্দিন আকন্দকে পটকা রাস্তার পাশে গুলি করে হত্যা করে। পাকসেনাদের একটি দল রাজাকার কমান্ডার আমজাদ হোসেন, আবদুল মতিন ক্বারী প্রমুখের সহযোগিতায় কর্ণপুরের আফাজ উদ্দিন আকন্দ এবং খিলপাড়ার মাইন উদ্দিন খন্দকারকে বাড়ি থেকে ধরে এনে পটকায় গুলি করে হত্যা করে। একই স্থানে তারা মাটিয়াগড়ের রায়হান উদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করে। তারা কাইচাবাড়ির ওহাব ফকিরকে বাড়ি থেকে ধরে ক্যাম্পে এনে নির্যাতন করে এবং দুহাজার টাকার বিনিময়ে মুক্তি দেয়। এ-সময় তারা খিলপাড়ার লতিফ সরকার, আবদুর রশিদ বাবু ও ভাংনাহাটির আবদুল মতিনকে নির্যাতন করে হত্যা করে। গোসিংগা বাজারের পান ব্যবসায়ী পালগ ও তার পুত্র সুনীলকে গুলি করে হত্যার পর নদীতে ফেলে দেয়।
কাওরাইদ শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আফাজ উদ্দিন চৌধুরীর সহযোগিতায় কাওরাইদ রেলওয়ে স্টেশনে পাকসেনা ক্যাম্প স্থাপিত হয়। পাকসেনা এবং রাজাকাররা যৌথভাবে অবস্থান করায় এ ক্যাম্পটি হয়ে ওঠে নৃশংস অত্যাচারের কেন্দ্র। তারা আবদুল লতিফ ভূঁইয়া ও তার ছোটভাইকে বাজার থেকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা শেষে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। তারা অশ্রু নামে এক দোকান কর্মচারীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। নারিন্দাসাংগুন গ্রামের মো. মকবুল হোসেন এবং যোগেশ চন্দ্র শীল শর্মাকে তারা হত্যা করে। একই গ্রামের আইয়ুব আলী ঢালী, আবদুল মতিন মাস্টার, সাফায়েত উল্লাহ, আবদুর রশিদ ডাক্তার, হোসেন আলী মৃধা, ছফির উদ্দিন সরকার প্রমুখের ওপর তারা নির্যাতন চালায়।
২৬শে এপ্রিল পাকবাহিনী বদলীঘাট হাইস্কুলে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্পে নির্যাতনের শিকার হন নিমতলা গ্রামের হারিস উদ্দিন ও তার দুই ভাই। যোগীরটিট গ্রামের একজনকে ধরে এনে এখানে হত্যা করা হয়।
পাকবাহিনীর সাতখামাইর ক্যাম্প অন্য ক্যাম্পের মতোই নৃশংস অত্যাচারের কেন্দ্রেবিন্দুতে পরিণত হয়। এ ক্যাম্পে রাজাকারদের কমান্ডার ছিল জামাল উদ্দিন মোড়ল। রাজাকারদের সহয়তায় পাকসেনারা বর্ণপুরের মনসুর আলীর কন্যা শিরিন আক্তারকে তার সাতখামাইর শশুর বাড়ি থেকে শশুর আবদুল লতিফসহ তুলে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে। নির্যাতনের পর তাদের শ্রীপুর ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সেখান থেকে পুনরায় নির্যাতনের পর তাদের লোহাগাছ রেল লাইনের ধারে গুলি করে হত্যা করে। পাকবাহিনী টেংরা গ্রামের ছমেদ আলীর কন্যা ছালেহা আক্তারকে শাশুড়িসহ বাড়ি থেকে তুলে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে। নির্যাতনের পর তাদেরও শ্রীপুর ক্যাম্পে পাঠানো হয়। শ্রীপুর ক্যাম্পে নির্যাতনের পর তাদের লোহাগাছ রেল লাইনের ধারে গুলি করে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাদানের জন্য পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ৫ই নভেম্বর সাতখামাইর গ্রামে গণহত্যা চালায়। সাতখামাইর গণহত্যায় ৮ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। শহীদদের মৃতদেহগুলো সাতখামাইর ও দরগার চালা রাস্তার পাশে আতর আলীর বসতভিটায় গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হয়।
শ্রীপুর থানার ওসি খবিরুউজ্জামান পারুলী নদীর ব্রিজ আক্রমণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের (নুর মোহাম্মদ কফিসহ) ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। রাজাকার ওসমান মেম্বার, কাইল্যা রাজাকার এবং স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান (কেওয়া), মুক্তিযোদ্ধা মফিজ উদ্দিন মৃধা (পিতা মো. আলাউদ্দিন, টেপির বাড়ি), মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সিরাজুল হক ও আজিজুল হক (পিতা আফির মেম্বার), বাবু খালেক (মুলাইদ)-এর বাড়ি লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে তারা মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন মাস্টার (পিতা ইউনুস আলী প্রধান, টেংরা), মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মতিউর রহমান (পাঁচলটিয়া, গোসিংগা)-এর বাড়িঘর লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া তারা সাতখামাইর এলাকার আজম আলী (পিতা আবেদ উল্ল্যা), আতর আলী (পিতা শুক্কুর আলী), ইউসুফ আলী (পিতা হাশমত আলী), ইসমাইল হোসেন (পিতা মাজম আলী), আ. কুদ্দস (পিতা আ. লতিফ), আ. সাত্তার (পিতা উবেদ উল্যাহ), মোহাম্মদ আলী কেরানী, লিয়াকত আলী (পিতা দুলাল মাস্টার), সাহাবুদ্দিন (পিতা এরশাদ আলী), আ. লতিফ (পিতা খলিল শেখ), ছালাম (পিতা ফজর আলী), ডালেশ্বর গ্রামের বাদশা মিয়া (পিতা হালিম উদ্দিন), রাজ্জাক মিয়া (পিতা ফজর আলী), মুক্তিযোদ্ধা বারেক (পিতা ফজর আলী), আলম (পিতা ওবায়দুল্যাহ), আহম্মদ আলী (পিতা ইমাম আলী) প্রমুখের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পাকবাহিনী বরমী বাজার এবং কাওরাইদ বাজারে অগ্নিসংযোগ করে সমস্ত দোকানপাট পুড়িয়ে দেয়।
শ্রীপুর থানা ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। তাছাড়া গোসিংগা রাজকাচারি ক্যাম্প, কাউরাইদ স্টেশন ক্যাম্প, সাতখামাইর স্টেশন ক্যাম্প, গোলাঘাট পুলপার ক্যাম্প, ইজ্জতপুর নির্যাতনকেন্দ্ৰ, বলদীঘাট স্কুল অস্থায়ী ক্যাম্প, গাজীপুর স্টেশন ক্যাম্প তাদের নির্যাতনকেন্দ্র ছিল।
শ্রীপুরের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট রহমত আলী কলেজ বধ্যভূমি। পাকবাহিনী বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরপরাধ মানুষদের ধরে এনে এখানে হত্যা করে। ১৭ই জুন থেকে ১০ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এ বধ্যভূমিতে যাদের হত্যা করা হয়, তাদের মধ্যে ১৭ জনের নাম জানা যায়। এছাড়া লোহাগাছ রেললাইন ও সাতখামাইর ক্যাম্পও ছিল পাকবাহিনীর বধ্যভূমি। মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট রহমত আলী কলেজ, সাতখামাইর, দরগাহর চালা প্রভৃতি এলাকায় গণকবর রয়েছে।
শ্রীপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকগুলো যুদ্ধ ও অপারেশনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে কাওরাইদ যুদ্ধ, গোসিংগা-গোলাঘাট ক্যাম্প আক্রমণ, সাতখামাইর ক্যাম্প আক্রমণ, পারুলী ব্রিজ আক্রমণ, মাওনা যুদ্ধ, গোলাঘাট রেলসেতু ক্যাম্প দখল, কাওরাইদ রেলস্টেশন ক্যাম্প দখল, ইজ্জতপুর যুদ্ধ, শ্রীপুর যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। ২০শে এপ্রিল কাওরাইদ বাজারে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। সুবেদার সুলতান আহমেদ এবং হাবিলদার আফাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে এ-যুদ্ধে পাকসেনারা বিমান হামলা করলে মুক্তিযোদ্ধরা পিছু হটেন। এপ্রিলের শেষদিকে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাশফোকা প্রাইমারি স্কুল মাঠে গ্রামবাসী একজন পাকসেনা, রাজাকার শহীদ (ডাকাত) এবং একজন মুসলিম লীগ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করে। ৭ই জুন মজিবর রাজাকারের সহযোগিতায় গোসিংগা রাজকাচারি পাকসেনা ক্যাম্প থেকে কয়েকজন পাকসেনা ২ সন্তানের জননী ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা মমতাজ বেগম (গোসিংগা)-কে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে।
জুন মাসের মাঝামাঝি মুক্তিযোদ্ধা আকমল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পারুলী ব্রিজ ধ্বংস করেন। ব্রিজ ধ্বংসের পূর্বে তারা রাজাবাড়ি পারুলী রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে ৪ জন রাজাকারকে আটক করেন। নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর গোলাঘাট রেলসেতু ক্যাম্প আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা মফিজ উদ্দিন মোড়ল, আলাউদ্দিন ভূঁইয়া ও সিরাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে আবদুল ওহাব শেখ, আহম্মেদ আলী, গিয়াস উদ্দিন প্রমুখ এ আক্রমণে অংশ নেন। আক্রমণে পাকবাহিনী পলায়ন করে তাদের কাওরাইদ ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। এ আক্রমণে পাকসেনা ক্যাম্পে অবস্থানরত বাঙালি সুবেদার মো. ছমিউল্লাহ (বড়কুল) বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি শত্রুপক্ষের মধ্যে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা কাওরাইদ রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশের গুণিয়াকুড়ি নামক গ্রামে রেলপথ উপড়ে ফেলেন। এরপর তাঁরা কাওরাইদ পাকসেনা ক্যাম্পে আক্রমণ চালান। লড়াইয়ে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী ময়মনসিংহের দিকে পলায়ন করে। মুক্তিযোদ্ধাদের এ আক্রমণেও মুখ্য ভূমিকা পালন করেন বাঙালি সুবেদার মো. ছমিউল্লাহ। ১৭ই নভেম্বর মাওনা পাথার এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে একজন পাকসেনা নিহত এবং ২ জন বন্দি হয়। বিএলএফ গ্রুপ কমান্ডার আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে এ- যুদ্ধে আবদুল হাই, আবদুর রহমান এবং ভারত থেকে আসা একটি গ্রুপ অংশ গ্রহণ করে। ৩রা ডিসেম্বর রাজাবাড়ি ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের ব্রিজের দক্ষিণ পাশে ক্যাম্প থেকে একদল পাকসেনা তাদের লালসা মেটাতে এক কিলোমিটার দূরে মাধবপুর গ্রামের সুরবালার বাড়িতে হামলা করে। তারা সুরবালা দেবী (২০) (স্বামী যতীন্দ্র চন্দ্র মণ্ডল, মাধবপুর, রাজাবাড়ি), তার ভাসুরের ছেলের বউ নিদ্রা রানী (১৬) (স্বামী মনোরঞ্জন মণ্ডল, মাধবপুর, রাজাবাড়ি)-কে ইজ্জতপুর পাকসেনা ক্যাম্পে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন করে। ৬ ও ৭ই ডিসেম্বর কমান্ডার জেড আই সুবেদের নেতৃত্বে প্লাটুন কমান্ডার এম এ কাদের (প্রহ্লাদপুর), সেকশন কমান্ডার আব্দুল বারেক (শ্রীপুর), সেকশন কমান্ডার মোবারক হোসেন (মাওনা), সেকশন কমান্ডার হাজী জয়নাল আবেদীন মোড়ল (গোসিংগা), সেকশন কমান্ডার মিয়ার উদ্দিন (ইজ্জতপুর), সেকশন কমান্ডার হযরত আলী, সেকশন কমান্ডার আজিজুল হক, সেকশন কমান্ডার মাহবুবুর রহমান ফকির, সেকশন কমান্ডার আবু সাইদ, সেকশন কমান্ডার বাবর আলী সরদার, কমান্ডার মতিউর রহমান, নূর আহাম্মদ বকুল এবং সর্ব কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা মো. সাহাবউদ্দিন-সহ ৬৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ইজ্জতপুর রেলওয়ে পাকসেনা ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। পাকসেনাদের প্রতিআক্রমণে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। পাকসেনাদের ভারী অস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন এবং গোসিংগা হাইস্কুলের ৯ম শ্রেণির ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা সাহাবউদ্দিন (খোজেখালি) শহীদ হন। অপরপক্ষে ৬ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। এ-যুদ্ধের পরপরই পাকসেনারা ইজ্জতপুর ক্যাম্প থেকে পলায়ন করে শ্রীপুর ক্যাম্পে চলে যায়। ১২ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে শ্রীপুর পাকসেনা ক্যাম্প আক্রমণ করেন। পাকসেনারাও শেষবারের মতো মরণ কামড় দেয়ার চেষ্টা করে। তুমুল গোলাগুলির এক পর্যায়ে পাকসেনারা একটি রেলগাড়িতে পলায়ন করে রাজেন্দ্রপুর চলে যায় এবং রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। ১২ই ডিসেম্বর শ্রীপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
শ্রীপুরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সার্জেন্ট সাদির আকন্দ (কেওয়া), বাদশা আকন্দ (কেওয়া; সাদির আকন্দের ভাই), পুলিশ সদস্য আ. রাজ্জাক (আশুলিয়াপাড়া), মো. সাহাব উদ্দিন (খোজেখালি; ৯ম শ্রেণির ছাত্র, গোসিংগা হাইস্কুল), মইন উদ্দিন (খোজেখালি; ৯ম শ্রেণির ছাত্র, গোসিংগা হাইস্কুল), মো. আমজাদ হোসেন (বর্ণল), মো. মাজম আলী (ধনুয়া), মো. সিরাজুল ইসলাম (সোহাদিয়া), মো. আ. রশিদ চুন্নু (কোশাদিয়া), মো. শামসুদ্দিন (সিংগারদিঘি), মো. আ. আউয়াল (ডালেহর), মো. আব্দুল হালিম (কেওয়া পশ্চিমখণ্ড), মো. তমিজ উদ্দিন (কেওয়া পশ্চিমখণ্ড), মো. মোফাজ্জল হোসেন (ভিটিপাড়া), মো. জামাল উদ্দিন (ধনুয়া), খন্দকার আবুল খায়ের (চকপাড়া), মো. জহির উদ্দিন (চকপাড়া), নায়েক মোহাম্মদ আলী (টেপিরবাড়ী) এবং মো. আ. হাকিম (চকপাড়া)।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান ও ত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ মমতাজ বেগম (স্বামী মো. রমিজ উদ্দিন, লতিফপুর, গোসিংগা), সুরবালা দেবী (স্বামী যতীন্দ্র চন্দ্র মণ্ডল, মাধবপুর, রাজাবাড়ি), নিদ্রা রানী (স্বামী মনোরঞ্জন মণ্ডল, মাধবপুর, রাজাবাড়ি), শিরিন আক্তার (পিতা মনসুর আলী আকন্দ, “স্বামী আব্দুল কুদ্দস, সাতখামাইর, বরমী), ছালেহা আক্তার (পিতা ছমেদ আলী বেপারী, টেংরা, তেলিহাটি), সাফিয়া খাতুন (স্বামী সামছুদ্দিন, টেংরা)-কে বীরঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
শ্রীপুরের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- হযরত আলী (পিতা কেরামত আলী, লতিফপুর, গোসিংগা), মো. মোবারক হোসেন সরকার (পিতা রমিজ উদ্দিন সরকার, পেলাইদ, গোসিংগা), মো. জয়নাল আবেদীন (পিতা শামসুদ্দিন, বড়নল, বরমী), আবুল কাশেম (পিতা আহম্মদ মালী, ধনুয়া), আ. মান্নান (পিতা হুরমত আলী, লতিফপুর, গোসিংগা), জেড আই সুবেদ (পিতা আজম আলী, কায়েতপাড়া, বরমী; যুদ্ধকালীন থানা কমান্ডার), আব্দুল মালেক (পিতা ওমর আলী, নান্দিয়া সাঙ্গুন, কাওরাইদ; বেঙ্গল রেজিমেন্ট), মো. আবুল হাসান (শ্রীপুর) প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে শ্রীপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ অফিসের সামনে নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য ‘স্মৃতিসৌধ ৭১’। উপজেলা সদরে স্থাপিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট রহমত আলী কলেজ। মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট রহমত আলী কলেজ বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সংলগ্ন এলাকায় শহীদ সাহাব উদ্দিন শিশু কানন নামে একটি স্কুল স্থাপন করা হয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদীর বরমী ঘাটের নামকরণ করা হয়েছে আলহাজ্ব এডভোকেট মো. রহমত আলী ঘাট। মাওনা হাইস্কুলে নির্মিত হয়েছে আলহাজ্ব এডভোকেট মো. রহমত আলী অডিটোরিয়াম। শ্রীপুর-মাওনা সড়কের নামকরণ করা হয়েছে আলহাজ্ব এডভোকেট মো. রহমত আলী সড়ক। শ্রীপুর-মাওনা সড়ক থেকে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ সাদির আকন্দ সড়ক। কেওয়া বাজার থেকে টেপির বাড়ি বাজার পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ বাদশা আকন্দ সড়ক। শ্রীপুর থেকে গোসিংগা পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ সাহাব উদ্দিন সড়ক। শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী কলেজ থেকে বাগমারা এতিমখানা পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা হাজী আফতাব উদ্দিন সড়ক। মাওনা বাজার সড়ক থেকে কড়ইতলী বাজার পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান সড়ক। মাওনা প্রশিকা মোড় থেকে দরগারচালা মোড় পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম সড়ক। পটকা থেকে কাপাসিয়া পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কবির সড়ক। মাওনা থেকে টেপির বাড়ি পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম আকন্দ সড়ক। মাওনা চৌরাস্তা থেকে মাওনা প্রশিকা সংযোগ সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কাজিমউদ্দিন সড়ক। মাওনা পিয়ার আলী কলেজ থেকে কড়ইতলা পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা আ জ ম এনামুল হক সড়ক। মাওনা বাজার থেকে বহেরার চালা পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা শেখ আতাহার আলী সড়ক। [মো. নূরুন্নবী আকন্দ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড