মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর উপজেলা (মাগুরা)
শ্রীপুর উপজেলা (মাগুরা) একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জনপদ। ১৯৮৬ সালে এটি উপজেলার মর্যাদা পায়। এর উত্তর ও পূর্ব দিকে গড়াই নদী, পশ্চিমে ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলা এবং দক্ষিণ দিকে মাগুরা সদর উপজেলা। কুমার ও গড়াই নদী বিধৌত এ উপজেলার বিভিন্ন স্থান বিল এলাকা হওয়ায় অঞ্চলটি প্রাকৃতিকভাবে বেশ সুরক্ষিত। উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধকালে মাগুরার সঙ্গে এ উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থাও সুবিধাজনক ছিল না। এ সমস্ত কারণ এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের সক্রিয় ভূমিকার ফলে শ্রীপুর মুক্তিযুদ্ধে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে। সোহরাব হোসেন এমএনএ, আসাদুজ্জামান এমপিএ, সৈয়দ আতর আলী এমপিএ, শ্রীকোল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও শ্রীপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিয়া আকবর হোসেন, ছাত্রলীগ নেতা মোল্যা নবুয়ত আলী (কমান্ডার, মাগুরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল), শ্রীপুর পাইলট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহিম জোয়ার্দার, কাজলী গ্রামের মতিয়ার রহমান মাস্টার প্রমুখের নেতৃত্বে শ্রীপুরে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয়।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর দেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় শ্রীপুরেও প্রতিরোধযুদ্ধের জন্য সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় শ্রীপুরে সংগ্রাম কমিটির এক বৈঠকে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক মিয়া আকবর হোসেন, হরিন্দীর মিঞা শাহাদত হোসেন, সুধীর কুমার, জোকার মো. আলাউদ্দিন, শ্রীপুরের মুকুল, গোয়ালপাড়ার আবু বকর, টুপিপাড়ার আবুল হোসেন মিয়া, মিয়া সিরাজুল ইসলাম, হোগলডাঙ্গার নাসিরসহ কলেজের কিছু সংখ্যক ছাত্রের উদ্যোগে মাগুরার আনসার ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। ক্যাম্প প্রতিষ্ঠায় মো. সোহরাব হোসেন এমএনএ, মো. আসাদুজ্জামান এমপিএ এবং মহকুমা প্রশাসক ওয়ালিউল ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ক্যাম্পের অধিকাংশ প্রশিক্ষণার্থী ছিল শ্রীপুরের। ক্যাম্পে ট্রেনিং ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পুলিশের হাবিলদার শাহজাহান (বারঘরিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ), হরেছার রশিদ ও আব্দুল মান্নান। ক্যাম্পের সার্বিক পরিচালনায় ছিলেন আকবর হোসেন মিয়া। আসাদুজ্জামান এমপিএ কন্ট্রোল রুম থেকে বিভিন্ন জায়গার খোঁজখবর নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম সুষ্ঠুভাবে চালাবার নির্দেশ দিতেন।
এলাকার মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের জন্য ক্যাম্পে প্রচুর পরিমাণে চাল, ডাল, চিড়া, মুড়ি, ডাব, নারকেল, তরিতরকারি সরবরাহ করত। এ সকল খাবার মুক্তিযোদ্ধাদের বিতরণের পর অবশিষ্টাংশ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যাওয়া পথচারীদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হতো। এ অসহায় মানুষের জন্য খামারপাড়া, কাজলী ও সাচিলাপুর বাজারে সাহায্য শিবির এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয়৷
বরিশাটের মোল্যা নবুয়ত আলী, মো. জাকির হোসেন, কাজলীর মোল্যা মতিয়ার রহমান, নুরুল মোল্যা, আব্দুর রহিম জোয়ার্দার, মোসলেম মোল্যা প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে আকবর হোসেন মিয়া মাগুরার ট্রেজারি থেকে ৬টি থ্রি-নট- থ্রি ও একটি চাইনিজ রাইফেল উদ্ধার করে শ্রীপুরের দাইরপোলের মো. শাহাবুদ্দিন খানের বাড়ি এবং প্রত্যন্ত গ্রাম খালিয়া খড়িচাইলে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করেন। অতঃপর টুপিপাড়ায় শান্তি শিকদারের বাড়িতেও ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এছাড়া শ্রীপুর, খামারপাড়া, রাধানগর, করুন্দি, নাকোল, নহাটাসহ বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে ছাত্র, কৃষক, শিক্ষক- কর্মচারীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। দিনে-দিনে ক্যাম্পে যোগ দিতে থাকেন সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর প্রশিক্ষিত সৈন্যরা। পরবর্তীকালে মাগুরার মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে গমন করলে মাগুরার মুক্তিযুদ্ধ শ্রীপুরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এ-সময় শ্রীপুর বাহিনী মাগুরা ও ঝিনাইদহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে প্রতিরোধ ও সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ বাহিনী শৈলকুপা থানা লুণ্ঠন করে।
শ্রীপুর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য সংগঠকরা হলেন- মিয়া আকবর হোসেন, মোল্যা নবুয়ত আলী, জোয়ার্দার আব্দুর রহিম, খন্দকার নাজায়েত আলী, খন্দকার সুজায়েত আলী (খামারপাড়া), শাহাবুদ্দিন খান, দিলীপ ঘোষ (দাইরপোল) প্রমুখ। উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন মিয়া আকবর হোসেন এবং মোল্যা নবুয়ত আলী। এছাড়া স্থানীয় অপারেশন কমান্ডার ছিলেন আয়েন উদ্দিন (শৈলকুপা), আনোয়ার হোসেন (পূর্ব শ্রীকোল), আব্দুল ওহাব মিয়া (টুপিপাড়া), বদরুল আলম (বেলনগর) এবং গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন সৈয়দ মারুফ আহমেদ মাক্কু, মো. রফিকুল ইসলাম, শেখ আব্দুল মজিদ, ইউনুচ আলী মোল্যা প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্রীপুর উপজেলায় আকবর বাহিনী – নামে একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। টুপিপাড়া গ্রামের মিয়া গোলাম কাদেরের পুত্র মিয়া আকবর হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত এ বাহিনী পরবর্তীকালে শ্রীপুর বাহিনী নামে পরিচিত হয়। শ্রীপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটিং সেন্টার, ট্রেনিং ক্যাম্প ইত্যাদি পরিচালনার পাশাপাশি এলাকায় শান্তি- শৃঙ্খলা রক্ষায়ও এ বাহিনী তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, রাজবাড়ী ও ফরিদপুর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় এ বাহিনীর জোর তৎপরতা ছিল। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডারদ্বয় এ বাহিনীর বীরোচিত তৎপরতার স্বীকৃতিস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের শাখা বাহিনী হিসেবে একে শ্রীপুর বাহিনী নামে অনুমোদন দিয়ে সনদপত্র প্রদান করেন।
২৬শে মার্চ কারফিউ জারি হলে দেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় শ্রীপুর উপজেলায়ও সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয়। শ্রীপুর বাহিনী কর্তৃক শৈলকুপা থানা লুটের সংবাদে পাকবাহিনী শৈলকুপা হয়ে শ্রীপুর অভিমুখে অগ্রসর হয়। তারা শ্রীপুরের সীমান্তবর্তী আবাইপুরে এসে ক্যাম্প স্থাপন করে। আকবর বাহিনীর যোদ্ধারা শ্রীকোল-সরইনগরে তাদের বাঁধা দেয়। পাকবাহিনী শ্রীকোল দিয়ে অগ্রসর হতে না পেরে কুমার নদীর দুধার দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। এ সংবাদে শ্রীপুরের মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন কৌশলপূর্ণ স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। মীনগ্রামের মান্দারতলায় অবস্থানরত শ্রীপুর বাহিনীর একটি দল প্রচণ্ড গুলির আঘাতে বেশ কয়েকজন শত্রুসৈন্যকে আহত করে। অপরদিকে সরইনগর ওয়াপদা ক্যানেলের ধারে পৌঁছানোর সঙ্গে-সঙ্গে কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের অপর এক গ্রুপ এবং ক্যানেলের অপর পাড় থেকে আরেকটি গ্রুপ পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। আলফাপুর যুদ্ধএ মুক্তিযোদ্ধাদের এই চতুর্মুখী আক্রমণে পাকসেনারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু করে। এ আক্রমণে ৫৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান ও শান্তি কমিটির সেক্রেটারি সালাম মুন্সীর প্ররোচনায় ১৫ই মে পাকবাহিনী প্রথম শ্রীপুরে আসে। এদিন ওসি মতিয়ার রহমানের তৎপরতায় পাকবাহিনী পুলিশের হাবিলদার শাজাহানকে ধরে নিয়ে ঐ দিনই মাগুরাতে ফিরে যায়। হাবিলদার শাজাহান কৌশলে মুক্তি পেয়ে শ্রীপুরে ফিরে এসে শ্রীপুর বাহিনীতে যোগদান করেন। কয়েকদিন পরে মেজর ইলিয়াস ও ক্যাপ্টেন সাঈদের নেতৃত্বে পাকবাহিনী শ্রীপুরে এসে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে মাগুরা ফিরে যায়। উল্লেখ্য যে, শ্রীপুর বাহিনীর জোরালো অবস্থানের কারণে পাকবাহিনী শ্রীপুরে স্থায়ীভাবে ক্যাম্প স্থাপনে সাহস পায়নি। তারা মাঝে- মধ্যে এ এলাকায় ঝটিকা আক্রমণ করে চলে যেত অথবা শ্রীপুর থানায় বা শ্রীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দু-চারদিন অবস্থান করে মাগুরা অথবা শৈলকুপায় ফিরে যেত।
পাকিস্তানের সমর্থক শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মতিয়ার রহমানের উদ্যোগ এবং কয়েকজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সমন্বিত প্রচেষ্টায় শ্রীপুরে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শ্রীপুর থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল সৈয়দ আলী বিশ্বাস (বদনপুর) এবং সেক্রেটারি ছিল আব্দুস সালাম মুন্সী (টুপিপাড়া)। কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিল- কালীনগরের মসলেম সর্দার, বাখেরার জবেদ মোল্যা, আবেদ মোল্যা, বিলাত আলী সর্দার, রাশেদ, পূর্ব শ্রীকোলের মহিউদ্দিন জোয়ার্দার, আব্দুল আউয়াল, বরিশাটের এদোন প্রমুখ। এ কমিটি শ্রীপুরে জনসভা করে জনগণকে পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান জানায়। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মাগুরা মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মসিউল আযম। তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পর্যায়ক্রমে শ্রীপুরে রাজাকার আলবদরআলশামস বাহিনী গঠন করা হয়। শ্রীপুরে রাজাকার কমান্ডার ছিল শ্রীরামপুরের মসলেম মোল্যা, ফতেহ আলী (ভায়না) প্রমুখ। ডাক্তার শমসের আলী ওরফে বকু মিয়ার বড় ছেলে ভোলা আলশামস বাহিনীতে এবং অপর ছেলে চক্কু আলবদর বাহিনীতে যোগ দেয়। শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান বিভিন্ন স্থান থেকে আশ্রয়ের জন্য আসা লোকজনের নিকট থেকে পুলিশ দিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নিত। শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলশামস ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা পাকবাহিনীকে পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রাম ও হিন্দুপাড়ায় নিয়ে যেত এবং মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের বাড়িঘর ও দোকানপাট লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করত।
মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা শ্রীপুর অঞ্চলে হত্যা ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। এ-সময় তারা শ্রীপুর বাহিনীর অন্যতম সদস্য আনার উদ্দিনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং ধ্রুব কুণ্ডুকে হত্যা করে। জুলাই মাসের প্রথম দিকে মাগুরা মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মসিউল আযমের প্রচেষ্টায় জামায়াত ও মুসলিম লীগ-এর সদস্যরা উজ্জীবিত হয়। কালীনগরের শান্তি কমিটির সদস্য মসলেম সর্দার এবং পূর্ব শ্রীকোলের আব্দুল আওয়াল আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে পাকবাহিনীর সঙ্গে হাত মেলায়। তাদের নেতৃত্বে পাকবাহিনী খামারপাড়া বাজারের বেশকিছু দোকানপাট লুটতরাজ ও ভস্মীভূত করে। ১০ই আগস্ট রাজাকার বাহিনীসহ পাকসেনারা শ্রীপুরে এলেও শ্রীপুর বাহিনীর সতর্ক অবস্থানের কারণে তারা কোনো অঘটন ঘটাতে পারেনি। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে পাকসেনাদের অত্যাচার তীব্রতর হয়ে ওঠে। এ-সময় তারা খামারপাড়া বাজারে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে এবং টুপিপাড়ার শান্তি শিকদারের বাড়িসহ (মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প) বেশ কয়েকটি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ২৫শে নভেম্বর পাকসেনা এবং রাজাকারদের এক বিশাল বাহিনী নাকোল-কাদিরপাড়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে ব্যাপক লুটতরাজ ও সাধারণ মানুষের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এ-সময় তারা কয়েকজন ব্যক্তিকে হত্যা করে এবং নারীনির্যাতনের চেষ্টা চালায়। এছাড়াও তারা শ্রীপুর বাহিনীর অধিনায়ক মিয়া আকবর হোসেন, উপ-অধিনায়ক মোল্যা নবুয়ত আলীর বাড়ি, উপজেলার কাজলী, মাশালিয়া, দাইরপোল, পূর্ব শ্রীকোল, খামারপাড়া প্রভৃতি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
উপজেলায় রাজাকার ও পাকসেনাদের স্থায়ী ক্যাম্প না থাকায় এখানে কোনো নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির গড়ে ওঠেনি। তবে তারা সাধারণ মানুষ বা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে থানায় নিয়ে নির্যাতন করত।
১০ই আগস্ট ৪০ জন রাজাকার ও ৩৩ জন বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্য শ্রীপুর অভিযানে আসে। এ-সময় শ্রীপুর বাহিনী প্রতিরোধযুদ্ধের জন্য যথেষ্ট শক্তির অধিকারী হয়ে ওঠে। অবস্থা বুঝতে পেরে পাকসেনারা শ্রীপুর থানায় কিছুক্ষণ অবস্থান করে রাজাকারদের রেখে শৈলকুপার দিকে পালিয়ে যায়। ১০ই অক্টোবর পাকবাহিনী মাগুরা থেকে গাংনালিয়া হয়ে খামারপাড়ার দিকে অগ্রসর হয়। ১১ই অক্টোবর তারা টুপিপাড়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ও খামারপাড়া বাজার লুট করতে গেলে শ্রীপুর বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয়। খামারপাড়া বাজার যুদ্ধে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। এ- সময় রাজাকার ও পাকসেনারা যৌথভাবে মাগুরা থেকে গাংনালিয়া হয়ে শ্রীপুর যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সংবাদে শ্রীপুর বাহিনী গাংনালিয়া বাজারের পাশে অবস্থান নিয়ে পাকসেনাদের প্রতিরোধ করে। যুদ্ধ চলাকালে পাকসেনারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও এখানে ১৫-২০ জন রাজাকার নিহত হয়।
২৪শে নভেম্বর পাকবাহিনী মাগুরা থেকে নাকোল হয়ে শ্রীপুর যাওয়ার চেষ্টা করলে নাকোল বাজারে মুক্তিযোদ্ধারা মাক্কু মিয়ার নেতৃত্বে তাদের আক্রমণ করে। এ-সময় উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। নাকোল বাজার যুদ্ধে পাকবাহিনীর একজন কর্নেলসহ বেশ কয়েকজন সৈন্য নিহত হয় এবং তাদের দুটি গাড়ি ধ্বংস হয়। এ-সময় হঠাৎ করে আরো কিছু পাকসেনা ঘটনাস্থলে এসে পড়ায় বাকি সৈন্যদের জীবন রক্ষা পায়। এ ঘটনার প্রতিশোধকল্পে পরদিন পাকসেনারা রাজাকারদের সহায়তায় রায়নগর-ঘাসিয়ারা এলাকায় ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে। তারা বিভিন্ন বাড়িতে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে এবং ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। কিন্তু শ্রীপুর বাহিনীর প্রতিআক্রমণে শেষ পর্যন্ত তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। শ্রীপুরে পাকবাহিনীর কোনো ক্যাম্প ছিল না। ফলে ৭ই ডিসেম্বর মাগুরা জেলা হানাদারমুক্ত হলে একই দিন শ্রীপুর উপজেলাও হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— আব্দুল মোতালেব, বীর বিক্রম (পিতা গোলাম ছারোয়ার মিয়া, পূর্ব শ্রীকোল), মতিউর রহমান, বীর বিক্রম (পিতা রোয়াজেস আলী জোয়ারদার, শ্রীপুর) ও সৈয়দ আমিরুজ্জামান, বীর বিক্রম (পিতা সৈয়দ আব্দুল ওয়াহেদ, হরিনদী)।
শ্রীপুর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল মোতালেব, বীর বিক্রম (দিনাজপুরে শহীদ), মুকুল (শ্রীপুর; বিনোদপুরে শহীদ), মোকাররম আলী (খামারপাড়া; বগুড়ায় শহীদ), আব্দুর রাজ্জাক (দাইরপোল), রিয়াদ আলী (হাজীপুর), মুন্সী আলীউজ্জামান (বিষ্ণুপুর), আব্দুস সাত্তার (বরালদাহ), নজরুল ইসলাম (কাজলী), মুন্সী আব্দুর রাজ্জাক (বারইপাড়া; কামান্নাতে শহীদ), হারেছার মিয়া (ছোনগাছা), অধীর কুমার (হাজীপুর), আব্দুর রাশেদ (হরিরামপুর), মোক্তার হোসেন (কাদিরপাড়া), নির্মল কুমার বিশ্বাস (ঝগভাঙ্গা), মুন্সী হাবিবুল্লাহ (বিষ্ণুপুর), কাজী আব্দুল বারিক (পূর্ব শ্রীকোল; চট্টগ্রামে শহীদ), রাজা (বারইপাড়া; কামান্নাতে শহীদ), সালেক (দ্বারিয়াপুর; কামান্নাতে শহীদ), আব্দুল কাদের (মোর্তজাপুর; কামান্নাতে শহীদ), কনস্টেবল রউফ (ঘাসিয়ারা; কুষ্টিয়ায় শহীদ) এবং আব্দুল গফুর (বরিশাট)। উপজেলার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- কাজী ইকরাম হোসেন (কাজলী), হাফিজুর রহমান (দারিয়াপুর), তোয়াক্কেল হোসেন (কাজলী), শেখ কউছার আলী (তারাউজিয়াল), আব্দুল হামিদ শেখ (রাজধরপুর), জমির হোসেন (কোদলা), আব্দুর রাশেদ (রায়নগর), মাহাতাব হোসেন (রায়নগর), তোফছের হোসেন (সোনাতুন্দি), লিয়াকত আলী (মোকাদমখোলা), বীরাঙ্গনা লাঈলী বেগম (বদনপুর), আব্দুল আজীজ মৃধা (রাজধরপুর), ইয়াকুব মোল্যা (চণ্ডিখালী), মিঞা বছিরুজ্জামান (দরিবিলা) প্রমুখ। মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য লাঈলী বেগম (বদনপুর)-কে ‘বীরাঙ্গনা’, আব্দুল মোতালেব (পূর্ব শ্রীকোল), সৈয়দ আমিরুজ্জামান (হরিন্দী) এবং সৈয়দ রফিকুল ইসলাম (বরিশাট)-কে ‘বীর বিক্রম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে শ্রীপুর থানার সামনে নবগঙ্গা নদীর কোল ঘেঁষে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। বিনোদপুরে শহীদ মুকুল স্মরণে নির্মিত হয়েছে শহীদ মুকুল স্মৃতিস্তম্ভ। হরিন্দী থেকে শ্রীপুর পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বীর বিক্রম সৈয়দ আমিরুজ্জামান সড়ক। খামারপাড়া মাদ্রাসার মোড় থেকে পূর্ব শ্রীকোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে আব্দুল মোতলেব, বীর বিক্রমএর নামে। এছাড়া মাগুরা-শ্রীপুর সড়ক থেকে পূর্বদিকে গ্রামের অভ্যন্তরে নবুয়ত মোল্যার বাড়ির দিকে অগ্রসরমাণ একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন সড়ক। [মো. আলফাজ উদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড